পবিত্র কুরআন মাজিদে বজ্রপাত প্রসঙ্গে ‘বারক’ ‘রাআদ’ ‘সয়েকা’ ‘রাজফাহ’ ‘সইহাহ’ ‘তগিয়াহ’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। আমরা বজ্রপাত বলতে যা বুঝি পবিত্র কুরআনে প্রথম তিনটি শব্দ দ্বারাই তা বোঝানো হয়েছে। স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত মহান আল্লাহর রহমত হলেও ঝঞ্ঝাবায়ু চালিত অবিরত বৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়, তুফান, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি আল্লাহর গজব। সাধারণভাবে বৃষ্টি চলা অবস্থায় কিংবা বৃষ্টি শুরুর প্রথমে কিংবা শেষে বজ্রপাত হয়। অনেক সময় স্বচ্ছ আকাশ থেকে হঠাৎ বজ্রপাত হয়। মুহাক্কিক ওলামায়ে কেরাম, আকস্মিক কিংবা বৃষ্টি চলাকালীন ব্যাপক বজ্রপাতকে আল্লাহর গজব বলে অবিহিত করেন। তারা এ বজ্রপাত ‘জুনদুন মিন জুনুদিল্লাহ’ নামে অবিহিত করেন।
পবিত্র কুরআনের বজ্রপাত প্রসঙ্গ : স্বাভাবিক বৃষ্টি, বজ্রপাত প্রসঙ্গ পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে- এ বিষয়ে মহান আল্লাহ পাক বলেন, ‘তার আরো নিদর্শন, তিনি তোমাদেরকে দেখান বিদ্যুৎ, ভয় ও ভরসার জন্য এবং আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেন, অতঃপর তদ্বারা ভূমির মৃত্যুর পর তাকে পুনরুজ্জীবিত করেন। নিশ্চয় এতে বুদ্ধিমান লোকদের জন্য নিদর্শনাবলি রয়েছে’ (সূরা আর রুম, আয়াত-২৪)।
বজ্রপাত আল্লাহ তায়ালার শক্তির নিদর্শনগুলোর একটি, যা তিনি তাঁর প্রিয় বান্দাদের হুঁশিয়ার ও সাবধান করার জন্য রেখেছেন। তিনি চাইলেই যে কাউকে এর মাধ্যমে যেকোনো সময় শাস্তি দিতে পারেন। যদিও সব ক্ষেত্রে পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালা এমনটি করেন না। যা আল্লাহ তায়ালা নিজেই পবিত্র কুরআনে কারিমে বলেন, ‘তাঁর প্রশংসা পাঠ করে বজ্র এবং সব ফেরেশতা, সভয়ে। তিনি বজ্রপাত করেন, অতঃপর যাকে ইচ্ছা, তাকে তা দ্বারা আঘাত করেন; তথাপি তারা আল্লাহ সম্পর্কে বিত-া করে, অথচ তিনি মহাশক্তিশালী’ (সূরা রাদ, আয়াত-১৩)।
বজ্রপাত দ্বারা শাস্তি প্রদান : তাফসিরে মাজহারিতে বর্ণিত আছে- একবার আমের বিন তুফাইল আমেরি এবং আরবাদ বিন রবিয়া আমেরি রাসূল সা:-এর কাছে গেল। তারা রাসূল সা:কে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল। আমের রাসূল সা:কে বলল, ‘আপনি একটু উঠুন, আপনার সাথে একান্তে আলাপ করতে চাই।’ আমের তার সাথী আরবাদকে আরো বলে রেখেছিল যে, মুহাম্মদ যখন আমার সাথে আলাপে মগ্ন থাকবে, তখন তুমি অতর্কিতে পেছন থেকে তাকে তলোয়ারের আঘাত করে শেষ করে দেবে। আরবাদ সুযোগ বুঝে রাসূল সা:-এর পেছনে চলে এলো, কিন্তু খাপ থেকে কিছুতেই তলোয়ার বের করতে পারল না। বারবার চেষ্টা করেও বিফল হলো। তখন অকস্মাৎ বজ্রপাত হলো এবং সে বজ্র পড়ল পাপিষ্ঠ আরবাদের মাথার ওপর। বজ্রাহত হয়ে সে নিমেষেই মারা গেল। ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল আমের কিন্তু পালাতে পালাতে সে বলছিল যে, সে রণকুশলী লোকদের দিয়ে এই উপত্যকা ভরে ফেলবে (অর্থাৎ রাসূল সা:-এর বিরুদ্ধে তারা প্রচ- যুদ্ধ করার ঘোষণার মনস্থির করতে লাগল)। পরদিন তার উরুর উপরে একটি বড় ফোঁড়া হয় এবং সে ঘোড়ার পিঠে মৃত্যুবরণ করে (তাফসিরে মাজহারি, ষষ্ঠ খ-; পৃষ্ঠা-২৯৮)।
যুগে যুগে বজ্রপাত কিংবা বজ্রনিনাদ দ্বারা শাস্তি : বিভিন্ন জাতির লোকেরা নবী-রাসূলদের প্রচারিত বাণীকে সহজে মেনে নিত না, তাঁদেরকে নবী বা রাসূল হিসেবে স্বীকার করত না। তারা নবী-রাসূলদেরকে চ্যালেঞ্জ করে বসত। তখন আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রেরিত নবী-রাসূলদের সত্যতার জন্য বিভিন্ন মুজিজা কিংবা শাস্তি দ্বারা তাদেরকে পরাভূত করেন। পবিত্র কুরআনে হজরত মূসা আ: এবং তাঁর জাতির লোকদের সম্পর্কে বর্ণনা রয়েছে, আল্লাহ পাক বলেন, ‘আর স্মরণ করো, যখন তোমরা বলেছিলে, হে মূসা আমরা