‘ঈমানদার পুরুষ এবং ঈমানদার স্ত্রীলোকেরাই প্রকৃতপক্ষে পরস্পর পরস্পরের দায়িত্বশীল বা সাহায্যকারী বন্ধু। এদের পরিচয় এবং বৈশিষ্ট্য এই যে, এরা নেক কাজের আদেশ দেয়, অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখে, নামাজ কায়েম করে এবং জাকাত আদায় করে, আল্লাহ ও রাসূলের বিধান মেনে চলে। প্রকৃতপক্ষে এদের প্রতিই আল্লাহ রহমত বর্ষণ করেন।’ (সূরা তাওবা-৭১)
আরবি ‘জার’ শব্দের অর্থ প্রতিবেশী। বাঁশঝাড়ের ‘ঝাড়’ শব্দটি আরবি ‘জার’ শব্দের সাথে ভাবার্থের দিক থেকে মিল রয়েছে। কারণ বাংলা অভিধানে ‘ঝাড়’ শব্দের অর্থ করা হয়েছে ঘন বৃক্ষাবলি। যেহেতু বাঁশগুলো পাশাপাশি অবস্থান করে তাই একে বাঁশঝাড় বলা হয়। বাঁশগুলো মিলেমিশে পাশাপাশি বসবাস করার দরুন ঝাড়ের মাধ্যমে বিভিন্ন ঝড়-তুফানকে মোকাবেলা করে টিকে থাকতে পারে। অন্যথায় একাকী একটি বাঁশ ফাঁকা জায়গায় সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হতো না। মানুষও নিজেদের অস্তিত্বের প্রয়োজনে সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করে। প্রতিবেশীদের সহযোগিতা ছাড়া কোনো মানুষই সমাজে বেশি দিন টিকে থাকতে পারে না। এ জন্য কুরআন ও হাদিসে প্রতিবেশীদের মধ্যে স¤প্রীতি, সহাবস্থান, ভ্রাতৃত্ববোধ, সমাজবদ্ধতা বা দলীয় জীবন ও ঐক্যের জন্য অত্যধিক গুরুত্ব দিয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিকটাত্মীয় ও এতিম-মিসকিনদের সাথে সদ্ব্যবহার করো। আত্মীয় প্রতিবেশী, অনাত্মীয় প্রতিবেশী, সঙ্গী-সাথী, মুসাফির এবং তোমাদের মালিকানাধীন দাস-দাসীদের প্রতি সদয় ব্যবহার করো।’ (সূরা নিসা-৩৬)
রাসূল সা: সামাজিক স¤প্রীতি ও সহাবস্থানকে ঈমানের সাথেও জুড়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন ‘সে মুমিন নয় যে পেটপুরে খেলো, অথচ তার প্রতিবেশী না খেয়ে রইল।’ হজরত আবু হোরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- একদা রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, ‘আমি আল্লাহর কসম করে বলছি, সে লোকটি ঈমানদার নয়, আমি আল্লাহর কসম করে বলছি, সে লোকটি ঈমানদার নয়, আমি আল্লাহর কসম করে বলছি, সে লোকটি ঈমানদার নয়, সাহাবিদের মধ্য থেকে একজন জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! লোকটি কে? হুজুর সা: বললেন, যার অনিষ্ট থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপদ থাকে না।’ (বুখারি-মুসলিম) উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত- নবী সা: বলেছেন, ‘জিবরাইল আ: নিয়মিতই আমাকে প্রতিবেশীর হক সম্পর্কে তাকিদ দিচ্ছিলেন। এমন কি আমার ধারণা জন্মেছিল, প্রতিবেশীকে সম্পত্তির হকদার বা উত্তরাধিকার করা হবে।’ (বুখারি-মুসলিম)
ইসলামই একমাত্র পারস্পরিক সাম্য-সংহতি, মানবিক প্রেম-প্রীতি, ভ্রাতৃত্বপূর্ণ ও সহানুভূতিশীল সমাজ উপহার দিয়েছে। ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার অধিবাসীরাই সামাজিক সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের এমন অনন্য নজির স্থাপন করেছে, যা পৃথিবীর অন্য কোনো ব্যবস্থায় পরিলক্ষিত হয় না। সামাজিক ভ্রাতৃত্ববোধ এমন একটি বিষয় যার ওপর ইসলামের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা বা সামাজিক কাঠামো অনেকাংশে নির্ভরশীল। এটি ছাড়া সহাবস্থানের চিন্তাই করা যায় না। চাই তা ছোট পারিবারিক পর্যায়ে হোক বা আন্তর্জাতিক পরিম-লেই হোক।
