দীর্ঘকাল ধরে দেশে বোরো উৎপাদনের সিংহভাগই আসছে ‘ব্রি ধান ২৮’ এবং ‘ব্রি ধান ২৯’ থেকে। তবে দুই যুগের বেশি পুরনো এসব জাতগুলোর উৎপাদনশীলতা দিন দিন কমেই চলেছে। অন্যদিকে বাড়ছে নতুন নতুন রোগ-বালাইয়ের প্রকোপও। ফলে পুরনো এসব জাতের বিকল্প হিসেবে নতুন নতুন উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান চাষের চেষ্টা চলছে প্রতিনিয়ত। এরমধ্যে এ বছর সবচেয়ে আশা জাগানো নতুন জাত হিসেবে উঠে এসেছে ‘ব্রি ধান ৮১’। এছাড়াও ‘ব্রি ধান ৮৮’, ‘ব্রি ধান ৮৯’, ‘ব্রি ধান ৯২’ ও ‘ব্রি ধান ৯৬’ পুরনো জাতগুলোর তুলনায় পরীক্ষামূলক প্রদর্শনীতে দারুণ ফলন দিয়েছে এবারের বোরো মৌসুমে। জানা গেছে, সদ্য সমাপ্ত বোরো মৌসুমে দেশে রেকর্ড পরিমাণ ফলন দিয়েছে ব্রি ৮১। চাষিরা বিঘাপ্রতি ৩১ মণ ফলন পেয়েছেন উচ্চফলনশীল এ জাতটি থেকে। যেখানে প্রতি হেক্টরে আগের জনপ্রিয় জাত ব্রি ২৮ উৎপাদন হতো ৬ টন, সেখানে একই জমিতে এ ব্রি ৮১ চাষ করে ধানের ফলন পাওয়া গেছে সাড়ে ৭ টন পর্যন্ত। এ নতুন জাতের ধানের উৎপাদনই শুধু বেশি নয়। পুষ্টিমানের দিক থেকেও এগিয়ে রয়েছে এটি। ব্রি ২৮-এ আমিষের পরিমাণ ৮ দশমিক ৬ পিপিএম আর ব্রি ৮১-তে রয়েছে ১০ দশমিক ৩ পিপিএম আমিষ। এছাড়া এই চালে অ্যামাইলোজ বেশি, যার পরিমাণ ২৫ শতাংশের ওপর। নতুন জাতের ধানের উৎপাদনই শুধু বেশি নয়। পুষ্টিমানের দিক থেকেও এগিয়ে রয়েছে এটি। ব্রি ২৮-এ আমিষের পরিমাণ ৮ দশমিক ৬ পিপিএম আর ব্রি ৮১-তে রয়েছে ১০ দশমিক ৩ পিপিএম আমিষ। এছাড়া এই চালে অ্যামাইলোজ বেশি, যার পরিমাণ ২৫ শতাংশের ওপর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের মানুষের ক্যালোরি ও আমিষের চাহিদার অর্ধেকেরও বেশি পূরণ হয় ভাত থেকে। ফলে আমিষের ঘাটতি পূরণেও সহায়ক হবে নতুন জাতের এই ধান। সে কারণেই ধানের এই নতুন জাতটিকে দ্রুত কৃষক পর্যায়ে সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. আসাদুল্লাহ জাগো নিউজকে বলেন, ব্রি ৮১ সহ কাছাকাছি কয়েকটি জাত সম্প্রসারণে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কারণ আগের জাতগুলোর উৎপাদন কমে গেছে। রোগ-বালাই বেশি হচ্ছে। তিনি বলেন, নতুন জাতগুলো ফলন বেশি বলে বর্ধিত জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরণে সহায়ক। কৃষক পর্যায়ে উন্নতমানের বীজ উৎপাদন সংরক্ষণ ও বিতরণ প্রকল্পের মাধ্যমে যেসব এলাকায় নতুন যেসব জাতের উৎপাদন বেশি সেই বীজ বিতরণ করা হবে।
মহাপরিচালক আরও বলেন, কয়েকটি নতুন জাতের প্রদর্শনী শেষ হয়েছে এ বছর। ব্রি ৮১ চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৫ একরে প্রদর্শনী হয়েছে। সেখানে এ বছর এক টন বীজ বিতরণ করা হবে। এছাড়া সারা দেশে যেখানে যে জাত ভালো হবে তারই প্রদর্শনী করা হবে।
আসাদুল্লাহ বলেন, আমাদের সর্বাত্মক চেষ্টা থাকবে কীভাবে দ্রুত এসব জাত কৃষকের মধ্যে পৌঁছানো এবং জনপ্রিয় করে তোলা যায়। বি আইডিসি নিজস্ব উৎপাদন ব্যবস্থায় এসব বীজ উৎপাদন করবে, সেটাও কৃষকদের মধ্যে স্বল্পমূল্যে পৌঁছাবে। এদিকে, ফলন বেশি হওয়াতে কৃষকরাও নতুন নতুন জাতের ধান চাষে ব্যাপক আগ্রহ দেখাচ্ছেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুরের রহনপুর কৃষক সিরাজ মিয়া এ বছর প্রথম চার বিঘা জমিতে ব্রি ৮১ জাতের ধান চাষ করেছিলেন।
