কোনো মানুষ আল্লাহ তায়ালাকে বিশ্বাস করার সাথে সাথেই অর্থাৎ মুসলিম হওয়ার সাথে সাথে সে জান্নাতে চলে যাবে বিষয়টি এমন নয় বরং শরিয়তের বিধিবিধান, আদেশ-নিষেধ মানতে হবে। অর্থাৎ কুরআন ও হাদিস অনুযায়ী নিজেদের জীবনকে পরিচালনা করতে হবে, তা হলেই প্রতিটি মুসলমান জান্নাতে যেতে পারবে। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে কারিমে ইরশাদ করেন ‘আমি জিন ও ইনসানকে সৃষ্টি করেছি একমাত্র আমার ইবাদতের জন্য।’ (সূরা জিন আয়াত-০১) অন্য এক আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন ‘নিশ্চয় যারা ঈমান আনয়ন করবে এবং সৎকাজ করবে তাদের জন্য রয়েছে জান্নাতুল ফিরদাউস।’ (সূরা কাহফ আয়াত-১০৭) অন্য জায়গায় আল্লাহ তায়ালা সময়ের কসম করে ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয় সমস্ত মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত রয়েছে তবে শুধুমাত্র যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করে তারা ব্যতীত।’ (সূরা আসর আয়াত : ১-২-৩) এখানে ক্ষতি দ্বারা জান্নাত লাভ থেকে মাহরুম বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ তারা জান্নাতে যাবে না আর জান্নাতে যেতে হলে ঈমান আনতে হবে এবং তার সাথে সাথেই সৎকাজ করতে হবে। নতুবা জান্নাত পাওয়া যাবে না। তাই আমাদের করণীয় হলো পাপকাজ পরিত্যাগ করে সৎকাজ করা। এখানে এমন কিছু পাপকাজের কথা উল্লেখ করা হলো যেসব পাপকাজ পরিত্যাগ করা প্রতিটি মুসলমানদের জন্য আবশ্যক। কেউ যদি তা পরিত্যাগ না করে তা হলে তাকে এসব পাপকাজ জান্নাতে যাওয়ার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। এ ধরনের কিছু গুনাহ নিম্ন রূপ- * হারাম খাদ্য ভক্ষণকারী জান্নাতে যাবে না : হজরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেছেন, ‘যে দেহ হারাম খাদ্য দিয়ে লালিত-পালিত হয়েছে, তা জান্নাতে প্রবেশ করবে না। ’ (সুনানে বায়হাকি-৫৫২০) * আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে যাবে না : হজরত জুবাইর ইবনে মুতইম রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেছেন, ‘আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (সহিহ বুখারি-৫৫২৫)
* প্রতিবেশীকে কষ্ট দানকারী জান্নাতে যাবে না : হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যার অত্যাচার থেকে প্রতিবেশীরা নিরাপদ নয়, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (সহিহ মুসলিম-৬৬)
* মা-বাবার অবাধ্য সন্তান ও দাইয়ুস নারী জান্নাতে যাবে না : রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেন, ‘তিন শ্রেণীর লোক জান্নাতে যাবে নাÑ মা-বাবার অবাধ্য, দাইয়ুস (অর্থাৎ যে ব্যক্তি তার স্ত্রী-বোন প্রমুখ অধীনস্থ নারীকে বেপর্দা চলাফেরায় বাধা দেয় না) এবং পুরুষের বেশ ধারণকারী মহিলা।’ (মুসতাদরাকে হাকেম-২২৬)
* প্রতারণাকারী শাসক জান্নাতে যাবে না : হজরত মাকাল বিন ইয়াসার রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সা:কে বলতে শুনেছি, ‘মুসলমানদের ওপর প্রতিনিধিত্বকারী শাসক যদি এ অবস্থায় মারা যায় যে, সে তার অধীনস্থদের ধোঁকা দিয়েছে, তা হলে আল্লাহ তায়ালা তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন।’ (সহিহ বুখারি-৬৬১৮)
* অন্যের সম্পদ আত্মসাৎকারী জান্নাতে যাবে না : হজরত আবু উমামা রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি কসম করে কোনো মুসলমানের সম্পদ আত্মসাৎ করে, আল্লাহ তায়ালা তার জন্য জাহান্নাম ওয়াজিব করে দেন এবং জান্নাত হারাম করেন। এক ব্যক্তি বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! যদিও সামান্য কোনো জিনিস হয়? তিনি বললেন, ‘যদিও পিপুল গাছের একটি ছোট ডাল হোক না কেন।’ (সহিহ মুসলিম-১৯৬)
