বিশ্বের সব ধরনের প্রসেসর, সেটা মূল সিপিইউ হোক বা গ্রাফিকস প্রসেসর, এমনকি স্মার্টফোনের প্রসেসরও তৈরি করে থাকেন গুটিকয়েক নির্মাতা। এই মনোপলির ফলে আজ বাজারে সৃষ্টি হয়েছে চরম সংকট, চাহিদার তুলনায় নেই সরবরাহ, দাম দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। কিভাবে তৈরি হয় প্রসেসর, এ মনোপলির কারণই বা কী আর এর থেকে উত্তরণই বা কিভাবে হতে পারে? খোঁজ নিয়ে জানাচ্ছেন এস এম তাহমিদ
প্রসেসর নিয়ে মনোপলির শেষ কোথায়: বাজারে হঠাৎ করেই যেন প্রযুক্তিপণ্যের বিশাল সংকট দেখা দিয়েছে। শুরুতে শুধু গ্রাফিকস কার্ড ও এএমডির প্রসেসরের অভাব দেখা দিলেও সম্প্রতি স্যামসাংও জানিয়েছে, প্রসেসর সংকটের ফলে তারা এ বছর নোট সিরিজের নতুন স্মার্টফোন বাজারে আনবে না। অন্য নির্মাতারাও পুরনো মডেলের স্মার্টফোন প্রসেসরগুলোকে নতুন করে ব্যবহার করতে শুরু করেছে। গেমিং কনসোলের বাজারেও একই অবস্থা। মাইক্রোসফটের নতুন এক্সবক্স কিছু পাওয়া গেলেও সনির প্লেস্টেশন ৫ বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যের প্রায় দ্বিগুণ দামে। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপার, সম্পূর্ণ আলাদা এই ডিভাইসগুলো একসঙ্গে বাজার থেকে হারিয়ে যাওয়ার পেছনের কারণ মাত্র একটি আর সেটা হলো প্রসেসরের সংকট।
যেভাবে প্রসেসর তৈরি হয়: সব ধরনের সেন্ট্রাল প্রসেসিং ইউনিট (সিপিইউ) ও গ্রাফিকস প্রসেসিং ইউনিট (জিপিইউ) তৈরি হয় সিলিকন ওয়েফার থেকে, যার মধ্যে শোধনকৃত সিলিকন ও কিছু ডোপিং ধাতু দেওয়া থাকে। এই ওয়েফারের মধ্যে বিশেষায়িত লেজার ব্যবহার করে ছক কেটে তৈরি করা হয় ট্রানজিস্টর গেট, তথ্য ও শক্তি বহনকারী বিদ্যুৎ চলাফেরা করার পথ। এই ছকের সূক্ষ্মতা যত বেশি হয়, তত বেশি পরিমাণ ট্রানিজস্টর একই আকৃতির সিলিকন ওয়েফারের টুকরো বা ‘ডাই’তে বসানো যায়। সূক্ষ্মতার পরিমাপ করা হয়ে থাকে ট্রানিজস্টরের মধ্যকার গ্যাপের মাপ দিয়ে, যা বর্তমানে ন্যানোমিটারে মাপা হয়ে থাকে।
মাত্র পাঁচ বছর আগেও ১৪ ন্যানোমিটার গ্যাপ ব্যবহার করে সিপিইউ ও জিপিইউ তৈরি করা হতো। বিশ্বের বেশ কিছু চিপ নির্মাতা এই প্রসেস ব্যবহার করায় সক্ষম ছিল। ফলে বিভিন্ন প্রসেসর ও জিপিইউ ডিজাইন কম্পানি একাধিক নির্মাতার মাধ্যমে সেগুলো তৈরি করতে পারত। ধীরে ধীরে এই ট্রানিজস্টর গ্যাপ কমিয়ে আনার দিকে আরো বেশি করে ঝুঁকতে শুরু করেন চিপ নির্মাতারা, যাতে আরো শক্তিশালী প্রসেসর ও জিপিইউ তৈরি করা সম্ভব হয়। এই ট্রানিজস্টর গ্যাপ কমানোর আরো একটি বড় সুবিধা, চিপগুলো আরো কম শক্তি খরচ করে চলতে পারে। ফলে ল্যাপটপ ও ফোনের ব্যাটারি লাইফ বেড়ে যায়, আবার তাপও উৎপন্ন হয় অনেক কম।
সমস্যার শুরু: ট্রানিজস্টর গ্যাপ কমাতে কমাতে বর্তমানে সেটি ৫ ন্যানোমিটারে নামিয়ে আনা হয়েছে, ৭ ন্যানোমিটার প্রযুক্তিই যদিও সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। আগামী দিনে সেটি ৩ ন্যানোমিটারে নামানোর কথাও চিপ নির্মাতারা ঘোষণা করেছেন। কিন্তু এই ট্রানিজস্টর গ্যাপ কমানোর পেছনে আছে এক বিশাল চ্যালেঞ্জ, তা হচ্ছে লেজারের আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য। ট্রানিজস্টর গ্যাপ বর্তমানে অতি-অতিবেগুনি রশ্মির তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সমান হয়ে গেছে। এই বিশেষায়িত রশ্মির লেজার তৈরি এবং তা ব্যবহার করা অত্যন্ত কঠিন ও খরচসাপেক্ষ ব্যাপার। বর্তমানে খুব কম নির্মাতার পক্ষেই এই লেজার ব্যবহার করা সম্ভব। ফলে বাজারে একপ্রকার মনোপলি তৈরি হয়ে গেছে। শুধু তাইওয়ান সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং কম্পানি লিমিটেড বা টিএসএমসি একাই বর্তমানে বিশ্বের ৬০ শতাংশেরও বেশি সিপিইউ ও জিপিইউ তৈরি করে আসছে। তাদের ৭ ন্যানোমিটার প্রসেসর বাকি চিপ নির্মাতাদের কাছে নেই। স্যামসাং বাকি ৪০ শতাংশ বা কিছুটা কম তৈরি করছে। সেগুলো ১৪ ন্যানোমিটার ও ৫ ন্যানোমিটার প্রযুক্তিতে তৈরি। টিএসএমসির ৭ ন্যানোমিটারেই বর্তমানে তৈরি হচ্ছে এএমডির নতুন সব রাইজেন প্রসেসর, রেডিওন গ্রাফিকস কার্ড, প্লেস্টেশন ৫ ও এক্সবক্সের প্রসেসর ও জিপিইউ মিলিয়ে তৈরি সিস্টেম-অন-আ-চিপ বা এসওসি, এনভিডিয়ার নতুন আরটিএক্স ৩০০০ সিরিজ জিপিইউ, কোয়ালকমের ৮০০ সিরিজের ফ্ল্যাগশিপ এসওসি এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল কাজে ব্যবহৃত সব কম্পিউটারের প্রসেসর। এদিকে এ বছর এবং আগামী দিনে টিএসএমসি যে ৫ ন্যানোমিটার প্রযুক্তির প্রসেসর তৈরি করবে, তার পুরোটাই নিজেদের ম্যাক ও আইফোন/আইপ্যাডের জন্য কিনে নিয়েছে অ্যাপল। যেহেতু টিএসএমসি প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ চিপ তৈরি করতে সক্ষম, তাই সেই লটের মধ্যেই ভাগ-বাটোয়ারা করে তাদের সিপিইউ ও জিপিইউর জন্য বরাদ্দ নিয়ে থাকে চিপ ডিজাইনার কম্পানিগুলো। এর চেয়ে বেশি পরিমাণ চিপ চাইলেও বরাদ্দ করা সম্ভব নয় তাদের পক্ষে। আর এখানেই মনোপলিটি তৈরি হয়েছে।
কভিডের কুফল: টিএসএমসির মনোপলি একদিনে হয়নি অবশ্য, কিন্তু তার প্রভাবটি যেন হঠাৎ করেই সবাইকে আঘাত করতে শুরু করেছে। তার একটি বড় কারণ, কভিড ১৯ মহামারি। বিশ্ববাসী হঠাৎ করেই নিজেদের গৃহবন্দি হিসেবে আবিষ্কার করতে শুরু করে। অফিসের কাজ, শিশুদের পড়াশোনা থেকে শুরু করে গুরুজনদের খোঁজখবর নেওয়ার কাজটিও করার জন্য কম্পিউটারের প্রয়োজন শুরু হয়। যাঁরা আগে গেম নিয়ে তেমন একটা মাথা ঘামাননি, তাঁরাও গেম খেলার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ফলে ২০২০ সালে একলাফে গেমিং পিসির জন্য চাহিদা বেড়ে যায় প্রায় পাঁচ গুণ, পাশাপাশি আলাদাভাবে কনসোলের চাহিদা তো ছিলই। অফিসের কাজের জন্যও পিসি কেনার দিকে ঝুঁকে পড়েন ক্রেতারা।
এদিকে হঠাৎ করেই সব কাজ অনলাইনে করার জন্য উঠেপড়ে লাগা গ্রাহকদের বিশাল চাপ সামলাতে জুম, গুগল, মাইক্রোসফট এবং অন্যান্য সেবাপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠানও তাদের সার্ভারের ক্ষমতা বাড়াতে বাধ্য হয়। সার্ভারে ব্যবহৃত হওয়া সিপিইউ ও জিপিইউরও জোগানদাতা এককভাবে টিএসএমসি। এটিও বাজারে সংকটের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
ক্রিপ্টোকারেন্সির অভিশাপ: এর ওপর আছে বর্তমানের ক্রিপ্টোকারেন্সির হাইপ। প্রচুর ক্রেতা বিপুল পরিমাণ গ্রাফিকস কার্ড কিনে নিচ্ছেন ক্রিপ্টোকারেন্সি মাইনিং করার লক্ষ্যে। এমনিতেই গেমিং ও অফিস পিসির চাহিদার ফলে হিমশিম খাওয়া টিএসএমসির ওপর এটা আরো বাড়তি চাপ। যদিও এনভিডিয়া ও এএমডির দাবি, বেশির ভাগ গ্রাফিকস কার্ডই গেমারদের হাতেই যাচ্ছে, যদিও ক্রিপ্টোকারেন্সি মাইনিংয়ের প্রভাব বেশ ভালোভাবেই দৃশ্যমান।
বর্তমান অবস্থা: টিএসএমসির মনোপলির ফলে বাজারে চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ না বাড়ায়, যা হওয়ার তাই ঘটেছে। অর্থনীতির সূত্র অনুসারে চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে মূল্যও গেছে বেড়ে। সরাসরি চিপ নির্মাতা বা বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দাম বাড়ায়নি, তুমুল চাহিদা থাকায় গড়ে উঠেছে একটি কালোবাজার। কালোবাজারিরা যে কাজটি করছে, অপেক্ষাকৃত বেশি বিক্রয়মূল্যে পণ্য কিনে সেটি বিক্রি করছে দ্বিগুণ বা তিন গুণ দামে, যা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক হলেও খোলাবাজার অর্থনীতিতে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। দুঃখজনক হলেও সত্য, বর্তমানের সরবরাহ ও চাহিদা অনুযায়ী পণ্য পাওয়াই যাবে না অথবা পণ্যের মূল্য হবে আকাশছোঁয়া।
সামনের দিনগুলো: টিএসএমসির মনোপলি দ্রুতই কাটছে না। তারা অবশ্য আরো কিছু কারখানা স্থাপন করে চিপ তৈরির ক্ষমতা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু সেটি স্থাপন করে চালু করতেও এক থেকে দুই বছর লাগবে। স্যামসাংও চেষ্টা করছে কিছু চিপ তৈরির দায়িত্ব নেওয়ার, যাতে টিএসএমসির মনোপলি আরেকটু দুর্বল হয়। কিন্তু সেটার জন্যও বেশ কিছু বছর সময় লাগবে।
যদি কভিড-১৯-এর প্রকোপ দ্রুতই না কমে, তাহলে এ চাহিদা কমারও সম্ভাবনা নেই। এমতাবস্থায় একটিই উপায় আছে প্রসেসর ও গ্রাফিকস কার্ড ডিজাইনারদের কাছে, সেটি হচ্ছে পুরনো সিস্টেমে আপাতত ফিরে যাওয়া। আগের ১৪ ন্যানোমিটার প্রযুক্তিতে চিপ তৈরি করতে সক্ষম আরো বেশ কিছু কম্পানি আছে। সমস্যা হচ্ছে, চাইলেও নতুন প্রসেসর বা জিপিইউ, যেমন রাইজেন ৫০০০ সিরিজ বা আরটিএক্স ৩০০০ সিরিজের ডিজাইন ১৪ ন্যানোমিটারে তৈরি করা সম্ভব নয়। তার পরও পুরনো মডেলের জিপিইউ ও সিপিইউ আবারও তৈরি শুরু করার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। বাজেট পিসি বা বাজেট গেমারদের চাহিদা কিছুটা হলেও সেভাবে মেটানো যেতে পারে।
অতএব আগামী দিনগুলোতে পিসি আপগ্রেড করা বা নতুন হার্ডওয়্যার খুচরা মূল্যে কেনার আশা ত্যাগ করতে তবে। টিএসএমসির মনোপলি যত দিন আছে, পিসি, কনসোল ও স্মার্টফোনের বাজার থাকবে বেশ চড়া। -কালের কণ্ঠ অনলাইন।