বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১২:৩৮ পূর্বাহ্ন

আবার ক্রেতারা আগের চেয়ে পোশাকের মূল্য কমিয়ে দিয়েছে

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় বুধবার, ৭ এপ্রিল, ২০২১

আগামী দিনগুলোতেও স্বাভাবিক মাত্রায় কার্যাদেশ পাওয়ার নিশ্চয়তা নেই। হাতে যেসব কার্যাদেশ রয়েছে বা রফতানি হচ্ছে, তারও অর্থ হাতে পেতে সময় লাগে ১৬০ থেকে ২০০ দিন। আবার ক্রেতারা আগের চেয়ে পোশাকের মূল্য কমিয়ে দিয়েছে ১০-১৫ শতাংশ। কোনো প্রকার দরকষাকষির সুযোগ নেই। শ্রমিক-কর্মচারীদের কর্মসংস্থান বজায় রাখার স্বার্থে জানা থাকলেও লোকসান দিয়েই কার্যাদেশ নিতে বাধ্য হচ্ছেন পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা। অন্যদিকে কাঁচামালের বাজারেও চলছে এক চরম অনিশ্চয়তা। সার্বিক পরিস্থিতি মোকাবেলায় চরম হিমশিম খাচ্ছে দেশের রফতানির প্রধান খাতটি।

