রাজধানী ঢাকার জলাবদ্ধতা দূর করতে ওয়াসার মালিকানাধীন ২৬টি খাল সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এরই মধ্যে খালগুলো পরিষ্কার করে পানির প্রবাহ ফিরিয়ে আনা হয়েছে। তবে এর পরেও নগরীর জলাবদ্ধতা উল্লেখযোগ্য হারে কমছে না। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেবল খাল আর ড্রেনের ওপরে নির্ভর করলে চলবে না। প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে পানি নিষ্কাশনের পথ ও উন্মুক্ত জায়গা সৃষ্টি করতে হবে।
জানা গেছে, বর্তমানে রাজধানীতে ৪৩টির মতো খাল রয়েছে। এরমধ্যে ঢাকা ওয়াসার ২৬টি খালের দায়িত্ব দুই সিটি করপোরেশনকে দেওয়া হয়েছে। বাকি ১৭টির দায়িত্ব এখনও গণপূর্ত, রাজউক, পাউবো ও জেলা প্রশাসকের কাছে রয়েছে। এ ছাড়া দাফতরিকভাবে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের দায়িত্ব এখনও ঢাকা ওয়াসার। প্রশাসনিক এই জটিলতার মাঝেও বৃষ্টির পানি নিরসনে কাজ করছে দুই সিটি করপোরেশন। ফলে এর কিছুটা সুফল পাওয়া গেলেও ভোগান্তি একেবারে কমেনি। গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকা ওয়াসার মালিকানাধীন ২৬টি খালের দায়িত্ব দুই সিটি করপোরেশনকে দেওয়া হয়। এর মধ্যে ১১টি খাল দক্ষিণ সিটি এবং বাকি ১৫টি খাল উত্তর সিটি এলাকার মধ্যে পড়েছে। এরপর থেকেই নিজস্ব অর্থায়নে খাল পরিষ্কারে কোমর বেঁধে মাঠে নামে সংস্থা দুটি। এ কাজে দুই সিটি করপোরেশনের প্রায় ২০০ কোটি টাকার ওপরে খরচ হয়েছে। খালগুলো থেকে অপসারণ করা হয়েছে লাখ লাখ টন আবর্জনা। কিন্তু কাজের কাজ তেমন কিছু হয়নি বলে মনে করেন নগর বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, শুধু খাল পরিষ্কার করলেই জলাবদ্ধতা কমবে না। এজন্য সামগ্রিক ও সমন্বিতভাবে ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করতে হবে। উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম জানান, গত ৩ মে পর্যন্ত ডিএনসিসি এলাকার খাল হতে স্কেভেটর ব্যবহারের মাধ্যমে ১১ হাজার ৬৩৮ টন ভাসমান বর্জ্য ও ৫ হাজার ৮০০ টন কঠিন বর্জ্য অপসারণ করা হয়েছে। বর্তমানে সবকটি খালের প্রবাহ সচল রয়েছে। খালের প্রবাহ আরও বৃদ্ধি করতে ইতোমধ্যে ২টি ফ্লোটিং টাইপ স্কেভেটর ভাড়ায় ব্যবহার করা হচ্ছে। পাশাপাশি ২১ হাজার ৮৪৩ জন পরিচ্ছন্নতা কর্মীকে খাল পরিষ্কার কাজে নিয়োগ করা হয়েছে।
অপরদিকে দক্ষিণ সিটির মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দায়িত্ব পাওয়ার পর জিরানি, মান্ডা, শ্যামপুর, কালুনগর খালসহ প্রতিটি খালের শাখা-প্রশাখা এবং পান্থপথ ও সেগুনবাগিচা বক্স কালভার্ট থেকে আমরা বর্জ্য অপসারণ কার্যক্রম শুরু করেছি। ইতোমধ্যে এসব খাল ও বক্স কালভার্ট থেকে ১ লাখ ৩ হাজার ৫০০ মেট্রিক টনের বেশি বর্জ্য ও ৬ লাখ ৭৯ হাজার মেট্রিক টন পলি অপসারণ করেছি।’ তিনি বলেন, ‘এছাড়া ওয়াসার কাছ থেকে বুঝে পাওয়া অচল দুটি পাম্প স্টেশনের তিনটি পাম্প মেশিন সচল করতে সক্ষম হয়েছি। বাকি ৩টি সচল করতে জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। একইসঙ্গে খালের অবৈধ দখলে থাকা অংশ উদ্ধার করেছি। খালের প্রবাহ এখন দৃশ্যমান।’ রাজধানীতে জলাবদ্ধতা প্রসঙ্গে উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অন্যান্য বছর সামান্য বৃষ্টিতেই ডিএনসিসির বিভিন্ন এলাকার রাস্তা-ঘাট ডুবে যেতো, জলজটে নগরবাসীকে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হতো। কিন্তু এবার রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিতেও নগরবাসীকে জলজটের সমস্যায় ভুগতে হচ্ছে না। দায়িত্বে নেওয়ার পর জলজটের ভোগান্তি থেকে নগরবাসীকে মুক্ত রাখতে পেরেছি।’
