মহান আল্লাহ তায়ালা আলিমুল গায়েব, সব ঘটনার রহস্য জানেন। হজরত মূসা আ: ছিলেন এমন এক নবী যার সাথে মহান আল্লাহ সরাসরি কথা বলতেন। একদা হজরত মূসা আ: তার অনুসারীদের সাথে কথা বলছিলেন। তখন কোনো এক ব্যক্তি আল্লাহর নবীকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার অপেক্ষা কেউ বড় বিদ্যান আছে কি? উত্তরে হজরত মূসা আ: বললেন, ‘আমি জানি না। মূলকথা, হজরত মূসা আ:-এর উত্তরের ভাবধারা এমন ছিল যে, তিনি তার সময়ের সবচেয়ে বড় জ্ঞানী।
মহান আল্লাহ অন্তর্যামী। তিনি সবার মনের কথা জানেন। এমন অবস্থায়, হজরত মূসা আ:কে শিক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যে আল্লাহ তাকে হজরত খিজির আ:-এর কাছে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিলেন। হজরত খিজির আ:কে কোন স্থানে পাওয়া যাবে তার ঠিকানাও আল্লাহ হজরত মূসা আ:কে জানিয়ে দিলেন। মহান আল্লাহ হজরত মূসা আ:কে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, দুই সমুদ্রের সঙ্গমস্থলে হজরত খিজির আ:-এর সাক্ষাৎ পাওয়া যাবে। যাই-হোক, হজরত মূসা আ: তার একজন সঙ্গীসহ ওই স্থানে পৌঁছলে হজরত খিজির আ:-এর সাথে তার সাক্ষাৎ ঘটল।
সূরা কাহফের ৬৫ নং আয়াতে আল্লাহ পাক এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘অতঃপর ওরা সাক্ষাৎ পেল আমার দাসদের মধ্যে এক বান্দার যাকে আমি আমার কাছ থেকে অনুগ্রহ দান করেছিলাম।’ হজরত মূসা আ: তাকে বললেন, ‘সত্য পথের জন্য আমাকে শিক্ষা দেবেন’-এই শর্তে আমি আপনার অনুসরণ করব কি? হজরত খিজির আ: বললেন, ‘তুমি আমার সাথে ধৈর্য ধরে কখনোই থাকতে পারবে না। যা হোক, হজরত মূসা আ:-এর অনেক অনুরোধে হজরত খিজির আ: তাকে জ্ঞানদান করতে রাজি হলেন। তবে তিনি হজরত মূসা আ:কে বললেন, ‘আমার অনুসরণ করতে চাইলে কোনো ব্যাপারেই প্রশ্ন করো না, যতক্ষণ না আমি তা বলি।’ অতঃপর তারা যাত্রা শুরু করলেন। এই যাত্রাপথে পরপর তিনটি ঘটনা ঘটে যাতে শিক্ষণীয় অনেক কিছু আছে। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত এই তিনটি ঘটনা এখন একে একে উল্লেখ করছি-
প্রথম ঘটনা : নৌকা ছিদ্র করে দেয়া : সূরা কাহফের ৭১ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর ওরা যাত্রা করল, পরে ওরা নৌকায় আরোহণ করলে সে ওতে ছিদ্র করল’; মূসা বলল, ‘আপনি কি এর আরোহীদের ডোবাতে এতে ছিদ্র করলেন? আপনি তো অন্যায় কাজ করলেন।’ সে বলল, ‘আমি কি বলিনি যে, তুমি আমার সাথে ধৈর্য ধরতে পারবে না? (সূরা কাহফ-৭২)। মূসা বলল, আমার ভুলের জন্য অপরাধী করবেন না আর আমার ব্যাপারে কঠোর হবেন না।’ (সূরা কাহফ-৭৩)।
দ্বিতীয় ঘটনা : বালক হত্যা : এরপর তারা আবার পথ চলতে লাগলেন। তাদের যাত্রাপথে এক বালকের সাথে সাক্ষাৎ হলে, খিজির আ: ওকে হত্যা করল। মূসা আ: বললেন, ‘হত্যার অপরাধ ছাড়াই এক নিষ্পাপ জীবন নাশ করলেন।’ খিজির আ: বললেন, ‘আমি কি বলিনি তুমি ধৈর্য ধরে থাকতে পারবে না।’ মূসা বললেন, ‘এরপর যদি আমি আপনাকে কোনো প্রশ্ন করি, তবে আমাকে সাথে রাখবেন না।’
