রমজান হলো ইসলামী ক্যালেন্ডারের নবম মাস। এটি ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের অন্যতম। এ মাসের লাইলাতুল কদরে সর্ব প্রথম মুহাম্মদ সা:-এর ওপর কুরআন মাজিদ নাজিল হয়। এক নতুন চাঁদ উদয় থেকে শুরু হয়ে আরেক নতুন চাঁদের উদয় পর্যন্ত ২৯ বা ৩০ দিন এ সিয়াম পালন করা হয়।
সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সাওম পালন করা প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স্ক মুসলিমের ওপর ফরজ। তবে যারা গুরুতর বা ক্রোনিক রোগে ভুগছেন, সফরে আছেন, অতিশয় বয়স্ক, সন্তান সম্ভবা, দুগ্ধদায়িনী ও রজকালীন নারী তাদের জন্য সওম পালনের পরিবর্তে ফিদিয়া দান এবং পরে সমসংখ্যক সাওম পালনের অবকাশ রয়েছে।
রমজানে ভালো কাজের সওয়াব বহু গুণ বৃদ্ধি করে দেয়া হয়। সাওম পালনকালে মুসলিমরা পানাহার, মাদক গ্রহণ, যৌনাচার এবং সব ধরনের পাপাচার থেকে বিরত থাকেন। এ মাসে রোজাদাররা সালাত, কুরআন তিলাওয়াত ও দান-সদকাহর মাধ্যমে আত্মিক শুদ্ধতা ও তাকওয়া অর্জনে সচেষ্ট থাকেন।
সাওম ফরজ করার লক্ষ্য : রমজান মাসব্যাপী সিয়াম সাধনা ফরজ করার লক্ষ্য হলো তাকওয়া অর্জন করাÑ মুত্তাকি হওয়া, যা সূরা বাকারার ১৮৩ নম্বর আয়াত থেকে আমরা জানতে পারছি। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও পাপকাজ হতে বিরত থাকল না তার পানাহার বর্জনে আল্লাহর কোনো দরকার নেই। (বুখারি)
মেরু অঞ্চলে সিয়াম পালন ও সালাত আদায় : সৌর জগতের সাধারণ নিয়মানুযায়ী গ্রীষ্ম ও শীতকালে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে দিবারাত্রির দৈর্ঘ্য বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। এর ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশের মুসলমানরা রমজান মাসে অঞ্চল ভেদে ১১ ঘণ্টা থেকে ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত রোজা পালন করে থাকেন। কিন্তু মেরু অঞ্চলে সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ের দৈর্ঘ্য গ্রীষ্ম কালে ২২ ঘণ্টারও বেশি হয়ে যায়। যেমনÑ ২০১৪ সালে আইসল্যান্ডের রাজধানী রিকজাভিক ও সেন্ট্রাল নরওয়ের ট্রনডাইম অঞ্চলের মুসলমানদের রোজা রাখতে হয়েছিল প্রায় ২২ ঘণ্টা। একই বছর সিডনির মুসলমানরা রোজা রেখেছেন মাত্র ১১ ঘণ্টা। আবার এমনও ভৌগোলিক অঞ্চল রয়েছে যেখানে ২৪ ঘণ্টাই রাত অথবা দিন থাকে।
এ ধরনের নিশীথ সূর্যের দেশ বা মেরু অঞ্চলের অধিবাসী মুসলিমদের সাওম পালন ও সালাত আদায়ের জন্য দুই রকম ফতওয়া রয়েছে। কারো মতে, তাঁরা সাওম পালনে ও সালাত আদায়ে ভৌগোলিকভাবে নিকটতম অঞ্চলকে অনুসরণ করবেন যেখানে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত ঘটে তথা রাত ও দিনের মধ্যে পার্থক্য করা যায়। কারো মতে, সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তবিহীন অঞ্চলের অধিবাসী মুসলিমরা সাওম পালন ও সালাত আদায়ে পবিত্র নগরী মক্কার সময়সূচি অনুসরণ করবেন।