ইসলামের বিশ্বাস ও কর্ম কিভাবে স¤প্রীতি ও সহাবস্থানের শিক্ষা দিয়ে থাকে। যেমন-
তাওহিদ : তথা এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস থেকে ভ্রাতৃত্বের মূল্যবোধ উদ্ভূত। প্রত্যেকেই এক আল্লাহ ও রাসূল সা:-এ বিশ্বাসী এবং প্রত্যেকেই এক আদমের আ: বংশোদ্ভূত। কাজেই ভ্রাতৃত্ব, পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ও সৌহার্দ্য ঈমানেরই অঙ্গ। ঈমানের এই ঐক্য মানুষের সহাবস্থানের মানসিকতাকে সুসংহত করে।
নামাজ : প্রতিদিন নামাজ ধনী-দরিদ্র, রাজা-ফকির সবাইকে একই কাতারে একাকার করে মানুষে মানুষে ভেদাভেদকে নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে। সবাই এখানে একই রাজাধিরাজের কাছে ভিক্ষার হাতকে প্রসারিত করে থাকে। যে রাজাধিরাজ কোনো ব্যক্তির প্রভাব প্রতিপত্তি, বিশেষ মর্যাদা ও উঁচু-নিচুর শ্রেণিবিন্যাস করেন না এবং তাকেও কোনো ব্যক্তি কখনো তার বিশেষ মর্যাদার প্রভাবে প্রভাবিত করতে পারেন না।
জাকাত : সমাজে বিরাজমান ব্যাপক পার্থক্য হ্রাসের একটি কার্যকর প্রতিষ্ঠান। সমাজের অধিবাসীরা একাধারে নৈতিক, কল্যাণকামী এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন পরস্পরের বন্ধু। যেমন- আল কুরআনের ঘোষণা- ‘ঈমানদার পুরুষ এবং ঈমানদার স্ত্রীলোকেরাই প্রকৃতপক্ষে পরস্পর পরস্পরের দায়িত্বশীল বা সাহায্যকারী বন্ধু। তাদের পরিচয় এবং বৈশিষ্ট্য এই যে, এরা নেককাজের আদেশ দেয়, অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখে, নামাজ কায়েম করে এবং জাকাত আদায় করে, আল্লাহ ও রাসূলের বিধান মেনে চলে। প্রকৃতপক্ষে তাদের প্রতিই আল্লাহ রহমত বর্ষণ করেন।’ (সূরা তাওবা-৭১)
সাওম : রোজা তাকওয়াভিত্তিক সমাজ গঠন করে সামাজিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করে। হজরত ইবনে আব্বাস রা: রমজানে অন্যান্য সময় অপেক্ষা অধিক দয়ালু ও সহানুভূতিশীল হতেন। এ সময় কোনো প্রার্থী তার দুয়ার থেকে বঞ্চিত হতে পারত না।
হজ : বিশ্বজনীন ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টির এক বিশেষ ট্রেনিং এ হজ। কালো-ধলা, বর্ণবৈষম্যহীন এক বিশ্ব গঠনের লক্ষ্যে সবাই একই পোশাকে মাত্র দু’টুকরো কাপড় পরিধান করে দ্বীন-ভিক্ষুকের মতো আল্লাহর দরবারে হাজির হতে হয়। এখানেও কোনো ব্যক্তি বা দেশের বিশেষ মর্যাদা ও উঁচু-নিচুর শ্রেণিবিন্যাস করা হয় না।
আমাদের পারিবারিক কি সামাজিক, ব্যক্তিগত কি দলীয়, জাতীয় কি আন্তর্জাতিক জীবনে সহনশীলতা, সহমর্মিতা ও সৌহার্দ্যতা আজ হারাতে বসেছি। সামাজিক স¤প্রীতি ও সহাবস্থানের মধুর সম্পর্ক আজ ছিন্ন হয়ে গেছে। ফলে ক্রমান্বয়ে আমরা জাহিলিয়াত যুগের মতো একটি সার্বিক ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। এ ধ্বংসের কবল থেকে দেশ-জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে সবারই মুক্তির জন্য ইসলামের সামাজিক স¤প্রীতি ও সহাবস্থানের মহান শিক্ষা আমাদের গ্রহণ করতে হবে। লেখক : ম্যানেজার, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, জিন্দাবাজার শাখা, সিলেট।