তিনি বলেন, ‘আগে সামান্য বৃষ্টি হলেই নৌবাহিনীর সদর দফতর, প্রধান সড়ক, গলফ হাইট প্রধান সড়ক, সেতু ভবন প্রধান সড়ক, নাখাল পাড়া, কালা চাঁদপুর, বারিধারা, বেগম রোকেয়া সরণি, কচুক্ষেত, আনসার ক্যাম্প, দারুস সালাম রোড, মগবাজার, বেপারি পাড়া, উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টরসহ ডিএনসিসির বিভিন্ন এলাকায় জলজট হতো। কিন্তু এখন তা আর হচ্ছে না। আমরা কথায় নয়, কাজে বিশ্বাসী বলেই পহেলা জুন ঢাকায় দীর্ঘ সময় ধরে ৮৫ মিলিমিটার পরিমাণ বৃষ্টিপাত হলেও দ্রুততম সময়ের মধ্যেই নগরবাসীকে জলজট থেকে মুক্ত করা সম্ভব হয়েছে।’ দক্ষিণের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ‘সাধারণত কোনও স্থানে তিন ঘণ্টার বেশি পানি থাকাকে জলাবদ্ধতা হিসেবে ধরা হয়। বেশ কয়েকটি জায়গায় জলজট হলেও বিগত সময়ের জলজটের পরিমাণ ও স্থানের সংখ্যার তুলনায় এখন তা অনেকাংশেই কম। আমরা ৩ ঘণ্টার মধ্যে প্রায় শতভাগ পানি সরাতে সক্ষম হচ্ছি। যদিও আমাদের লক্ষ্য হলো— এক ঘণ্টার মধ্যে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন করা।’
তবে দুই সিটির মেয়রই নগরীতে জলাবদ্ধতার বিষয়টি মানতে রাজি না হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। সামান্য বৃষ্টি হলেই নগরীর বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা যায়। দক্ষিণ সিটির পুরনো অংশে এখনও জলাবদ্ধতাপ্রবণ এলাকা হিসেবে ৫৫টি স্থানকে চিহ্নিত করেছে সংস্থাটি। আপরদিকে উত্তর সিটি তাদের ডিজিটাল সার্ভের মাধ্যমে জলাবদ্ধতাপ্রবণ ১০৩টি স্পট চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে ৬টি হট স্পট রয়েছে। এগুলোর পানি কীভাবে নিষ্কাশন করা যায়, সেই পথ খুঁজছে সংস্থাটি। এরমধ্যে সব চেয়ে বেশি হচ্ছে রোকেয়া স্মরণির পশ্চিম কাজীপাড়ায়।
নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি আদর্শ বা বাসযোগ্য শহরে কমপক্ষে ৪০ ভাগ উন্মুক্ত এলাকা থাকা অবশ্যক। কিন্তু ঢাকায় ছিল মাত্র ১৮ ভাগ। এর মধ্যে মূল শহরে উন্মুক্ত জায়গার পরিমাণ ১০ ভাগেরও কম। বর্ষায় যেসব এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা যাচ্ছে, সেসব এলাকায় উন্মুক্ত জায়গা বা মাটির অস্তিত্ব কম। সে কারণেই আবদ্ধ পানি মাটির শোষণ করে নিতে পারছে না বলে মনে করেন নগর বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শুধু খাল পরিষ্কার করলেই জলাবদ্ধতা নিরসন হবে না। এই চিন্তা থেকে সিটি করপোরেশনকে বেরিয়ে আসতে হবে। নগরীতে কংক্রিটের আস্তর বাদ দিয়ে উন্মুক্ত জায়গা সংরক্ষণ করতে হবে। প্রাকৃতিক পদ্ধতির সঙ্গে সমন্বয় করে পরিকল্পনা করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘জলাবদ্ধতার সমাধান চাইলে ২০-২৫ ভাগ সবুজায়ন থাকতে হবে। কমপক্ষে ৪০ ভাগ উন্মুক্ত এলাকা লাগবে। কিন্তু গত বছর পর্যন্ত আমাদের তা ছিল মাত্র ১৮ ভাগ। এর মধ্যে মূল শহরে এ ধরনের জায়গার পরিমাণ ১০ ভাগেরও কম। আজ যেসব এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা যাচ্ছে, সেসব এলাকায় উন্মুক্ত জায়গা বা মাটির অস্তিত্ব নেই। মূলত বৃষ্টির পানি পড়ার পর কিছু অংশ মাটি শোধন করবে, কিছু গাছপালা নেবে। বাকি পানি ড্রেন ও খাল হয়ে নদীতে যাবে। কিন্তু আমাদের এসব ব্যবস্থা নেই বলেই জলাবদ্ধতা হয়।’-বাংলাট্রিবিউন