মহাকাশে সিয়াম পালন ও সালাত আদায় : আমরা জানি, অন্যান্য ধর্মের অনুসারী ও নাস্তিক এস্ট্রোনটদের পাশাপাশি এ যাবৎ ১১ জন মুসলিম নভোচারীও মহাকাশ ভ্রমণের সৌভাগ্য অর্জন করেছেন। এদের মধ্যে ১০ জন পুরুষ ও একজন নারী। তাঁরা হলেনÑ সুলতান বিন সালমান আল-সৌদ (সৌদী আরব, ১৯৮৫), মুহাম্মাদ ফারিস (সিরিয়া, ১৯৮৭), মূসা মানারভ (আজারবাইজান, ১৯৮৭ ও ১৯৯০), আবদুুল আহাদ মুহাম্মাদ (আফগানিস্তান, ১৯৮৮), আক্তার আবাকিরভ (কাজাখস্তান, ১৯৯১), তালগাত মূসাবায়েভ (কাজাখস্তান, ১৯৯৪, ১৯৯৮ ও ২০০১), সালিজান শারিপভ {রাশিয়া (জন্ম : কিরগিজিস্তান), ১৯৯৮ ও ২০০৪}, আনুশেহ আনসারী (মহিলা) {যুক্তরাষ্ট্র (জন্ম : ইরান), ২০০৬}, শেখ মুজাফফর শুকুর (মালয়েশিয়া, ২০০৭), আইদ্বীন আইম্বেতভ (কাজাখস্তান, ২০১৫), হাজ্জাজ আল-মানসূরি (সংযুক্ত আরব আমিরাত, ২০১৯)।
প্রশ্ন হলো, নভোচারীরা মহাকাশে অবস্থানকালে রমজান মাস শুরু হয়- তাহলে কিভাবে রোজা রাখবেন? রোজা কখন শুরু করবেন, কখন ছাড়বেন? সালাতই বা কিভাবে আদায় করবেন? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য মালয়েশিয়ার মহাকাশ সংস্থা অহমশধংধ ২০০৬ সালে মুসলিম মহাকাশ বিজ্ঞানীদের একটি সম্মেলন আয়োজন করে। এতে অংশ নেন ১৫০ জন বিজ্ঞানী ও ইসলামী স্কলার। সম্মেলনের আলোচ্য বিষয় ছিল- মহাকাশচারীরা কিভাবে সালাত আদায় করবেন ও সাওম পালন করবেন? ওই সম্মেলনের সিদ্ধান্তের আলোকে ও মালয়েশিয়ার ন্যাশনাল ফতোয়া কাউন্সিলের অনুমোদন ক্রমে ২০০৭ সালে একটি নির্দেশনা জারি করা হয়। এর শিরোনাম ছিল- A Guideline for Performing Ibadah at the International Space Stations.
ওই গাইডলাইনের ফতোয়া অনুযায়ী মুসলিম নভোচারীরা পৃথিবী গ্রহে তাদের সর্বশেষ অবস্থান স্থলের টাইম জোনের ভিত্তিতে নামাজ ও রোজার সময়সূচি নির্ধারণ করে নেবেন। যেমন- যদি মালয়েশিয়ার কোন নভোচারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার Kennedy Space Center থেকে উড্ডয়ন করেন তাঁর সর্বশেষ অবস্থান স্থল হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা। ফলে তিনি সাহরি খাবেন ও ইফতার করবেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার সময় অনুসারে।
উল্লেখ্য, ফ্লোরিডা ভৌগোলিকভাবে Eastern Standard Time Zone-এর অন্তর্ভুক্ত। এই টাইম জোনে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের যে সময় তাই হবে মালয়েশীয় নভোচারীর সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময়। এই সময় ধরেই তিনি সিয়াম পালন করবেন এবং সালাত আদায় করবেন। Eastern Time Zone (ET)-এর আওতাভুক্ত অঞ্চলসমূহ হলো যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বাঞ্চলীয় ২২টি স্টেট, কানাডার পূর্বাঞ্চল, মেক্সিকোর কুইনতানারু অঞ্চল, পানামা, কলম্বিয়া, পেরু, ইকুয়েডর, ব্রাজিলের পশ্চিমাঞ্চল এবং কিছু ক্যারিবীয় ও আটলান্টিক দ্বীপ।
লেখক : সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার, পূবালী ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকিং