আল্লাহ তায়ালা নবী করিম সা:কে শেষ নবী হিসেবে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। কিয়ামতের আগ পর্যন্ত আর কোনো নতুন নবী পৃথিবীতে আগমন করবেন না। পৃথিবীর যাবতীয় কার্যাবলির ইসলামী বিধান তিনি ‘ইসলামী শরিয়তের’ নামে আমাদেরকে দান করেছেন। মানবজাতির অন্যান্য বিষয়ের মতো শরিয়ত ব্যবসায় সম্পর্কেও স্পষ্ট বিধান ব্যক্ত করেছে। মুসলমানদের যাপিত জীপনের বড় অংশজুড়ে লেনদেন ও ব্যবসার দখল। ইসলামী শরিয়তে ব্যবসার ক্ষেত্রে যেমন উৎসাহ ও সুসংবাদ দান করা হয়েছে, তেমনি খেয়ানত, মিথ্যা, প্রতারণার ইত্যাদির ব্যাপারেও সীমাহীন শাস্তি ও ধমকি বাণী উচ্চারিত হয়েছে। প্রতিটি বিষয়ের মতো ব্যবসায় সম্বন্ধেও ইসলাম অত্যন্ত কার্যকর ও ন্যায়সঙ্গত নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। এসব নীতিমালা অনুযায়ী ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পাদন করলে অর্থব্যবস্থা অত্যন্ত সুচারুরূপে চলমান থাকবে, তেমনি ব্যবসায়ীরা হালালভাবে বিপুল মুনাফা অর্জন করতে সক্ষম হবেন। ব্যবসার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নীতিমালা নি¤œরূপÑ
ক. ব্যবসায় সফলতা ও বরকত অর্জনের জন্য সত্য বলা, মিথ্যার আশ্রয় না নেয়া ও মিথ্যা কসম না করা অত্যন্ত জরুরি বিষয়। এসব অন্যায় পন্থার আশ্রয় গ্রহণ করলে বাহ্যিক দৃষ্টিতে যদিও বেশি মুনাফা অর্জিত হচ্ছে বলে মনে হয়, কিন্তু প্রকৃত পক্ষে এমন উপার্জন ও ব্যবসায় থেকে বরকত ও প্রবৃদ্ধি উঠে যায় নিশ্চিতভাবে। নবী করিম সা: বলেছেন, ‘যদি ক্রেতা-বিক্রেতা ক্রয়-বিক্রয়ে সত্য বলে, লেনদেন স্পষ্টভাবে সম্পন্ন করে, তাহলে তাদের ব্যবসায় বরকত দান করা হয়। পক্ষান্তরে তারা যদি মিথ্যা বলে, অবস্থা গোপন করে, তাহলে তাদের ব্যবসার বরকত ধ্বংস হয়ে যায়।’ (বুখারি-১৯৩৭)
অন্য হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা তিন ব্যক্তির সাথে কথা বলবেন। কিন্তু তাদের দিকে (রহমতের) দৃষ্টিপাত করবেন না। তাদেরকে গোনাহমুক্ত পবিত্র করে জান্নাতেও প্রবেশ করাবেন না। তাদের একজন হলেন ওই ব্যক্তি, যিনি মিথ্যা কসম করে নিজের পণ্য বিক্রির চেষ্টা করেন।’ (মুসলিম-৩০৬)
খ. পণ্যের ক্রটি গোপন করা ও ক্রেতাকে ঠকানো নিতান্ত গর্হিত কাজ। অনেক সময় বিক্রেতা নকল পণ্যকে আসল পরিচয় দিয়ে বা পণ্যের ত্রুটি গোপন রেখে পণ্য বিক্রি করে থাকেন। ক্রেতা ঠকানোকে নিজের বুদ্ধিমত্তা, চালাকি জ্ঞান করেন। স্মরণ রাখার দরকার, ক্রেতা ঠকানো কখনোই ভালো মানুষি ও বুদ্ধিমত্তার কাজ হতে পারে না, বরং সীমাহীন নির্বুদ্ধিতা ও ক্ষতি অর্জনের মাধ্যম। এমন ব্যক্তি অবশ্যই দুনিয়া ও আখিরাতে জঘন্যতম বিপর্যয়ের শিকার হবেন।
আবু হুরায়রা রা: বলেন, নবী করিম সা: একটি শস্যস্তূপের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় স্তূপের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিলেন। দেখলেন ভেতরে ভেজা শস্য। শস্যের ব্যবসায়ী মালিককে জিজ্ঞাসা করলেন, ব্যাপার কী? ভেতরে ভেজা শস্য কেন? ব্যবসায়ী উত্তর দিলেন, বৃষ্টির পানিতে ভিজে গেছে। নবী সা: বললেন, ‘তুমি ভেজা শস্যগুলো উপরে রাখলে না কেন? তাহলে ক্রেতারা দেখে নিত (এবং ধোঁকা খেত না)। যে ব্যক্তি মানুষকে ধোঁকা দেয়, তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।’ (মুসলিম-২৯৫)
