নিউইয়র্ক টাইমসের রিপোর্ট
করোনা ভাইরাসের প্রথম ঢেউয়ের সময় এশিয়াজুড়ে যেসব গার্মেন্ট শ্রমিক কারখানা বন্ধ করে দেয়ায় বা চাকরিচ্যুত করায় কাজ হারিয়েছেন তাদের অনেকে এখনও নানা রকম বকেয়া পাওনা পুরোপুরি পাননি অথবা এমনও অনেকে আছেন, তারা বকেয়া পাওনার এক কানাকড়িও পাননি। এর মধ্যে রয়েছে কোম্পানিতে কাজ করার পর বিভিন্ন পাওনা হিসেবে যে টাকা দেয়া হয়- সেটা। তাদের দুর্দশা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী নিউইয়র্ক টাইমস একটি দীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এলিজাবেথ প্যাটনের লেখা ওই প্রতিবেদনে এসব শ্রমিকের অবর্ণনীয় দুর্দশার কথা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তিনি লিখেছেন, ভাঙা ভাঙা ফোন লাইনে বাংলাদেশের ৩৫ বছর বয়সী একজন পিতা আশরাফ আলী পরিবারের সদস্যদের মুখে খাবার যোগান দিতে পারেন না। এ কারণে তিনি মাঝে মাঝেই আত্মহত্যার কথা ভাবেন। একই অবস্থা কম্বোডিয়ার সোকুন্থিয়া ই’র। তিনি ঋণ নিয়ে বাড়ি নির্মাণ করেছেন। কিভাবে সেই ঋণ শোধ করবেন তা নিয়ে চিন্তায় নির্ঘুম রাত কাটান। ইন্দোনেশিয়ার ২৩ বছর বয়সী দিনা আরভিয়ার এলাকায় কোন কাজই নেই এখন। তিনি ভবিষ্যত নিয়ে হতাশায় ভুগছেন।
তারা সবাই একসময় গার্মেন্টে কাজ করতেন। নাইকি, ওয়ালমার্ট, বেনেটনের মতো বড় বড় কোম্পানির জন্য পোশাক ও জুতা প্রস্তুত করতেন। কিন্তু গত ১২টি মাস সেসব কাজ অদৃশ্য হয়ে গেছে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বড় বড় ব্রান্ডগুলো তাদের কার্যাদেশ বাতিল করেছে অথবা অর্ডারের বিপরীতে অর্থ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। এর ফলে করোনা মহামারিতে গণহারে কারখানা লেঅফ বা বন্ধ হয়ে গেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেশির ভাগ গার্মেন্ট শ্রমিক শোচনীয় মাত্রায় নি¤œ মজুরি পান। তাদের কারো স য় নেই বললেই চলে। এ জন্যই করোনা মহামারিকালে যাদেরকে কর্মচ্যুত করা হয়েছে তাদের বেশির ভাগেরই পাওনা বকেয়া রয়েছে। তা তিনি বিশ্বের যেপ্রান্তেই থাকুন না কেন। এর ফলে তাদের জীবনে দেখা দিচ্ছে চরম দারিদ্র্য। ওয়ার্কার রাইটস কনসোর্টিয়ামের নতুন একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, আশরাফ আলী, মিসেস ই এবং মিসেস দিনা’দের বকেয়া পাওনার সামান্য দেয়া হয়েছে অথবা মোটেও দেয়া হয়নি।
