২২ বছরের সুদর্শন তরুণ ইয়াসির মোহাম্মদ রাতুল। নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়া রাতুল সেলসম্যান ও টি-বয়ের কাজ করেন। তবে পোশাকে-চলনে আভিজাত্য দেখিয়ে ধনী পরিবারের সুন্দরী মেয়েদের সঙ্গে প্রেম করতেন তিনি। এরপর বিশ্বস্ততা অর্জন করে গড়ে তুলতেন অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। বিশেষ মুহূর্তের ছবি ও ভিডিও সেই প্রেমিকার মোবাইল ফোনেই ধারণ করতেন। এরপর কৌশলে প্রেমিকার ফোনে ব্যবহৃত ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগের আইডিগুলো দখলে নিতেন। এক পর্যায় ফোনটিও চুরি করতেন। এরপর ছবি ও ভিডিও দেখিয়ে হাতিয়ে নিতেন টাকা। চুরি করা ফোন বিক্রির আগে বিশেষ সফটওয়্যারের মাধ্যমে সব নিজের কাছে রেখে দিতেন। ভুক্তভোগী এক তরুণীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ১৬ নভেম্বর রাজধানীর বাংলামোটর থেকে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) রাতুলকে গ্রেপ্তারের পর তদন্তে চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে। এভাবেই মোবাইল ফোনের মাধ্যমে হাজারো নারীর সাইবার অপরাধের শিকার হওয়ার তথ্য মিলেছে। ঘটনাগুলো ঘটছে ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন এবং ব্যবহৃত আইডি হাতছাড়া হয়ে গেলে। সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারে এখন প্রতিদিন মোবাইল ফোনে, ফেসবুক পেজে বা সরাসরি শতাধিক অভিযোগ জমা পড়ছে; যার বেশির ভাগ অভিযোগই হয়রানির শিকার নারীদের। পুরুষরাও এ ধরনের হয়রানির শিকার হচ্ছে, তবে তুলনামূলক কম। পুলিশ সদর দপ্তরের পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন (পিসিএসডাব্লিউ) নামের ফেসবুক পেজেও প্রতিদিন অর্ধশত অভিযোগ করছে নারীরা। এর মধ্যে ব্ল্যাকমেইলিং, পর্নোগ্রাফি, ফেসবুক আইডির দখল নেওয়া, ফেসবুক আইডি হ্যাক করা, হুমকি দেওয়াসহ বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ থাকছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, নারীরা সামাজিক যোগাযোগের সাইট ও ব্যক্তিগত যোগাযোগ চালাতে মোবাইল ফোনই বেশি ব্যবহার করে। তাই এখন সাইবার অপরাধের নতুন হাতিয়ার হয়ে উঠেছে ‘মোবাইল ফোনের নিয়ন্ত্রণ’। ফোন থেকে তথ্য মুছে ফেললেও অনেক সময় ‘রিস্টোর’ করে তা ফিরিয়ে আনা যায়। ইমোসহ কিছু অ্যাপের আইডির নিয়ন্ত্রণও নেওয়া যায় সহজে। এসব সুযোগ কাজে লাগিয়ে নতুন ধরনের প্রতারণা চলছে। তাই মোবাইল ফোন নিয়ে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর থেকে ১০ অক্টোবর পর্যন্ত এক মাসের একটি হিসাবে দেখা গেছে, সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের ফেসবুক পেজে ১৭ হাজার ৭০৩ এবং ফোনে ৩৮ হাজার ৬১০ অভিযোগ আসে। এর মধ্যে বেশির ভাগই ছিল নারীদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানো, ছবি কেটে অশালীন ছবিতে বসানো, তরুণীদের যৌন হয়রানির হুমকি, ফেসবুক আইডি হ্যাক করে বাজে পোস্ট ও বিভিন্ন ধরনের হয়রানির। পাশাপাশি মোবাইল ব্যাংকিং প্রতারণা, গুজব ও অনলাইন পণ্য কেনা নিয়েও প্রতারণার অভিযোগ আছে। চলতি বছর থেকে অভিযোগের সংখ্যা কিছুটা কমেছে। প্রতি মাসে গড়ে সাড়ে তিন হাজার অভিযোগ আসছে সাইবার পুলিশ সেন্টারে। তবে নারীদের হয়রানির হার কমেনি। অভিযোগ থেকে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের এক তরুণী তার একটি আইফোন বিক্রি করতে আসেন রাজধানীর উত্তরায়। ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেওয়ার পর ৪০ হাজার টাকা দাম ঠিক করেন এক যুবক। কথামতো তাঁর কাছে এলে ফোন হাতে নিয়ে বুথ থেকে টাকা তুলে দেওয়ার কথা বলেন যুবক। এক পর্যায় মেয়েটির ফোন নিয়ে দৌড়ে পালায়। সপ্তাহ না ঘুরতেই সেই চোরাই ফোনটি কেনেন আনিক নামে অন্য এক যুবক। আইফোন হাতে পেয়ে প্রথমেই অ্যাপসের মাধ্যমে মুছে ফেলা ছবি ও ভিডিও রিস্টোর করেন তিনি। সেখানে পেয়ে যান ওই তরুণীর স্পর্শকাতর কিছু ছবি। পেয়ে যান ওই তরুণীর সঙ্গে যোগাযোগের উপায়ও। পরে ওই তরুণীর সঙ্গে যোগাযোগ করে ছবিগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার কথা বলে দাবি করেন ১০ হাজার টাকা। উপায় না পেয়ে মেয়েটি পুলিশের দারস্থ হন। সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টার অনিককে গ্রেপ্তার করেছে।