তৃতীয় ঘটনা : প্রাচীর নির্মাণ : ইতঃপূর্বে বর্ণিত দ্বিতীয় ঘটনার পর তারা আবার পথচলা শুরু করলেন। অবশেষে তারা এক জনপদে পৌঁছলেন। তারা জনপদের অধিবাসীদের কাছে খাদ্য চাইলেন, জনপদবাসী তাদের আতিথেয়তা করতে অস্বীকার করল। পরে তারা সেখানে পতনোন্মুুখ এক প্রাচীর দেখলে হজরত খিজির আ: তা মেরামত করে ছিলেন। মূসা আ: বললেন, ‘ইচ্ছা করলে এর জন্য পারিশ্রমিক নিতে পারতেন।’ খিজির আ: বললেন, ‘এখানেই আমাদের সম্পর্ক শেষ হলো। তবে যে বিষয়ে তুমি ধৈর্য ধরতে পারনি, আমি তার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করছি।’
খিজির আ:-এর উত্তর : উপরোল্লিখিত তিনটি ঘটনা ঘটার পর হজরত মূসা আ:-এর সাথে হজরত খিজির আ:-এর সাক্ষাৎপর্ব শেষ হলো। তবে তারা দু’জন বিচ্ছিন্ন হওয়ার আগে হজরত খিজির আ: ইতোমধ্যে ঘটে যাওয়া তিনটি ঘটনার তাৎপর্য হজরত মূসা আ:কে জানিয়ে দিলেন। সেগুলো এখন নিচে উল্লেখ করা হলো-
প্রথমত, নৌকাটি ছিল কিছু গরিব মানুষের। এর দ্বারা তারা সমুদ্রে জীবিকা অন্বেষণ করত। খিজির আ: এই কারণে নৌকাটিকে ত্রুটিযুক্ত করলেন যে, সেখানে এমন এক রাজা ছিলেন, সে বলপ্রয়োগ করে ভালো নৌকা ছিনিয়ে নিত।’ (সূরা কাহফ-৭৯)।
দ্বিতীয়ত, কিশোর বালকটিকে হত্যা করার তাৎপর্য হচ্ছে- ওই কিশোরটির বাবা-মা ছিলেন বিশ্বাসী। খিজির আ: আল্লাহর হুকুমে বুঝতে পেরেছিলেন যে, কিশোরটি ভবিষ্যতে অবাধ্য ও অবিশ্বাসী হবে এবং তার বাবা-মাকে বিব্রত করবে। আল্লাহ ওই বাবা-মাকে ভবিষ্যতে এমন এক সুসন্তান দান করবেন যে হবে পবিত্র ও যার মধ্যে থাকবে ভক্তি ও ভালোবাসা। (সূরা কাহফ : ৮০-৮১)। তৃতীয়ত, প্রাচীরটির মালিক ছিল ওই নগরের দুইজন পিতৃহীন কিশোর। ওই প্রাচীরের নিচে ছিল ওদের নেককার বাবার রেখে যাওয়া গুপ্তধন। আল্লাহ দয়াপরবশ হয়ে ইচ্ছা করলেন যে, কিশোররা বয়োপ্রাপ্ত হয়ে ওই ধনভাণ্ডার… উদ্ধার করবে। কিন্তু প্রাচীরটি ধসে পড়লে লুক্কায়িত ধনভাণ্ডার উন্মুক্ত হয়ে যেত এবং হয়তো এতিম অসহায় বালক দু’টির জন্য রেখে যাওয়া ধনভাণ্ডার লুণ্ঠিত হয়ে যেত। খিজির আ: আরো বললেন, তিনি নিজ থেকে কিছু করেননি। অর্থাৎ, এর ব্যাখ্যা হলো- আল্লাহর হুকুম ও ইচ্ছাতেই তিনি এসব করেছেন। আর এসব বিষয়ের জ্ঞান মহান আল্লাহ হজরত খিজির আ:কে দিয়েছিলেন, যা জানার জন্য হজরত মূসা আ: বারবার প্রশ্ন করছিলেন ও ধৈর্য ধারণ করতে পারছিলেন না। (সূরা কাহফ-৮২)।
এখানে বলে রাখি যে, পবিত্র কুরআনের সূরা কাহাফের ৬০ নং আয়াত থেকে ৮২ নং আয়াত পর্যন্ত হজরত মূসা আ: ও হজরত খিজির আ:-এর সাক্ষাতের ঘটনাটি বর্ণনা করা হয়েছে। এই ঘটনাগুলোর মাধ্যমে এই শিক্ষাই পাওয়া যায় যে, পৃথিবীতে যা কিছুই ঘটুক না কেন তার পশ্চাতে আছে মহান আল্লাহর হুকুম ও ইচ্ছা। আমরা মানুষ যে ঘটনাটি ভালো বলি বা মন্দ বলি তার চূড়ান্ত পরিণতি হয়তো তা নাও হতে পারে। মানুষের দৃষ্টিতে কেন মন্দ ঘটনা ঘটছে তার উপযুক্ত জবাব আল্লাহই জানেন। মানুষের দৃষ্টিতে ভালো ঘটনার পেছনেও কী রহস্য আছে তার উত্তরও মহান আল্লাহই জানেন। এগুলো আল্লাহ মানুষকে না জানালে মানুষ তা জানতে পারে না। অর্থাৎ মহান আল্লাহই সব জ্ঞানভা-ারের মালিক, মানুষ নয়। আর মানুষের দৃষ্টিতে ভালো-মন্দ যে ঘটনাই ঘটুক না কেন, তাতে ধৈর্যধারণ করা উচিত। লেখক : অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়