ওই রিপোর্টে ৯টি দেশের ৩১টি রপ্তানিমুখী গার্মেন্ট কারখানা শনাক্ত করা হয়েছে। সেখানে মোট ৩৭,৬৩৭ জন গার্মেন্ট শ্রমিককে পাওনা না দিয়ে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এই অর্থের পরিমাণ ৩ কোটি ৯৮ লাখ ডলার। ওয়ার্কার রাইটস কনসোর্টিয়ামের নির্বাহী পরিচালক স্কট নোভার মতে, গত বছর গণহারে বিশ্বে যে পরিমাণ তৈরি পোশাকের কারখানা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে তাদের রিপোর্টে তার শতকরা মাত্র ১০ ভাগ তুলে ধরা হয়েছে। ১৮টি দেশে আরো ২১০টি কারখানার ওপর তদন্ত করছে। ফলে রিপোর্টের লেখকরা অনুমান করছেন ২১৩টি কারখানার কমপক্ষে এক লাখ ৬০ হাজার শ্রমিক এমন বকেয়া পাওনা না পেয়ে দুর্ভোগে আছেন। তাদের পাওনার পরিমাণ হবে ১৭ কোটি ১৫ লাখ ডলার।
স্কট নোভা বলে, গার্মেন্ট শিল্পে শ্রমিকদের বকেয়া বেতন না দিয়ে তা গায়েব করে দেয়া একটি দীর্ঘদিনের সমস্যা। কিন্তু এই ধারা নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে গত বছর। তিনি আরো যোগ করেন, এর ফলে ক্ষতির পরিমাণ অনেক বৃদ্ধি পাবে। কারণ, করোনা মহামারির পরবর্তী আর্থিক ধাক্কা খুচরা বাজারে আরো সংকট এনে দিতে পারে। তিনি মনে করেন, এতে ৫০ কোটি ডলার থেকে ৮৫ কোটি ডলারের আয় হারিয়ে যেতে পারে। এই রিপোর্টের লেখকরা বলেছেন, এই সঙ্কটের একমাত্র বাস্তবসম্মত সমাধান হলো কথিত ‘সেভারেন্স গ্যারান্টি ফান্ড’ বা বকেয়া পাওনা পরিশোধের তহবিল সৃষ্টি করা। এই উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত আছে ২২০টি ইউনিয়ন ও অন্যান্য শ্রম অধিকার বিষয়ক সংগঠন। ফলে এই উদ্যোগের ফলে চুক্তিবদ্ধ ব্রান্ডগুলো বকেয়া পাওয়ানা পরিশোধে বাধ্য থাকবে। সেক্ষেত্রে কারখানা বা সরবরাহকারী কোনো বকেয়া না দিলেও শ্রমিকের ওপর খুব বড় প্রভাব পড়বে না।
এই করোনার মাঝেও কিছু প্রতিষ্ঠান লাভ করেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, অ্যামাজন তাদের রিপোর্টে উল্লেখ করেছে যে, ২০২০ সালে তাদের নিট লভ্যাংশ শতকরা ৮৪ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে ইন্ডিটেক্স আয় করেছে ১১৪০ কোটি ইউরো লভ্যাংশ। নাইকি, নেক্সট এবং ওয়ালমার্ট ভাল আয় করতে পারেনি। এ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত কিছু বিশ্লেষক মনে করেন, এই শিল্পের ‘পাওয়ার প্লেয়ারদের’ বড় ভূমিকা রয়েছে বকেয়া বেতন সঙ্কটে। বিশেষ করে তাদের চুক্তি বা পোশাক কেনার চর্চার মধ্যে সেই ভূমিকা আছে। বেশির ভাগ ফ্যাশন রেটেইলারের নিজস্ব কোন উৎপাদন কারখানা নেই। তারা এর পরিবর্তে বিভিন্ন দেশের কারখানার সঙ্গে চুক্তি করেন, যেখানে শ্রমশক্তি সস্তা। তারাই মূল্য নির্ধারণ করে দেয়। সরবরাহ কম বা বেশি হবে সেটা তারাই নির্ধারণ করে দেয়। ইচ্ছাকৃতভাবে তারা কারখানা পরিবর্তন করে অন্যস্থানে যেতে পারে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর কারখানা মালিকরা বলেন, তাদেরকে সর্বনি¤œ মার্জিনেই কাজ করতে বাধ্য করা হয়। এর ফলে তাদের খুব কম সংখ্যকই শ্রমিকদের ভাল মজুরি পারেন। নিরাপত্তায় বিনিয়োগ করতে পারেন না। এমনকি বকেয়া বেতন দিতে পারেন না।