সিআইডির সাইবার ক্রাইম কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টারের অতিরিক্ত ডিআইজি কামরুল আহসান বলেন, ‘এখন ফোনে, পেজে বা সরাসরি মাসে সাড়ে তিন হাজার অভিযোগ পাচ্ছি আমরা। নতুন ধরনের জালিয়াতি ও অর্থপাচারের মতো অপরাধ চলে এসেছে সাইবার জগতে। তবে এর মধ্যে নারীদের হয়রানি, আইডি হ্যাক, প্রতারণার বিভিন্ন অভিযোগ পাচ্ছি। ফোনে থাকা ছবিসহ তথ্য এবং শেয়ার করা ছবি বা রেকর্ড প্রতারণার বড় মাধ্যম হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে মেয়েদের সতর্ক থাকতে হবে।’
গত বছরের ১৬ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন ফেসবুক পেজ উদ্বোধন করেন আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ। পরবর্তী সময়ে দেখা গেছে, দুই দিনেই ৬৯১টি অভিযোগ জমা পড়েছিল। এখন দিনে গড়ে অর্ধশতাধিক নারী বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ করছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) সোহেল রানা বলেন, ‘নারীদের কাছে পাওয়া অভিযোগের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ব্ল্যাকমেইলিং, পর্নোগ্রাফি, ফেসবুক আইডি অন্যে ব্যবহার, ফেসবুক আইডি হ্যাক করা ও হুমকি দেওয়া ইত্যাদি। দ্রুততম সময়ের মধ্যে অভিযোগ নিয়ে কাজ শুরু হয়। ফোনে পরামর্শ সহায়তা দেওয়া হয়। মামলা বা জিডি করাসহ আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়। দ্রুত সুরক্ষার প্রয়োজন হলে সংশ্লিষ্ট শাখার মাধ্যমে তা করা হয়।’
করণীয় কী: মোবাইল ফোন ব্যবহার এবং ফোনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন সাইবার অপরাধ তদন্তকারীরা। তাঁরা বলছেন, নারীরা মোবাইল ফোনেই ফেসবুক, টিকটক, লাইকি, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমুসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম চালায়। আবার ব্যক্তিগত ছবি বা তথ্যও রাখে মোবাইল ফোনে। তাই ফোন সব সময় হাই সিকিউরিটি লক করে রাখতে হবে। পাশাপাশি ফোনে সামাজিক মাধ্যম ব্যাপারে লগ আউট করতে হবে। ফোন হাতছাড়া করতেও সতর্ক থাকতে হবে। ওয়েবসাইট থেকে কী নামাচ্ছে, সে বিষয়েও সতর্ক থাকতে হবে, না হলে ফোনে ঢুকে যেতে পারে স্পাইওয়্যার বা ম্যালওয়্যার। মেইল বা অনলাইন চ্যাটিংয়ে অপরিচিত কারো কাছ থেকে পাওয়া অ্যাটাচমেন্ট ফাইল খোলা যাবে না, তা যতই লোভনীয় হোক না কেন। অনেক সময় এসব ফাইলে থাকে পাসওয়ার্ড চুরি করার গোপন কোড, থাকতে পারে ভাইরাস বা ম্যালওয়্যার।
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজির সহকারী অধ্যাপক ও তথ্য-প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা বলেন, ‘মোবাইল ফোন থেকে তথ্য চুরির ঘটনা পুরনো। এর মাধ্যমে যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে হয়রানি ও প্রতারণার নতুন ধরন ঘটে চলেছে। ফোন হারালে বা অন্যের হাতে চলে গেলে এসব ঘটনা ঘটে। অসতর্কতার কারণে ডিভাইস থেকে এমন সাইবার ক্রাইমের বেশির ভাগই শিকার নারীরা।’ তিনি বলেন, ‘নিরাপত্তার সবচেয়ে বড় সমাধান হচ্ছে এন্টি ভাইরাস ব্যবহার। কম্পিউটারের মতোই চার-পাঁচ শ টাকায় অ্যানড্রয়েড ফোনের এন্টি ভাইরাস পাওয়া যায়। এটি দিয়ে ফোন হাতছাড়া হলে ট্রাকিং করা যায় এবং ডাটা মুছে ফেলা যায়। ফোনে পেটার্ন লক ব্যবহার করতে হবে। ফোন চুরি হলে পেটার্ন লক থাকলে তা ফরমেট দিয়ে চালু করতে হয়। এরপর সিম দিয়ে যোগাযোগের অ্যাপ খুলতে হয়। তাই আসল মালিককে দ্রুত আবার ফোনের সিম তুলে নিতে হবে। এর মাধ্যমে ইমো, হোয়াটসঅ্যাপের মতো অ্যাপ চালু করতে পারবে না অন্য কেউ। আর ফেসবুক সব সময়ই লকআউট করে রাখা প্রয়োজন। যদি লগইন থাকে তবে অন্য ডিভাইস দিয়ে চালু করে অল ডিভাইস অপশনে লগআউট করতে হবে।’
পুলিশ সূত্র জানায়, সিআইডির অধীনে সাইবার পুলিশ সেন্টারের ০১৩২০০১০১৪৮ নম্বরটি ২৪ ঘণ্টা চালু থাকে। ভুক্তভোগীরা ‘সাইবার পুলিশ সেন্টার, সিআইডি বাংলাদেশ’ এবং ‘পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন’ নামে দুটি ফেসবুক পেজেও অভিযোগ জানাতে পারবে। এ ছাড়া ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পেজেও অভিযোগ জানানোর সুযোগ রয়েছে। লেখক: এস এম আজাদ, উৎস: কালের কণ্ঠ।