তিনি বলেন, এবার নতুন জাত চাষ করে বিঘাপ্রতি ৩০ মণ করে ফলন পেয়েছি। এর আগে ব্রি ২৮ আবাদ করে ২০ থেকে ২২ মণ ধান পেতাম। তাই প্রতিবারই বোরোধান আবাদ করে খরচ উঠিয়ে লাভ করা নিয়ে হতাশায় থাকতে হয়েছে। কিন্তু এবার নতুন ধানের ফলন খুব ভালো। বাজারের যে দর যাচ্ছে বিঘাপ্রতি কমপক্ষে পাঁচ হাজার টাকা বাড়তি দাম পাওয়া যাবে।
ব্রি ৮১ চাষ করেছেন এমন আরও কয়েকজন কৃষক জানিয়েছেন, এ ধানে সেচ ও পরিচর্যা কম লেগেছে। পাশাপাশি অন্য ধানের চেয়ে ফলন পেতে সময়ও লাগে কম। ব্রি ২৯ জাতের ধানের তুলনায় ১০-১৪ দিন আগেই এ ধান পেকেছে।
ব্রি ধান ৮১ এর বৈশিষ্ট্য: বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনিস্টিটিউট (ব্রি) বলছে, ব্রি ৮১ জাতের ধানের বিশেষ বৈশিষ্ট্য এ ধান পাকার পরও পাতাগুলো সবুজ থাকে। মাঝারি উঁচু জমি থেকে উঁচু জমিতে খুব ভালো ফলন দেয়। নওগাঁ, রাজশাহী, নাটোর, সাতক্ষীরা, খুলনা, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ অঞ্চলে এই ধানের ফলন অনেক ভালো পাওয়া যায়।
ব্রির মহাপরিচালক ড. শাহজাহান কবীর বলেন, রান্না করার পর এটি বাসমতির মতো দেড় গুণ লম্বা হয়ে যায়। ভাত ঝরঝরে ও খেতে সুস্বাদু। ধান থেকে তৈরি আতপ চাল বিদেশে রফতানিযোগ্য। তিনি আরও বলেন, ব্রি ৮১ হচ্ছে ব্রি ২৮ জাতের পরিপূরক। কিন্তু এটি ব্রি ধান২৮ এর চেয়ে চিকন। ঝড়বৃষ্টিতে ব্রি ধান ২৮ হেলে পড়লেও নতুন ব্রি ধান ৮১ হেলে পড়ে না। আগের জাতগুলো থেকে অনেক বেশি রোগ প্রতিরোধী।
‘মেগা ভ্যারাইটি’ ব্রি ধান ২৮: ১৯৯৪ সালে দেশে ব্রি ধান ২৮ ও ব্রি ধান ২৯ অবমুক্ত করা হয়েছিল। এরপর বোরোর উৎপাদনে দেশে এক নতুন যুগের সূচনা হয়। তবে দীর্ঘদিন ধরে উৎপাদন চলায় এই জাত দুটির ফলন কমে এসেছে। নতুন জাতের ধান আসায় সেই সমস্যা থেকেও মুক্তি মিলবে এমনটাই আশা কৃষি গবেষণা সংশ্লিষ্টদের।
যদিও এখন পর্যন্ত চাষ হওয়া উচ্চ ফলনশীল জাতের ৮৬টি জাতের ধান থাকলেও সবচেয়ে বেশি উৎপাদিত হয় ব্রি ধান ২৮। বোরো মৌসুমে দেশের যে পরিমাণ জমিতে ধান চাষ হয় তার মধ্যে ৪৫ শতাংশ জমিতেই এই জাতটি চাষ করেন কৃষকরা। অধিক ফলন ও ব্যাপক চাষাবাদের কারণে বিজ্ঞানীরা এই জাতটিকে এখনও ‘মেগা ভ্যারাইটি’ বলেন।
ব্রি ধান ৮১ এর ইতিহাস: ২০১৭ সালের অক্টোবরে জাতীয় বীজ বোর্ড ‘ব্রি ধান ৮১’ জাতটির অনুমোদন দিয়েছে। এরপর থেকেই বিজ্ঞানীরা আশা করছেন ব্রি ধান ৮১ জনপ্রিয়তায় ব্রি ধান ২৮ এর জায়গা দখল করবে এবং দেশের ধান উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়বে। তবে মাঝে কিছু সময় এ ধান নিয়ে তেমন তৎপরতা ছিল না। জানা গেছে, অনুমোদনের ১৫ বছর আগে কৃষি মন্ত্রণালয় ইরান থেকে ‘আমোল-৩’ জাতের ধান বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। তখন থেকেই বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা এই ধান থেকে বাংলাদেশের আবহাওয়ার উপযোগী ওইসব উচ্চ ফলনশীল ধান তৈরির কাজ করছিলেন। অবশেষে ২০১৭ সালে ইরানের সেই আমোল-৩ ও আমাদের মেগা ভ্যারাইটি ব্রি ধান ২৮ শঙ্কর করে ব্রি ধান ৮১ তৈরিতে সফলতা আসে। প্রায় ১৫ বছর ধরে এ জাতের সঙ্করায়ন, ল্যাব ও ফিল্ড টেস্টের কাজ চলেছে ব্রিতে।-জাগোনিউজ২৪.কম