* চোগলখোর ব্যক্তি জান্নাতে যাবে না : হজরত হুজাইফা রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেন, ‘চোগলখোর জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (সহিহ মুসলিম-১৫১)
* গর্ব-অহঙ্কারী জান্নাতে যাবে না : হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেন, ‘যার অন্তরে অণু পরিমাণ অহঙ্কার রয়েছে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (সহিহ মুসলিম-১৩১)
* রাসূলুল্লাহ সা:-এর নাফরমান জান্নাতে যাবে না : হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেন, ‘আমার সব উম্মত জান্নাতে যাবে, কিন্তু সে ব্যক্তি নয়, যে (জান্নাতে যেতে) অস্বীকার করেছে।’ সাহাবিরা আরজ করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! কে অস্বীকার করেছে? তিনি বললেন, ‘যে আমার আনুগত্য করে, সে জান্নাতে যাবে। আর যে আমার নাফরমানি করে, সে (জান্নাতে যেতে) অস্বীকার করেছে।’ (সহিহ বুখারি-৬৭৩৭)
* অকারণে তালাক কামনাকারী নারী জান্নাতে যাবে না : হজরত সাওবান রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেন, ‘যে নারী তার স্বামীর কাছে অকারণে তালাক কামনা করে, সে জান্নাতের সুঘ্রাণও পাবে না।’ (তিরমিজি-১১০৮)
* ওয়ারিশকে বঞ্চিতকারী জান্নাতে যাবে না : রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো ওয়ারিশকে তার অংশ থেকে বঞ্চিত করল, আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাতের অংশ থেকে বঞ্চিত করবেন।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ-২৬৯৪)
* উপকার করে খোটা দেয়া ব্যক্তি জান্নাতে যাবে না।
রাসূল সা: বলেছেন, ‘সে ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না যে উপকার করে খোটা দেয়।’ (সুনান নাসায়ি-৫৬৮৮, সহিহ আলবানি)
* বিশ্বাসঘাতক শাসক জান্নাতে প্রবেশ করবে না : রাসূল সা: বলেছেন, ‘যাকে আল্লাহ তায়ালা জনসাধারণের শাসনকর্তা হিসেবে দায়িত্ব অর্পণ করেছেন, কিন্তু সে জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে এবং বিশ্বাসঘাতক অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে তাহলে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন।’ (সহিহ মুসলিম-১৪২) * আত্মহত্যাকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না : নবী করিম সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিজেকে পাহাড়ের ওপর থেকে নিক্ষেপ করে আত্মহত্যা করবে, সে জাহান্নামে যাবে। সেখানে সর্বদা সে ওইভাবে নিজেকে নিক্ষেপ করতে থাকবে অনন্তকাল ধরে। যে ব্যক্তি বিষপান করে আত্মহত্যা করবে, সে তার বিষ তার হাতে থাকবে। জাহান্নামে সর্বদা সে ওইভাবে নিজেকে বিষ খাইয়ে মারতে থাকবে অনন্তকাল ধরে। যেকোনো ধারালো অস্ত্র দিয়ে আত্মহত্যা করেছে তার কাছে জাহান্নামে সে ধারালো অস্ত্র থাকবে যা দিয়ে সে সর্বদায় নিজের পেটকে ফুঁড়তে থাকবে।’ (সহিহ বুখারি-৫৪৪২, মুসলিম)
খ. এবং ওই সব উলঙ্গ-অর্ধ উলঙ্গ নারী যারা (নিজেদের চলাফেরা ও বেশভূষায়) মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করবে এবং নিজেরাও অন্য মানুষের প্রতি আকৃষ্ট হবে। তাদের মাথায় উটের মতো উঁচু এবং একপাশে ঝুঁকে থাকা চূড়ার মতো চুলের খোপ শোভা পাবে। এসব নারী জান্নাতে তো যাবেই না, বরং জান্নাতের সুঘ্রাণও পাবে না। অথচ এত এত দূর থেকে জান্নাতের সুঘ্রাণ পাওয়া যায়।’ (সহিহ মুসলিম-২১২৮)
অন্য বর্ণনায় আছেÑ আম্মার ইবনে ইয়াসার রা: থেকে বর্ণিত- রাসূল সা: বলেছেন, ‘তিন শ্রেণীর মানুষ কখনো জান্নাতে যাবে না- ১. যে ব্যক্তি তার পরিবারকে বেহায়াপনার সুযোগ দেয়; ২. পুরুষের বেশধারী নারী এবং ৩. নিয়মিত নেশাদার দ্রব্য সেবনকারী। লেখক : খতিব, মসজিদে বাইতুন নূর, মাওনা, গাজীপুর