ইংল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব শেফিন্ডের প্রফেসর জেনেভিব লেবারোন বলেন, এর দায় গিয়ে পড়ে সরবরাহকারীদের ওপর। আন্তর্জাতিক শ্রম অধিকার নিয়ে কাজ করা লেবারোন আরো বলেন, কিন্তু এর কারণ বৃহত্তর পর্যায়ে, সরবরাহ চেইনের। তাদের আচরণ তাদের সক্ষমতাই কারখানার ওপর বর্তায়। তিনি বলেন, অন্য রকম ক্ষতিপূরণের বিষয় যে পরিমাণে মনোযোগ পায়, বকেয়া বেতনের বিষয়টি সেই পরিমাণ মনোযোগ পায় না। তবে তা পাওয়া উচিত। যেসব শ্রমিক কাজ হারান তারা বিপন্ন হয়ে পড়েন। যখন তাদের পাওনা দেয়া না হয় তখন অনেকেই বেঁচে থাকার জন্য বেপরোয়া বা বিপজ্জনক পথ বেছে নেন।
বড় বড় সব ফ্যাশনের ব্রান্ডগুলো তাদের শ্রম অধিকার বিষয়ক আচরণবিধি প্রকাশ করে থাকে। তাদের বেশির ভাগই প্রতিশ্র“তি দেয় যে, সরবরাহকারীর সব শ্রমিকের সুবিধা আইনগতভাবে দিতে বাধ্য থাকবে তারা। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে কারখানা মালিকরা আত্মগোপনে চলে যেতে পারেন অথবা বরখাস্ত করা শ্রমিককে পাওনা দিতে অস্বীকৃতি জানাতে পারেন। অন্যদিকে কিছু মালিক আছেন যারা দাবি করেন, সঙ্কটজনক চুক্তির ফলে তারা ঋণখেলাপি হয়ে গেছেন অথবা রিজার্ভ ফান্ড ব্যবহার করে তাদের পক্ষে বকেয়া পাওনা দেয়া সম্ভব নয়। এর মাঝখানে আটকা পড়েন গার্মেন্ট শ্রমিকরা।
২০২০ সালের এপ্রিলে বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে বাংলাদেশে আশরাফ আলী ঢাকায় এ-ওয়ান কারখানায় নিটিং অপারেটর হিসেবে ১৭ বছর ধরে কাজ করছিলেন। এপ্রিল মাসে সেখান থেকে ১৪০০ শ্রমিককে ছাঁটাই করা হয়। তার কারখানায় উৎপাদিত পোশাক সরবরাহ দেয়া হয় বেনেটন এবং নেক্সট-এর মতো ব্রান্ডের কাছে। কিন্তু কারখানাটি তার শ্রমিকদেরকে শেষ মাসগুলোর বেতন দিতে বিলম্ব করে। এমনকি এখনও পর্যন্ত বকেয়া বেতন পরিশোধ করেনি। বাংলাদেশি আইনে প্রতি বছর প্রায় এক মাসের পাওনা প্রাপ্য হন শ্রমিকরা। সেই হিসেবে আশরাফ আলী পাবেন তিন লাখ ৫০ হাজার টাকা। তিনি চাকরিচ্যুতির পর থেকেই সাধারণ একজন নির্মাণ শ্রমিক থেকে শুরু করে যেকোনো একটি কাজ খুঁজে তা দিয়ে বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। আশরাফ আলি বলেন, এত মানুষ কাজ হারিয়েছেন যে তাতেই পরিস্থিতিকে এত বাজে করে তুলেছে। আমি বিশ্বাস করতে চাই যে, পাওনা টাকাটা পাবো। যদি সেটা পাই তাহলে আমার সবকিছু পাল্টে যেতো। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির সাবেক মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করেও কোনো উত্তর মেলেনি। পক্ষান্তরে ইমেইলে বেনেটন বলেছে এ-ওয়ান প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাদের বাণিজ্যিক মূল্যায়ন ছিল প্রান্তিক। তবে চাকরিচ্যুতির ফলে যে পাওনা পাবেন শ্রমিকরা সে বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তারা এর কোনো উত্তর দেয়নি।
