বিশ্লেষণ…………………
সেদিন ছিল বৃষ্টিভেজা সকাল। অফিসে আসার জন্য আড়মোড়া ভেঙে উঠতে একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। রাস্তায় নেমে পাওয়া গেল না রিকশা। এর ওপরে উঠতে গেলে আসলে খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি হয়ে যায় বলে আর ‘প্রমোটেড’ হওয়া হলো না। অগত্যা জন্মসূত্রে প্রাপ্ত দুই পা ভরসা। উপস্থিতির ঘণ্টি মনে বাড়তি দ্যোতনা সৃষ্টি করায় পা চালাতে হলো দ্রুত। আর তার ফল পাওয়া গেল অফিসের নিচে পৌঁছানোর পর। জিনসের প্যান্টের পায়ের দিকে তখন হরেক নকশা। শিল্পী কাদা, সহযোগী আমার পা।
এটি অতি সা¤প্রতিক কালের ঘটনা হলেও রাজধানী শহরের একটি চিরাচরিত বৈশিষ্ট্য। নিম্ন, নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের জীবনও অনেকটা এমন। জোরে হাঁটতে গেলেই কাদা ছেটে। কোনো না কোনো দিকে ক্ষতি মেনে নিতেই হয়। আর অধোবদনে থেকেই যেতে হয় ঢাকাতে, জীবন-জীবিকার তাগিদে। হয়তো বারবার মনে হয়, চলে যাই! কিন্তু যাওয়া আর হয় না।
রাজধানী শহরের গুরুত্ব অবশ্যই বেশি থাকে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকÍদুই ক্ষেত্রেই। তবে তার ভার কিছু শ্রেণির মানুষের বুকে বেশি অনুভূত হয়। বিত্তের হিসাবে তাঁরা নিম্ন, নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত। শব্দের হিসাবে পার্থক্য থাকলেও এই শ্রেণিগুলোর মানুষের মধ্যে ব্যবধান কি খুব বেশি? শ্রেণির দৃষ্টিভঙ্গিতে বলাই যায় যে আমাদের দেশে বিশেষ করে শহরাঞ্চলে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের ফারাক আসলে কয়েক মাসের বেতন বা আয়। এটি বন্ধ হলেই আজকের অনেক মধ্যবিত্ত কালকেই নিম্নবিত্তে পরিণত হতে পারেন। করোনাভাইরাসের মহামারির কারণে এই ব্যবধানের বিষয় আরও অস্থায়ী রূপ নিয়েছে। পরিচিত, স্বল্প পরিচিত অনেকের শ্রেণির পালাবদলের কথাও কানে আসছে। এর প্রমাণ পাওয়া গেছে পরিসংখ্যানেও। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এক জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, কোভিডের আঘাতে দেশে নতুন করে দরিদ্র হয়েছে ২ কোটি ৪৫ লাখ মানুষ। এ বছরের মার্চ পর্যন্ত যেখানে শহরাঞ্চলে নতুন দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৫৯ শতাংশ, সেখানে গ্রামাঞ্চলে তা ৪৪ শতাংশ। সুতরাং শহরে দরিদ্রদের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি।
অথচ এই শহরেই জীবনযাত্রার ব্যয় পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটতে থাকে। রাজধানী ঢাকায় হয়তো তা অসহনীয় পর্যায়েই যাচ্ছে। দিন দিন বাড়ছে জীবনযাপনের খরচ। করোনাও তাতে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। উল্টো করোনার মধ্যেই তা যেন দুর্বার গতি পেয়েছে। অথচ মানুষের আয় যে কমেছে, তা নিয়ে সংশয়গ্রস্ত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আয় না কমলে দরিদ্রের সংখ্যা বাড়ল কী করে?
