১৮ এপ্রিল সৌদি অ্যারাবিয়ান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে সৌদি আরব যাওয়ার কথা ছিল নোয়াখালীর আজগর আলীর। স্বাভাবিক সময় হলে তিনি নিজ জেলা থেকে করোনা টেস্ট করে সরাসরি চলে যেতেন বিমানবন্দরে। কিন্তু লকডাউনে বিশেষ ফ্লাইট হওয়ায় তাকে টিকিট রি-ইস্যু করতে ঢাকায় সৌদি এয়ারলাইন্সের অফিসে আসতে হয়েছে। এখন তিনি ফ্লাইট পেয়েছেন ২০ এপ্রিলে। ঢাকায় পরিচিতি কেউ না থাকায় উঠেছেন নারায়ণগঞ্জে আত্মীয়ের বাসায়। ছুটিতে এসে প্রায় ১৭ মাস দেশে আটকে থেকে ঋণগ্রস্ত আজগর আলী কাজে ফিরতে ভিসা পেয়েছেন কিছুদিন আগে। লকডাউনে ঢাকায় আসা, থাকার ব্যবস্থা করার দুর্ভোগের পাশাপাশি তাকে খরচ করতে হয়েছে অতিরিক্ত ৩০ হাজার টাকা। শুধু আজগর আলী নয়, এমন ভোগান্তি বিশেষ ফ্লাইটে যাওয়া প্রায় সকল প্রবাসীর।
লকডাউনে ১৪ থেকে ২০ এপ্রিল আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধ করায় প্রবাসী কর্মীদের কাজে ফেরার অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। পরবর্তীতে দাবির মুখে ৫টি দেশে ১২টি এয়ারলাইন্সের মাধ্যমে বিশেষ ফ্লাইটে প্রবাসী কর্মীদের কর্মস্থলে ফেরার ব্যবস্থা করে সরকার। বিশেষ ফ্লাইটের কারণে ৫ দেশের প্রবাসী কর্মীদের কর্মস্থলে ফেরার সুযোগ সৃষ্টি হলেও ভোগান্তি বাড়িয়েছে প্রবাসীদের। প্রবাসী কর্মীদের কর্মস্থলে ফেরার বিষয়টি বিবেচনা নিয়ে লকডাউনে প্রবাসী কর্মীদের জন্য স্বাভাবিক ফ্লাইটের ব্যবস্থা রেখে সিদ্ধান্ত নিলে এমন ভোগান্তিতে পড়তে হতো না ।
ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল ইসলাম হাসান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, প্রথমত সকল আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধ করা ভুল সিদ্ধান্ত। কোন দেশ তো আমাদের জন্য নিষেধাজ্ঞা দেয়নি, আমরা সব বন্ধ করে দিলাম। এখন বিশেষ ফ্লাইট দিয়ে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চলছে, কিন্তু সমন্বয় নেই।
হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৭৮৫ টি ফ্লাইটে বিদেশ গিয়েছেন ১ লাখ ২৩ হাজার ৯৫১ জন। ফেব্র“য়ারিতে ৮২৯টি ফ্লাইটে ১ লাখ ৪৬ হাজার ২৭৪ জন। মার্চে ১গ৭৮টি ফ্লাইটে ২ লাখ ১ হাজার ১৫৬জন বিদেশে গিয়েছেন। অন্যদিকে জানুয়ারিতে দেশে এসেছেন ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫৯৯ জন। ফেব্র“য়ারি এসেছেন ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫২৭ জন। মার্চে দেশে এসেছেন ১ লাখ ৪৮ হাজার ৯৮০ জন।
মোহাম্মদ ইকবাল শান্ত কাতার প্রবাসী । ১৭ এপ্রিল তার ভিসার মেয়াদ শেষ হয় আর ১৪ এপ্রিল তার কাতারে ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু লকডাউনে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধ হওয়ায় তার ফেরত যাওয়া হয়নি। এখন ভিসার মেয়াদ বাড়াতে না পারলে বেকার হতে হবে এই প্রবাসীকে। মোহাম্মদ ইকবাল শান্ত বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ২০২০ সালে ফেব্র“য়ারিতে দেশে আসছিলাম। নানা জটিলতায় কাজে ফিরতে পারিনি। এখন যখন সব ঠিকঠাক হলো, সরকার আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধ করে দিয়ে সব শেষ করে দিলো। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, কাতার ও সিঙ্গাপুর- এই ৫ দেশের প্রবাসীদের কাজে ফেরাতে ১৭ এপ্রিল থেকে বিশেষ ফ্লাইট অনুমতি দেয় সরকার। এসব দেশে শুধু মাত্র প্রবাসী কর্মীরা যেতে পারবেন। আর এই ৫ দেশে ফ্লাইট পরিচালনার জন্য ১২টি এয়ারলাইন্স অনুমতি পেয়েছে। ১২টি এয়ারলাইন্স হচ্ছে, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্স, সৌদি অ্যারাবিয়ান এয়ারলাইন্স, ওমান এয়ার, সালাম এয়ার, কাতার এয়ারওয়েজ, এমিরেটস, ইতিহাদ, এয়ার অ্যারবিয়া, এয়ার অ্যারাবিয়া আবুধাবি, ফ্লাই দুবাই ও সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স।
