মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:০৭ পূর্বাহ্ন

নিজের ভাগ্য পরিবর্তনের কারিগর হাছিনা বেগম

লিহাজ উদ্দীন মানিক বোদা (পঞ্চগড়) :
  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ১৮ মে, ২০২১

হাছিনা বেগম পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার হাজরাডাঙ্গা আঠারোগ্রামে বাবার বাড়ি। এক ভাই এক বোন হাছিনাই বড়। তাঁর নানার কোন ছেলে না থাকায় তাদের সাথে এসেই থাকতেন নানা নানী। তার বাবা মা কৃষির উপরই জীবন যাপন করে। হাছিনা তখন সবে স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছে। তার নানা বার্ধক্যজনিত কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েন। মৃত্যুপথযাত্রী মানুষটি হঠাৎ এক আবদার করে বসেন তিনি নাতি জামাই দেখে যেতে চান। পাত্র খোঁজার কাজ শুরু হয়। এর মধ্যে সে খালার বাড়ি ঘুরতে যায় পার্শ¦বর্তী বোদা উপজেলার চন্দনবাড়ি ইউনিয়নের কুমারপাড়ায়। সেখানে তাকে দেখে একটি পরিবার বিয়ের প্রস্তাব দেয়। ২০০৯ সালে কুমারপাড়ার আবুল হোসেনের সাথে বিয়ে হয় তার। বাল্যবিবাহের কবলে পড়ে পড়াশোনাটাও আর হলোনা। বিয়ের মাস ছয়েক পরেও নানা আফসার মন্ডল মারা যান। বিয়ের পর শ্বশুড় বাড়িতে চলে আসেন। তাদের বাড়ির ভিটা ছিল না অন্যের জমিতে থাকতো। ঠিকঠাক খেতে পারতেন না তিনবেলা এক বেলা খেতেন এক বেলা অনাহারে থাকতেন। কাপড় চোপড়েরও কষ্ট ছিল। বিয়ের এক বছর পর তিনি বুঝতে পারেন তাকেও কিছু একটা করতে হবে। বাবার বাড়িতে থাকতে মায়ের সাথে হাঁস-মুরগী, গরু ছাগল পালনের অভিজ্ঞতা আছে তার। সেই সাথে মায়ের মত করে নকশি কাঁথা সেলাইয়ের কাজটুকুও শিখেছিলেন। একটি কাঁথা সেলাই করলে পাঁচশত টাকা পাওয়া যায়। যেই ভাবা সেই কাজ। শুরু করলেন গরু এবং ছাগল পালন। নিজের নয় বর্গা নিয়ে। এরপর হাঁস-মুরগীও করলেন আস্তে আস্তে কাঁথা সেলাইয়ের টাকায়। বর্গা (আদি) নেয়া গরু এবং ছাগল থেকে নিজের গরু এবং ছাগল হলো। এভাবেই একটু একটু করে স্বচ্ছলতার মুখ দেখলেন তিনি। হাঁস-মুরগী, গরু-ছাগল পালন করে দুই বছর আগে নিজেদের জন্য জায়গা নিয়েছেন। তারপর সেখানে নতুন বাড়ি করেছেন। সেখানেও পশু পালনের মাধ্যমে আবার জমিও ইজারা নিয়েছেন প্রায় দেড় বিঘা। স্বামী স্ত্রী দুজনই সমান ভাবে পরিবারের উন্নতির জন্য কাজ করছেন। বাড়ির উঠানে ও ক্ষেতে আলু, রসুন, পিঁয়াজ, নাপা শাক, লাউ,সিমসহ নানা ধরনের সবজি চাষ তিনি করেছেন। সেগুলো থেকে নিজের খাওয়া হয় আবার বিক্রিও করা যায়। বাড়ির চারদিকে বিভিন্ন ফলের গাছ এবং সুপারির গাছ লাগিয়েছেন সারি সারি। শুধুমাত্র সুপারির চারা বিক্রি করেই হাসিনা বছরে আয় করেন দশ হাজার টাকার উপরে। স্বামী বাইরে কাজ করে আর সে বাড়িতে এবং নিজেদের করা ফসলের আবাদে নিজেই পরিশ্রম করেন। শ্বশুড় শ্বাশুড়ী এবং একটা ছোট্ট মেয়ে নিয়ে বাড়িতেই এসব কিছু নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করেন তিনি। তিনি মনে করেন দুজনে মিলে কাজ করলে সংসারে উন্নতি হবে। উনি বাড়িতে কাজ করবেন আর স্বামী বাইরে কাজ করবেন। বাড়িতে হাঁস পালন করে বিক্রি করেছেন গরু কিনবেন বলে। চারটা ছাগল আছে বিশটি মুরগী আছে।পরিশ্রমী হাছিনা বেগম ভবিষ্যতে নিজেদের আরো কিছু জমি জায়গা করতে চান যাতে অন্যের জমিতে অন্যের বাড়িতে কাজ করতে না হয়। নিজেদের জায়গায় বেশি করে নার্সারী এবং বেশি করে হাঁস-মুরগী, গরু-ছাগল পালন করতে চান। এখন তার আর আগের মত অভাব নাই কোন সন্ধ্যায় না খেয়ে থাকতে হয় না। হাছিনা বেগমের স্বামীর টাকা তার প্রয়োজনই হয় না এখন আর। নিজেদের সবজিগুলো থেকেই নিজেদের পুষ্টির চাহিদা মেটান আবার বিক্রি করেও আয় করেন। ইচ্ছা করলে তিনবেলার খাবারের যোগান যে নিজের বাড়ি থেকেই দেয়া যায় হাছিনা বেগম তার একটি উদাহরণ সৃষ্টি করা নারী। তিনি নিজেই নিজের ভাগ্য পরিবর্তনের কারিগর। করোনাকালে যখন হাটবাজার বন্ধ তখন তাঁকে বাজারের অভাবে না খেয়ে থাকতে হয়নি। কেননা রান্নার সব রকমের রসদ রয়েছে তাঁর নিজেরই। তাঁর পুষ্টি উন্নয়নে এ অবদানের জন্য জাপান ভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবী আন্তর্জাতিক সংস্থা হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ড থেকে অর্জন করে নিয়েছেন “হাঙ্গার ফ্রি প্রাইজ-২০২০”। প্রাইজ মানির অর্থটিও তিনি জমি নেওয়ার কাজে লাগিয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করেন পরিশ্রম না করলে নিজের উন্নয়ন ঘটানো যাবেনা। গত দুবছর ধরে তিনি হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ডের পুষ্টি বিষয়ক উঠান বৈঠকে মাসে দুইদিন নিয়মিত অংশগ্রহণ করে পুষ্টি, পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা ও নিরাপদ সবজি উৎপাদন এবং রান্নার পদ্ধতিও সম্পর্কে সচেতন হয়েছেন বলে জানিয়েছেন হাছিনা বেগম।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com