এ বিষয়ে বিকেএমইএর প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, এ পরিস্থিতির শেষ আমরা এখনো দেখতে পাচ্ছি না। তাই টিকে থাকতে লড়াই করতে হচ্ছে। এ লড়াইটা এখন পর্যন্ত সম্ভব হচ্ছে সরকারের সহযোগিতায়। পরিস্থিতি আরো দীর্ঘায়িত হওয়ার আশঙ্কায় সরকারের কাছ থেকেও দীর্ঘমেয়াদি সহায়তার প্রত্যাশা করছি। নির্দিষ্ট একটি পণ্যের ওপর ভর করে দেশের রফতানি দাঁড়ানোর বিষয়টি ইতিবাচক নয় বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশেষজ্ঞরা। রফতানি খাতের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ ফরেন ট্রেড ইনস্টিউটিটের সিইও আলী আহমেদ বলেন, সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে আপাতত পণ্য বহুমুখীকরণের পদক্ষেপগুলো তেমন কার্যকরভাবে দৃশ্যমান নয়। ফলে বর্তমান সক্ষমতা অনুযায়ী পোশাকনির্ভরতাই অব্যাহত থাকবে। অনেক ধাক্কা খেয়েও আমরা একটি পণ্যের ওপর নির্ভর করেই টিকে আছি। জানতে পারছি পোশাকের ক্রেতারা যে ক্রয়াদেশগুলো বাতিল করেছিলেন, তার অধিকাংশই পুনর্বহাল করছেন; কিন্তু শর্ত জুড়ে দিচ্ছেন। কিছু ক্ষেত্রে দাম কমিয়ে দেয়া বা ক্রয়াদেশের পরিমাণ কমিয়ে দেয়া হচ্ছে। পোশাক বাজারে এখনো ক্রেতা আধিপত্যই শক্তিশালী। একেবারে স্বল্পমেয়াদের ভবিষ্যতে আমার মনে হয়, আমরা এ অবস্থায়ই চলতে বাধ্য হব। অর্থাৎ পোশাক ও প্রধান বাজারগুলোর ওপর নির্ভরশীল হয়েই আমাদের চলতে হবে। এজন্যই পণ্যের পাশাপাশি বাজার বৈচিত্র্যকরণও প্রয়োজন। এছাড়া আর উপায় নেই। একই সময়ে দুদিকেই মনোযোগী হতে হবে।
গত বছরের মার্চে করোনার প্রথম সংক্রমণ শনাক্তের পর তা প্রতিরোধে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। প্রায় দুই মাসের অব্যাহত ওই সাধারণ ছুটিতে স্থবির হয়ে পড়ে দেশের অর্থনীতি। অঘোষিত লকডাউনে কার্যত বন্ধ হয়ে যায় রফতানিমুখী শিল্প-কারখানাও। পরে উৎপাদনের চাকা সচল হলেও মহামারীর কারণেই এখনো নিরবচ্ছিন্ন হয়নি রফতানি। রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যান বলছে, মহামারী শুরুর পরের এক বছরে (এপ্রিল ২০২০ থেকে মার্চ ২০২১) বাংলাদেশ থেকে পণ্য রফতানি কমেছে আগের ১২ মাসের তুলনায় প্রায় ১৩ শতাংশ।
প্রতি মাসেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবি আর) থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে রফতানির মাসিক হালনাগাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করে ইপিবি। নিয়মিত এ প্রতিবেদনের সর্বশেষ সংস্করণ গতকালই প্রকাশ হয়েছে। ইপিবির পরিসংখ্যানে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, দেশে করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আগের ১২ মাসে (এপ্রিল ২০১৯ থেকে মার্চ ২০২০) বাংলাদেশ থেকে পণ্য রফতানি হয়েছে ৩ হাজার ৮৬০ কোটি ৫৮ লাখ ডলারের। অন্যদিকে কভিডের এক বছরে এ পরিমাণ নেমে এসেছে ৩ হাজার ৩৬৩ কোটি ৮৬ লাখ ডলারে। অর্থাৎ কভিডের বছরে বাংলাদেশ থেকে রফতানি কমেছে ৪৯৬ কোটি ৭২ লাখ ডলার বা ১২ দশমিক ৮৬ শতাংশ।
পরিসংখ্যান বলছে, স্বাভাবিক সময়ে বাংলাদেশের মাসিক গড় রফতানির পরিমাণ ৩০০ কোটি ডলার। সে হিসেবে বার্ষিক গড় রফতানি দাঁড়ায় ৩ হাজার ৬০০ কোটি ডলারে। কিন্তু করোনার প্রাদুর্ভাবের শুরুতেই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সরবরাহ চেইনে মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটে। অন্যদিকে সাধারণ ছুটির কারণে দেশেও শুরুর দিকে স্থবিরতা নেমে আসে শিল্পোৎপাদনে।
এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে রফতানি পরিসংখ্যানেও। ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রথম কভিড শনাক্তের পরের মাসেই রফতানিতে সবচেয়ে বড় পতন দেখা যায়। গত বছরের এপ্রিলে বাংলাদেশ থেকে পণ্য রফতানি হয়েছে মাত্র ৫২ কোটি ডলারের। এর আগে ২০১৯ সালের এপ্রিলে রফতানির পরিমাণ ছিল ৩০০ কোটি ডলার। এর পরের দুই মাসেও রফতানিতে গতি ফিরিয়ে আনা যায়নি। মে মাসে এর পরিমাণ ছিল ১৪৬ কোটি ডলার। জুনে রফতানি হয় ২৭১ কোটি ডলারের পণ্য। মূলত এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্তই দেশের রফতানিতে কভিড-১৯-এর প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশি।
বাংলাদেশ থেকে বিশ্ববাজারে রফতানীকৃত পণ্যের ৮৫ শতাংশই তৈরি পোশাক। সংশ্লিষ্টদের দাবি, আন্তর্জাতিক সরবরাহ চেইনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে করোনায় বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সবচেয়ে বেশি।
সংশ্লিষ্টদের মতে, কভিডের প্রভাবে ক্ষতি আরো বেশি হতে পারত। কিন্তু কারখানা সচল রাখা ও সরকারি প্রণোদনার মতো কার্যকর সিদ্ধান্তের কারণে এ ক্ষতির মাত্রা কমিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছে। যদিও রফতানির আন্তর্জাতিক গন্তব্যগুলোর কোথাও কোথাও তৃতীয় ও দেশের করোনার দ্বিতীয় সংক্রমণপ্রবাহের কারণে ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি আরো খারাপ হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
করোনার প্রথম সংক্রমণ শনাক্ত হয় চীনের উহানে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে। এর আগে থেকেই বৈশ্বিক পোশাক খাতে ভঙ্গুরতা দেখা যাচ্ছিল। ব্যবসা সংকোচনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের মানসিকতায় ছিল ছোট-বড় ক্রেতাদের অনেকেই। ফলে অনেক খুচরা বিক্রয়কেন্দ্র ছিল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পথে। করোনার প্রভাবে আন্তর্জাতিক ক্রেতারা আরো দুর্দশায় পড়ে যায়। সংক্রমণ প্রতিরোধে অবরুদ্ধতার কারণে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রাখতে হয় বিক্রয়কেন্দ্র। এর ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশেও পোশাক রফতানিকারকদের ক্রয়াদেশ বাতিল হয় একের পর এক। খাতসংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজিএমইএর হিসাব বলছে, কভিডের প্রথম সংক্রমণপ্রবাহের কারণে গত বছরের এপ্রিলের মধ্যেই প্রায় সোয়া ৩ বিলিয়ন ডলারের ক্রয়াদেশ বাতিল হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি রফতানি পরিসংখ্যানেও সংগঠনটির এ দাবির যথার্থতা পাওয়া যাচ্ছে।
বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক বলেন, বাংলাদেশের পোশাক রফতানির বাজারগুলোয় ভাইরাস সংক্রমণ মোকাবেলার লড়াই এখনো চলছে। এরই মধ্যে শুরু হয়েছে তৃতীয় সংক্রমণপ্রবাহের প্রভাব। ভাইরাস বেশ ভালোভাবেই মোকাবেলা করছিল বাংলাদেশ। বর্তমানে চলমান লকডাউন সময়োচিত। তবে তা হতাশাগ্রস্ত শিল্পটির পারফরম্যান্সে আরো নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
এ খাতের উদ্যোক্তাদের আরেক সংগঠন বিকেএমইএর পর্ষদ প্রতিনিধিরা বলছেন, করোনার প্রভাবে সারা বিশ্বের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত। অর্থনীতির স্থবির চাকাকে চলমান রাখতে রীতিমতো সংগ্রামে লিপ্ত উদ্যোক্তাসহ খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। সংকুচিত হয়ে পড়েছে কর্মক্ষেত্র। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নতুন লকডাউনে পড়ে গৃহবন্দি হয়ে পড়েছে বিশাল এক জনগোষ্ঠী। কবে নাগাদ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে তার কোনো পূর্বাভাসও নেই। বর্তমান সময় অতিবাহিত হচ্ছে চরম প্রতিকূলতা ও অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে। বিকেএমইএর প্রতিনিধিরা বলছেন, কারখানায় পর্যাপ্ত ক্রয়াদেশ নেই।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com