গ. ব্যবসায়ীদের জন্য সততা ও আমানতদারি অত্যাবশ্যক। পণ্য ভালো হলে ভালো বলা, আর খারাপ হলে স্পষ্ট করে বলে দেয়া জরুরি। খারাপ পণ্য বিক্রি করে, অথবা ক্রেতার অপরাগতার সুযোগে স্বল্পমূল্যের পণ্য স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যে বিক্রি করে নিজের হালাল মুনাফাকে হারামে পরিণত করা চরম বোকামি হবে। হারাম উপার্জন সমস্ত খারাবির মূলভিত্তি। এ জন্য লাভ সামান্য হলেও হালাল ও পরিচ্ছন্ন উপার্জন করা উচিত। সত্যবাদী ও আমানতদার ব্যবসায়ীর জন্য হাদিসে বিরাট ফজিলতের কথা বর্ণিত হয়েছে। নবী সা: বলেছেন, ‘আমানতদার সত্যবাদী ব্যবসায়ী কিয়ামতের দিন নবী, সিদ্দিন ও শহীদদের সাথে উপস্থিত হবেন।’ (তিরমিজি-১২৫২)
গ. বিক্রয়ের সময় মাপ বা ওজনে ইচ্ছাকৃত কম করা ধ্বংস ও বরবাদির কারণ। পবিত্র কুরআন ওজনে কম না করতে বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করেছে। ওজনে হ্রাসকারীকে আল্লাহর আজাব-গজব থেকে পরিত্রাণ পেতে সতর্ক করেছেন। ঘোষিত হয়েছে, ‘বহু দুঃখ আছে তাদের, যারা মাপে কম দেয়, যারা মানুষের কাছ থেকে যখন মেপে নেয়, পূর্ণমাত্রায় নেয়। আর যখন অন্যকে মেপে বা ওজন করে দেয় তখন কমিয়ে দেয়।’। (সূরা মুতাফফিফিন : ১-৬)
নবী করিম সা: পণ্য ওজনের সময় বেশি দিতেই উৎসাহ দিয়েছেন, ‘ওজনের সময় তোমরা একটু বেশি দাও’। (তিরমিজি-১৩৫৩) অন্য হাদিসে আছে, ‘পরিমাপের ক্ষেত্রে তোমরা বৃদ্ধি করে দাও’। (ইবনে মাজাহ-২৩০৭)
ঘ. হারাম পণ্যের ব্যবসা না করা। ইসলামী শরিয়ত যেসব জিনিসকে হারাম ঘোষণা করেছে, সেসব জিনিসের ক্রয়-বিক্রয় করাও হারাম। যেমনÑ সর্বপ্রকার মাদকদ্রব্য, মৃত প্রাণী, হারাম পশু ইত্যাদি। তেমনিভাবে লটারি, জুয়া, পতিতালয়, সুদ, সিনেমা, বাদ্যযন্ত্র, চলচিত্র ও সঙ্গিতের স্কুল, নাটক উপন্যাসের বই ইত্যাদি সবই হারাম পণ্যের অন্তর্ভুক্ত। এসবের ক্রয়-বিক্রয় হারাম। নবী সা: বলেছেন, ‘আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল মদ, মৃত প্রাণী, শূকর ও মূর্তির ক্রয়-বিক্রয় হারাম করেছেন।’ (বুখারি-২২৩৬)
অন্য হাদিসে বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা যে জিনিসকে হারাম সাব্যস্ত করেছেন, তার মূল্যও হারাম করেছেন।’ (সহিহ ইবনে হিব্বান-৪৯৩৭)
ঙ. পণ্য গুদামজাত করা। যেসব পরিস্থিতিতে পণ্য গুদামজাত করতে শরিয়ত নিষেধ করেছে, তখন পণ্য গুদামজাত করা হারাম। বড় বড় ব্যবসায়ীরা সুযোগ বুঝে একসাথে অনেক পণ্য ক্রয় করে গুদামজাত করে বাজারে পণ্যের সঙ্কট সৃষ্টি করে। ফলে পণ্যের বাজারদর বেড়ে যায়। তখন ওই সব ব্যবসায়ীরা গুদামজাত পণ্য বিক্রি করে বিপুল মুনাফা করে থাকে। এভাবে মানুষের ক্ষতি করে, পণ্যের কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে মূল্য বৃদ্ধি করা শরিয়তে স্পষ্ট হারাম। তেমনিভাবে মধ্যস্বত্বভোগী কর্তৃক পণ্য উৎপাদককে স্বাভাবিকের চেয়ে মূল্য কম দিয়ে বাজার ব্যবসায়ীদের কাছে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি দামে সে পণ্য বিক্রি করা ইসলামে নিষিদ্ধ। নবী সা: বাজারে পণ্য পৌঁছানোর আগেই পণ্য ক্রয় করতে নিষেধ করেছেন। অর্থাৎ, উৎপাদিত সব পণ্য আড়ত বা গোডাউনে আসার পর বাজারদর হিসাব করে পণ্য বেচাকেনা করা জরুরি। এটা না করে উৎপাদিত পণ্য বাজারে পৌঁছার আগেই কয়েকজন সব পণ্য ক্রয় করে, নিজেদের ইচ্ছামতো মূল্য নির্ধারণ করে বিক্রি করা নিষেধ। এভাবে পণ্যের কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি হয়ে বাজারমূল্য বেড়ে যায়।
উপরোক্ত মূলনীতি ব্যতীত আরো অসংখ্য মূলনীতি ফুকাহায়ে কেরাম কুরআন-সুন্নাহর আলোকে বর্ণনা করেছেন। আল্লাহ তায়ালা মুসলিম জাতিকে ব্যবসার সঠিক পদ্ধতি জানা ও মানার তৌফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : খতিব, আল মক্কা জামে মসজিদ, হরপাড়া, শ্রীনগর, মুন্সীগঞ্জ