ব্যয় বাড়ার উদাহরণ দিতে অবশ্য হিসাব-নিকাশের হাতি-ঘোড়া অঙ্ক দেখানোর কোনো প্রয়োজন পড়ে না। সে তো জীবন থেকে নেওয়া! এই তো সয়াবিন তেল কিনলাম গতকাল। দুই লিটার কিনতে বেরিয়ে গেল গোটা তিনেক ১০০ টাকার নোট। অথচ একসময় দুটি নোটের সঙ্গে কিছু খুচরো দিলেই কাজ চালানো যেত। একই অবস্থা চালেও। করোনাতেই বেশি টাকা খসিয়ে চাল কিনতে হয়েছে এই অভাজনকে। ওই বাজারে ঊর্ধ্বগতি এখনো বিরাজমান। আর মসলার বিষয়ে আমি কথা বলতে চাই না। মনের ওপর এত চাপ দিতে আমি রাজি না। চাপ বরং মানিব্যাগেই থাক।
এ সংক্রান্ত ক্যাবের প্রতিবেদনে চোখ বুলালে ওপরের বক্তব্যের সত্যতা মেলে। ডানপক্ষ, বামপক্ষ প্রমাণ করার তাগিদ থেকেই আসুন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) বার্ষিক প্রতিবেদনের কিছু তথ্যে চোখ বোলানো যাক। প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাজধানীতে ২০২০ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে তিন বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ হারে। আবার এ সময়েই কর্মহীন হয়েছেন বিপুলসংখ্যক মানুষ। আয়ও কমেছে অনেকের। প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ২০২০ সালে রাজধানীতে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৬ দশমিক ৮৮ শতাংশ। পণ্য ও সেবার দাম বেড়েছে ৬ দশমিক ৩১ শতাংশ।
দামি শহরের কমদামি মানুষ : নিন্দুকেরা বলতে পারেন, এর চেয়ে বেশি হারেও তো জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছিল এককালে। ক্যাবের হিসাব অনুযায়ী, তিন বছর আগে ২০১৭ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছিল ৮ দশমিক ৪৪ শতাংশ। কিন্তু তখন তো আর করোনা ছিল না। হয়তো যা আয়, তা-ই ব্যয় হয়েছে। তবু দুটো খেয়েপরে টিকে থাকা গেছে। করোনাকালে সেটিও হয়ে দাঁড়াচ্ছে অসম্ভব। যে শহরে জীবনযাত্রার ব্যয় বেশি, সেই শহরে থাকতে গেলে খরচা আছে ঢের। ‘দামি’ এই ঢাকায় বরং দরিদ্র শ্রেণির বেকায়দায় থাকা মানুষই কমদামি। জীবনের কানাগলিতে জোরে হাঁটতে গেলে কাদার ছিটে তাদের গায়েই লাগে। সেই কাদা পরিষ্কার করতে ডিটারজেন্ট কিনতেও আবার খরচের খাতায় নাম তুলতে হয়। যদিও এত কিছুর পরও শুনতে হয় বিশ্বের বসবাসযোগ্য শহরের নতুন র্যাঙ্কিংয়ে শেষ দিক থেকে চার নম্বর স্থানে রয়েছে ঢাকা, ১৪০টির মধ্যে ১৩৭-এ। অর্থনীতির সূত্র অনুযায়ী, কোনো দ্রব্যের দাম বাড়লে চাহিদা কমে। আর দাম কমলে চাহিদা বাড়ে। কিন্তু এসবের ধার ধারে না রাজধানী ঢাকা। এ শহরে চাহিদা বাড়লে দাম আরও বাড়ে। বাড়তে বাড়তে আকাশচুম্বী হয়। আচ্ছা, অন্তত ‘কমদামি’ মানুষের ক্ষেত্রে কি অর্থনীতির সূত্র মেনে চলবে ঢাকা? তাতে তাদের টিকে থাকা সহজ হতো কিনা! ( লেখক: অর্ণব সান্যাল, ঢাকা , সূত্র:-প্রথমআলো অনলাইন)