প্রবাসী কর্মীদের কর্মস্থলে ফেরানোর উদ্যোগ প্রথম দিনেই ধাক্কা খায়। ১২টি এয়ারলাইন্সের ১৪টি ফ্লাইটের মধ্যে কমপক্ষে ৭টি ফ্লাইট বাতিল হয়। লকডাউনের মধ্যে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিমানবন্দরে এসে প্রবাসীরা জানাছেন ফ্লাইট বাতিল হয়েছে। ১৭ এপ্রিল বিমান বাংলাদেশে এয়ারলাইন্সের রিয়াদগামী ফ্লাইট (বিজি৫০৩৯) সকাল ৬টা ১৫ মিনিটে ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিল। এ কারণে এয়ারলাইন্সের নির্দেশনা অনুসারে ৬ ঘণ্টা আগে রাত ১টার মধ্যেই হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসেছিলেন যাত্রীরাও। ফ্লাইটটি বাতিল হলে ক্ষুব্ধ হয়ে সেদিন রাতে প্রবাসী কর্মীরা বিক্ষোভ করেন হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে।
সিঙ্গাপুর তালিকায় থাকলেও সিঙ্গাপুরের প্রবাসী কর্মীরা পড়েছেন সবচেয়ে বেশি বিপাকে। অনুমতি পেলেও এখন পর্যন্ত কোনও ফ্লাইট পরিচালনা করেনি সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স। অন্যদিকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ১৭ থেকে ২০ এপ্রিলের মধ্যে মাত্র একটি ফ্লাইট পরিচালনা করবে। এ কারণে অসহায়ের মতো বিমানবন্দরে রবিবার (১৮ এপ্রিল) সারাদিন দাড়িয়ে মানববন্ধন করেছেন সিঙ্গাপুর প্রবাসীরা। হন্যে হয়ে বিমান, ট্রাভেল এজেন্সির অফিসে ছুটেছেন টিকিটের আশায়। কুমিল্লার গাজী হান্নান সিঙ্গাপুর প্রবাসী। ছুটিতে এসে গত এক বছর ধরে দেশে আটকা পড়ে আছেন। তারা ভিসার মেয়াদ শেষ হবে এ মাসেই। কিন্তু হন্য হয়ে ঘুরেও কোন টিকিট পাচ্ছেন না। গাজী হান্নান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, বিমানের অফিসে গিয়েছিলাম, অনুরোধ করেছি কিন্তু তারা বলছে টিকিট নাই। আমরা কার কাছে যাবো, আমাদের কথা শোনার মতো কেউ কি আছে? ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি পাওয়া এয়ারলাইন্সের তালিকায় রয়েছে এয়ার অ্যারবিয়া। তবে ১৭ থেকে ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত তারা কোন ফ্লাইট পরিচালনা করেনি। ফলে এই এয়ারলাইন্সের টিকিট কাটা যাত্রীরা আছেন অনিশ্চয়তায়।
সৌদি প্রবাসী আরমান পাটওয়ারী রিটার্ন টিকিট কেটেছিলেন শ্রীলঙ্কান এয়ারলাইন্সের। কিন্তু অনুমতি পাওয়া ১২টি এয়ারলাইন্সে তালিকায় নেই এই এয়ারলাইন্স। ফলে ১৪ এপ্রিল তার সৌদি ফিরে যাবার কথা ছিল। কিন্তু লকডাউনে ফ্লাইট বন্ধ হওয়ায় আটকা পড়েছেন তিনি। এখন অনুমতি পাওয়া এয়ারলাইন্স থেকে নতুন করে টিকিট কাটা ছাড়া তার ফেরত যাওয়ার কোনও পথ খোলা নেই। একদিনে পুরাতন টিকিট বাতিল অন্য দিকে নতুন টিকিট কেনার খরচ। এদিকে এই ৫ দেশের বাইরে যেসব দেশে প্রবাসীরা আছেন তারা জানেন না কবে তারা কাজে ফিরতে পারবেন। আমেরিকা প্রবাসী আবু মোশাররফ ২৪ এপ্রিল দেশে ফেরার টিকিট কেটে রেখেছেন। এখন তিনি অনিশ্চয়তায় আদৌ তার দেশে ফেরা হবে কি না।-বাংলাট্রিবিউন