কোটা সংস্কার আন্দোলনের পেছনে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা আছে কি না, তা নিয়ে কাজ করছে পুলিশ। গ্রেপ্তার হওয়া ছাত্রনেতাদের জিজ্ঞাসাবাদ, বিভিন্নজনের সঙ্গে তাঁদের মুঠোফোনে যোগাযোগ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন অ্যাপ ও গ্রুপের কথোপকথন (চ্যাট), অর্থের উৎস ইত্যাদির তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।
এই আন্দোলনে বিএনপি-জামায়াত বা তাদের ছাত্রসংগঠনগুলোর উসকানি রয়েছে বলে ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে। সম্প্রতি বিভিন্ন মামলায় কোটা আন্দোলনের অন্তত ১০ জন নেতাকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, তারাও মামলার তদন্তে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার দিকটি গুরুত্ব দিয়েই খতিয়ে দেখছে। তবে এখন পর্যন্ত জোরালো কোনো রাজনৈতিক যোগসাজশের তথ্য তাদের হাতে আসেনি বলে সূত্র জানিয়েছে।
সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে গত এপ্রিলে ঢাকাসহ সারা দেশে ব্যাপক বিক্ষোভ দেখায় বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা। গত ৮ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে জড়ো হওয়া আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে রাতভর সংঘর্ষ হয় পুলিশের। বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্যের বাসভবনে নজিরবিহীন তাণ্ডব চালানো হয় সেই রাতে। ওই সব ঘটনায় শাহবাগ থানায় পৃথক তিনটি মামলা করে পুলিশ। আড়াই মাস পর কোটা আন্দোলনের নয়জন নেতাকে সেই সব মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ওই নয়জনের মধ্যে আটজনই গ্রেপ্তারের আগে ছাত্রলীগ কর্মীদের মারধরের শিকার হয়েছেন। কাউকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা মোটরসাইকেলে থানায় পৌঁছে দিয়েছেন।
আর কোটা আন্দোলনের অন্যতম যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খানকে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে দায়ের করা একটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিট। সেই মামলাটিও দায়ের করেছেন ছাত্রলীগের আইন সম্পাদক আল নাহিয়ান খান।
শাহবাগ থানার পুলিশ ও সাইবার ক্রাইম ইউনিটের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে এসব মামলার তদন্ত নিয়ে কথা হয়েছে। শাহবাগ থানার পুলিশ জানিয়েছে, ডিবির কর্মকর্তারা তাঁদের তদন্তে সাহায্য করছেন। কর্মকর্তারা বলেন, মূলত গ্রেপ্তার হওয়া ছেলেদের কেউ কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রয়েছেন কি না, এসব বিষয়ে তথ্য নেওয়া হচ্ছে। তবে তাঁদের অনেকের বিষয়েই পুলিশের কাছে আগে থেকে কিছু তথ্য রয়েছে। সেগুলোও মিলিয়ে দেখা হচ্ছে। আন্দোলনের সময় সরকারবিরোধী কোনো রাজনৈতিক পক্ষ এঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বুদ্ধি-পরামর্শ বা অর্থসাহায্য করেছিল কি না, সেসবও জানার চেষ্টা করছে পুলিশ।
এদিকে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে গ্রেপ্তার হওয়া রাশেদ খানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত করছে সাইবার ক্রাইম ইউনিট। পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। সাইবার ক্রাইম ইউনিটের দুজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা রাশেদ খানের দেওয়া তথ্য খতিয়ে দেখছেন। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন বামপন্থী ছাত্রসংগঠন ও ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের বিভিন্ন সময়ে কথাবার্তা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে রাশেদও এমন তথ্য দিয়ে বলেছেন, যৌক্তিক আন্দোলনে সব শিক্ষার্থীর সহায়তাই তাঁরা চেয়েছেন। তবে আন্দোলনের সব সিদ্ধান্ত ছাত্র অধিকার সংরক্ষণের নেতারা বসে নিয়েছেন।