আল্লাহকে প্রকাশ্যভাবে না দেখা পর্যন্ত তোমাকে কখনো বিশ্বাস করব না, ফলে তোমাদেরকে বজ্র পাকড়াও করল, যা তোমরা নিজেরাই দেখছিলে’ (সূরা আল বাকারাহ, আয়াত-৫৫)। তাফসিরে এসেছে, ‘তুর পাহাড়ে তাওরাত আনতে যাওয়ার সময় মূসা আ: ৭০ জন লোককে সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন। প্রত্যাবর্তনকালে তারা মূসা আ:কে বলল, মহান আল্লাহকে প্রকাশ্যে না দেখা পর্যন্ত আমরা তোমার কথা বিশ্বাস করার জন্য প্রস্তুত নই। তাই শাস্তিস্বরূপ তাদের ওপর বজ্রপাত হয় এবং তারা মারা যায়। আর তাদের প্রত্যক্ষ করার অর্থ হলো- প্রথমে যাদের ওপর বজ্রপাত হয়েছিল শেষের লোকেরা তা প্রত্যক্ষ করছিল এবং দেখতে দেখতে সবাই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল (তাফসিরে আহসানুল বায়ান)।
আল্লাহ পাক আরো বলেন, ‘কিতাবিগণ আপনার কাছে তাদের জন্য আসমান থেকে একটি কিতাব নাজিল করতে বলে; তারা মূসার কাছে এর চেয়েও বড় দাবি করেছিল। তারা বলেছিল, আমাদেরকে প্রকাশ্যে আল্লাহকে দেখাও। ফলে তাদের সীমালঙ্ঘনের কারণে তাদেরকে বজ্র পাকড়াও করেছিল; তারপর স্পষ্ট প্রমাণ তাদের কাছে আসার পরও তারা বাছুরকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করেছিল; অতঃপর আমরা তা ক্ষমা করেছিলাম এবং আমরা মূসাকে স্পষ্ট প্রমাণ দিয়েছিলাম’ (সূরা আন নিসা, আয়াত-১৫৩)। উল্লেখ্য, এ আয়াতটিও কওমে মূসা আ:-এর কৃতকর্ম এবং তাদের প্রতি শাস্তি প্রসঙ্গে বর্ণিত হয়েছে।
হজরত হুদ আ:-এর জাতি সামুদ। আল্লাহ পাক সামুদ জাতিকেও বজ্রপাতের শাস্তিতে ধ্বংস করেছেন, এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনের বর্ণনা, আল্লাহ পাক বলেন, ‘অতঃপর তারা তাদের রবের আদেশ মানতে অহঙ্কার করল; ফলে তাদেরকে পাকড়াও করল বজ্রপাত এবং তারা তা দেখছিল’ (সূরা আজ জারিয়াত, আয়াত-৫১)।
বজ্রপাত থেকে বাঁচার আমল : আকাশ যখন মেঘাচ্ছন্ন হয়ে কালো বর্ণ ধারণ করত তখন রাসূল সা: বেশি বেশি এ দোয়া পড়তেন, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা খাইরাহা ওয়া খাইরা মা-ফিহা ওয়া খাইরা মা-উরসিলাত বিহি, ওয়া আউজুবিকা মিন শাররিহা ওয়া শাররি মা-ফিহা ওয়া শাররি মা-উরসিলাত বিহি।’ অর্থাৎ, হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে এ বৃষ্টির মাধ্যমে প্রেরিত সমূহ কল্যাণ প্রার্থনা করছি, আর এ বৃষ্টির মাধ্যমে প্রেরিত সমূহ বিপদাপদ থেকে পরিত্রাণ চাই’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস-৩২০৬)।
হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- রাসূল সা: বলেন, ‘তোমাদের প্রবল পরাক্রমশালী প্রভু ইরশাদ করেন, ‘যদি আমার বান্দারা আমার বিধান মেনে চলত, তবে আমি তাদের রাতের বেলায় বৃষ্টি দিতাম, সকাল বেলায় সূর্য দিতাম এবং কখনো তাদের বজ্রপাতের আওয়াজ শুনাতাম না’ (মুসনাদে আহমাদ-৮৭০৮)। এ হাদিস দ্বারা স্পষ্ট হলো যে, বজ্রপাত বাঁচার সর্বশ্রেষ্ঠ আমল হলো ‘আল্লাহর সব বিধানকে ইখলাসের সাথে যথাযথভাবে সঠিক সময়ে এহতেমামের সাথে পালন করা।
বজ্রপাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রিয় নবী সা: তাঁর উম্মতদের বিভিন্ন দোয়া শিখিয়েছেন। হজরত আবদুুল্লাহ ইবনে ওমর রা: তাঁর বাবা থেকে বর্ণনা করেন, রাসূল সা: যখন বজ্রের শব্দ শুনতেন তখন বলতেন, ‘আল্লাহুম্মা লা তাকতুলনা বিগজাবিকা ওয়ালা তুহলিকনা বিআজাবিকা ওয়া আ-ফিনা কবলা জালিকা।’ অর্থাৎ, হে আল্লাহ তুমি তোমার গজব দ্বারা আমাদেরকে মেরো না, তোমার আজাব দ্বারা আমাদেরকে ধ্বংস করে দিও না, আর আমাদেরকে এর আগেই নিরাপত্তা দান করো’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস-৩৪৫০)। এ দোয়াটি কেবল বজ্রপাত নয় বরং সব বিপদাপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মহৌষধস্বরূপ।
লেখক : মুহাদ্দিস, নোয়াখালী কারামাতিয়া কামিল মাদরাসা, সোনাপুর, সদর, নোয়াখালী।