ওদিকে নেক্সট-এর একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন, ওই কারখানাটি এর আগে সাবসিডিয়ারি ব্রান্ড লিপসি’র জন্য পোশাক তৈরি করতো। তাদের আচরণবিধিতে বলা হয়েছে, কখনো কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে বা লেঅফ করা হলে শ্রমিকদের পাওনা নিশ্চিত করা হবে। এ-ওয়ান শ্রমিকদের বকেয়া পাওনা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তখন আর তারা কোনো উত্তর দেয়নি। কারখানাগুলো থেকে এভাবে মজুরি, পাওনা ফাঁকি দেয়া নিয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমস যখন বেশির ভাগ ব্রান্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করে, তখন তারা তাদের সম্পর্কের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।
কম্বোডিয়ার ‘হানা আই’ কারখানা গত বছর জুনে লেঅফ ঘোষণা করা হয়। এই কোম্পানিটি ওয়ালমার্ট এবং জারা’র জন্য পোশাক তৈরি করতো। সেখানে ৭৭৪ জন শ্রমিক কাজ করতেন। তার মধ্যে মিসেস ই অন্যতম। কারখানা বন্ধ করে দেয়ায় শ্রমিকদের বিভিন্ন পাওনা হিসেবে বকেয়া রয়েছে ১০ লাখ ডলারের বেশি। প্রথম দিকে মিসেস ই পেয়েছিলেন মাত্র ৫০০ ডলার। এখনও তিনি চাকরির সুবাদে বিভিন্ন পাওনা হিসেবে পাবেন ১২৯০ ডলার। মিসেস ই এখনও কর্মহীন রয়েছেন। এর জবাবে জারা’র মূল কোম্পানি ইন্ডিটেক্স বলেছে, তারা ওই কারখানার সঙ্গে ৫ বছর ধরে কোনো কাজ করে না। ওয়ালমার্ট বলেছে, তারা মনে করে শ্রমিকদের পাওনা-দেনার সব অর্থ গত জুনে কারখানাটি পরিশোধ করেছে। এ বিষয়ে কারখানা মালিক কোনো প্রশ্নের উত্তর দেননি।
নমপেনে অ্যামাজন, ম্যাসি, এডিডাস ও ওয়াল মার্টের পোশাকের সাবেক সরবরাহকারী কারখানা হুলু গার্মেন্ট। এখানকার সাবেক এক হাজার শ্রমিক তাদের পাওনা হিসেবে এখনও পাবেন ৩৬ লাখ ৩০ হাজার ডলার। এডিডাস বলেছে, তারা ওই কোম্পানি থেকে শুধু ছোটখাট অর্ডার সম্পন্ন করতো। এ বিষয়ে হুলু গার্মেন্টসের মালিক কোনো উত্তর দেননি।
নিউ ইয়র্ক টাইমস যেসব কোম্পানির মুখোমুখি হয়েছে তার মধ্যে শুধু গ্যাপ বলেছে, তারা ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়া, ভারত ও জর্ডানের বিষয়ে রিপোর্টে যেসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে তা অনুসন্ধান করে দেখবে। গ্যাপ-এর একজন মুখপাত্র বলেন, সব ক্ষেত্রে আমরা নিশ্চিত যে, শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ করা হয়েছে। বা তাদের সুবিধা দেয়া হয়েছে। তা সত্ত্বেও যদি কোনো তথ্যপ্রমাণ থাকে তাহলে তা তদন্ত করে দেখবে কোম্পানি।