রাশেদের মুঠোফোন যোগাযোগ, বিভিন্ন অ্যাপ ও গ্রুপের কথোপকথন, অর্থের উৎসও খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানা গেছে। তবে এখন পর্যন্ত বলার মতো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি।
একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, রাশেদ খান যুক্ত আছেন-এমন বেশ কয়েকটি ফেসবুক ক্লোজড গ্রুপের কথোপকথন তাঁরা খতিয়ে দেখেছেন। এই ছেলে-মেয়েদের প্রায় ৩০টি মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টের লেনদেনও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। গত এপ্রিলে আন্দোলন তুঙ্গে থাকার সময় খরচ নির্বাহের জন্য এই অ্যাকাউন্টগুলো খোলা হয়েছিল। এগুলোর নম্বর দিয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনের ফেসবুক গ্রুপে অর্থ সহযোগিতা চেয়ে পোস্ট দেওয়া হয়েছিল। সেই নম্বরগুলোতে টাকা ঢুকেছে। যার অঙ্ক বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ১০০ থেকে ১ হাজার টাকার মধ্যে। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলনে যুক্ত শিক্ষার্থীরাই এ টাকা পাঠিয়েছেন বলে জিজ্ঞাসাবাদে রাশেদ তথ্য দিয়েছেন।
রাশেদের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটের উপকমিশনার আনিসুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর কাছ থেকে অনেক তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। কোটা আন্দোলনের সঙ্গে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা বা ইন্ধনের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘বহু তথ্য পাচ্ছি। সেগুলো যাচাই করা হচ্ছে। এমন কোনো বিষয়ে এখনই মন্তব্য করা যাবে না।’
ফেসবুক লাইভে প্রধানমন্ত্রীর মানহানি ঘটানোর অভিযোগে রাশেদের বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় তথ্যপ্রযুক্তি আইনে মামলাটি করা হয়। এরপর ভাষানটেকের শ্বশুরবাড়ি থেকে রাশেদকে গ্রেপ্তার করা হয়।
কোটা আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দাবি করেছেন, গত শনিবার রাতে রাশেদের সঙ্গে একই বাড়িতে ছিলেন মাহফুজ নামে আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত একজন। রাশেদকে গ্রেপ্তারের পর থেকে মাহফুজের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি জসীমউদ্দীন হলের আবাসিক ছাত্র, বাড়ি গাজীপুর।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা সবাই সুনির্দিষ্ট কারণে গ্রেপ্তার হয়েছেন। কেউ ভিসির বাড়ি ভাঙার জন্য, আবার কেউ তথ্যপ্রযুক্তি আইনে গ্রেপ্তার হয়েছেন। এই আন্দোলনকারীদের সঙ্গে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া গেছে কি না, জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের পুলিশ, গোয়েন্দারা তদন্ত করছেন। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে আমরাও উড়ো উড়ো কিছু শুনছি। তবে বিস্তারিত তদন্ত করে বের করা হবে।’
আন্দোলনকারীরা ‘বাশি’
এদিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এম আবদুস সোবহান কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের বাম ঘরানার শিবির শিক্ষার্থী বা ‘বাশি’ বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের আমাদের কতিপয় সহকর্মী পর্দার আড়ালে থেকে কোটাবিরোধী আন্দোলনের নামে শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করছেন, উসকানি দিচ্ছেন, এটা আমরা জানতে পেরেছি। বলা হচ্ছে যারা আন্দোলন করছে, তারা প্রগতিশীল। আসলে তারা বাম ঘরানার শিবির শিক্ষার্থী। যেটাকে সংক্ষেপে বলা যায় “বাশি”। কোটা আন্দোলনের নামে তারা সরকারকে উৎখাত করার চেষ্টা করছে।’
রাজশাহী থেকে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, গতকাল শুক্রবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬৫ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে তিনি এ মন্তব্য করেন।