শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ০৫:০৪ অপরাহ্ন

হারিয়ে যাচ্ছে বেলাবরের সুস্বাদু দেশী মাছ

বেলাব (নরসিংদী) প্রতিনিধি :
  • আপডেট সময় সোমবার, ১৪ জুন, ২০২১

মাছে ভাতে বাঙালি প্রবাদটি শুধু কথায় নয় বাস্তবেও শতভাগ পরিলক্ষিত হয়। সোজা কথা একদিন খাবারের সাথে মাছ না থাকলে আমাদের পেটই অপূর্ণ থাকে। তবে শুধু নামে মাছ হলেই ভোজনরসিক বাঙালি পরিতৃপ্ত নয়। চাই পছন্দসই মাছ। আর পছন্দের তালিকায় শীর্ষে আছে দেশীয় প্রজাতির ছোট মাছ। নরসিংদির বেলাব উপজেলা মানুষদের এক সময়ের ঐতিহ্যও মাছ নিয়ে শশুর বাড়ি, মামার বাড়ি, মেয়ের বাড়ি বেড়ানো ও বাহারী ছোট মাছের তরকারি দিয়ে অতিথি আপ্যায়ণ। আজ সেই প্রথার বিলুপ্তি ঘটেছে, ঐতিহ্যে ভাটা পড়েছে। কারণ, এখন আর সেই ছোট মাছ নেই, নেই আগের মতো খাল, বিল, ডোবা, নালা। তাই বিকেলে দলবেঁধে বঁড়শি দিয়ে, ঠেলা জাল দিয়ে মাছ ধরার সেই মনোমুগ্ধকর দৃশ্য এখন অদৃশ্য হয়ে পড়েছে। একসময় সুস্বাদু মাছের নামমাত্রই আড়িয়াল খাঁ নদীর বিভিন্ন মাছের নাম আসতো সবার আগে, যা এখন অতীত। নরসিংদীর বেলাব উপজেলার আট টি ইউনিয়নের অসংখ্য খালে ও বিলে ব্যাপক মাছ পাওয়া যেত। সময় পেলেই ছেলে-বুড়ো, তরুন-যুবকদের নদী, বিল, খাল, দীঘি, জলাশয়, খাল, নালার তীরে বঁড়শি দিয়ে মাছ ধরার প্রতিযোগিতা শুরু হত। খালি হাতে আসতনা কেউ। কই, শিং, মাগুর, ট্যাংরা, পুঁটি, লাটিতে পাত্র ভরে নিয়ে আসতো তারা। এখানে প্রতিটি জলাশয় ছিল সুস্বাদু ছোট্ট প্রজাতির মাছের অফুরন্ত ভান্ডার। কিন্তু সুস্বাদু এই দেশীয় মাছ বিলুপ্ত হবার পথে। অথচ খাল-বিলে ভরা আমাদের বেলাব উপজেলায় এক সময় দেশীয় মাছের ভান্ডার ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে কারেন্ট জাল, ভেসাল (ভের) জালসহ অন্যান্য অবৈধ উপায়ে দেশীয় মাছ ব্যাপক নিধন, এদের বংশ বৃদ্ধি ব্যাহত করে এই প্রাকৃতিক ভাবে জন্ম নেওয়া প্রজাতির মাছগুলো ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। আর এ কারণে বেলাব বাজার সহ আশেপাশের বাজার গুলোতে দেশীয় মাছের উপস্থিতি দিন দিন কমে যাচ্ছে। দেশীয় মাছের স্থলে এখন পুকুরে বা ঘেরে চাষ করা স্বাদ ও গুণহীন বিভিন্ন মাছে বাজার ভরে গেছে। হারিয়ে যেতে বসেছে কই, শিং, সরপুটি, বোয়ালসহ নানা জাতীয় দেশীয় মাছ। এখনও উপজেলাতে রয়েছে অসংখ্য খাল, বিল ও পুকুর। যেখানে প্রাকৃতিক ভাবেই জন্ম হতো দেশীয় মাছের। সেখানে এখন কৃত্রিম উপায়ে বানিজ্যিক মাছ চাষ করছে আর বিলুপ্ত হচ্ছে প্রিয় এ মাছগুলো। জেলেরা বিগত কয়েক বছর থেকেই দেশীয় মাছ তেমন একটা পাচ্ছেন না। জেলে সজল দাস জানান ‘সারাদিন ও রাতে মাছ ধরেও ১০ কেজি মাছও ধরতে পারিনি আমরা তিনজন। বিল, নদী, খাল সবগুলো থেকেই ধরেছি এ সামান্য পরিমাণ মাছ।’ মৎস বিশারদের মতে, জলবায়ুর পরিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ফসলের ক্ষেতে দেশীয় অর্ধশত প্রজাতির ক্ষতিকর কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের যথেষ্ট ব্যবহারের ফলে দেশীয় মাছের অস্তিত্ব বিলীন হতে পারে। সুস্বাদু দেশীয় মাছ এখন আর তেমন মিলছে না। এখন এমন হাল হয়েছে বাজারে যদি পাঙ্গাস আর তেলাপিয়া জাতীয় মাছ না থাকতো তাহলে উপজেলাবাসীর আমিষের চাহিদা মিটানো অসম্ভব হয়ে পরতো। বর্তমানে দেশীয় মাছের চরম সংকট আর যা পাওয়া যায় তার অগ্নিমূল্যের কারণে গরীব ও মধ্যবিত্তদের স্বপ্নের মাছ হয়ে গেছে এগুলো। এসব এখন ৮০% মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাহিরে। মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে কয়েক বছর পুর্বেও অসংখ্য প্রজাতির দেশীয় মাছ ছিল। কিন্তু অধুনা মানুষ্যসৃষ্ট নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে এসব মাছের অনেক প্রজাতি এখন চোখে পড়ে না। তাছাড়া বর্ষা মৌসুমের সময় নদী-খাল-বিল থেকে কারেন্ট জালের মাধ্যমে ব্যাপকহারে ডিমওয়ালা মাছ ধরার কারণে দেশীয় মিঠা পানির বিভিন্ন প্রজাতির মাছের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাচ্ছে। কালের গর্ভে মাছে-ভাতে বাঙ্গালীর যে ঐতিহ্য ছিল তা আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। সেই শোল, টাকি, কৈ, গজাল, টেংরা, চিতল, শিং, খয়রা, বাটা, পাইশ্যা, কালিবাউশ, বাইল্যা, কাজলি, সরপুটি, পাবদা, খৈলশা, ডগরি, জাবা, ভোলা, বাগাড়, বাঁশপাতা, ভাঙ্গান, পুঁটি, সরপুঁটি, গলদা ও ছোট চিংড়িসহ অর্ধশত প্রজাতির মাছ এখন বিলুপ্তির পথে। এ সকল মাছ স্বাদে ও পুষ্টি গুনে ছিল ভরপুর। জেলেরা সারা বছর মাছ শিকার করে নিজ পরিবারের চাহিদাপূরণ সহ জীবিকা নির্বাহ করত। শুষ্ক মৌসুমে খাল বিলের পানি কমে গেলে চলত মাছ ধরার মহোৎসব। এখন এই মাছ ধরার উৎসবেও ভাটা পড়েছে। দলবেঁধে পল বা অন্যান্য মৎস্য শিকার যন্ত্র নিয়ে গান গেয়ে বা হৈ-হুল্লোড় করে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ধরার সেই প্রথাও বিলুপ্তির পথে। ৯০ দশকের আগের ঐতিহ্য ছিল বোনের বাড়িতে, মেয়ের জামাইর বাড়িতে, শশুর বাড়িতে কলসি ভরে নদী, খাল, বিলের কই, শিং, মাগুর মাছ পাঠানো কিন্তু আজ সেইদিন গুলো এখন আর চোখে পড়েনা। চিরচেনা রুপটিও আজ অচেনা মনে হচ্ছে।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com