রবিবার, ১০ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:৫০ অপরাহ্ন

পানির অভাবে হাওরে মাছের প্রজনন ব্যাহত

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় শনিবার, ২৬ জুন, ২০২১

বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী এখন আষাঢ় মাস। সাধারণত বছরের এ সময় হাওরসহ দেশের নদ-নদীগুলো পানিতে ভরপুর থাকে। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। এবার আষাঢ় মাসেও পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়ায় হাওরে পানি নেই। নতুন পানি প্রবেশ না করায় পিছিয়ে পড়ছে দেশী মাছের প্রজনন। ফলে জেলাজুড়ে দেখা দিয়েছে দেশী মাছের আকাল।
সরকারি হিসাবে প্রতি বছর হাওরে প্রায় ১ লাখ ২ হাজার টন মাছ উৎপাদন হয়। চলতি অর্থবছরে সেটি ১ লাখ ৩ হাজার টনে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নেয়া হয়েছিল। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভারি বৃষ্টি না হওয়ায় লক্ষ্য অর্জন নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। তার ওপর অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ দেয়ায় অতিরিক্ত পানিও ঢুকতে পারছে না। পানি না হওয়ায় মাছের জন্য এটা একটা অশনিসংকেত। পর্যাপ্ত পানির অভাবে মাছের প্রজনন কার্যক্রম এরই মধ্যে পিছিয়ে গেছে। আবার একটি নির্দিষ্ট সময় পর হাওরের পানি কমতে থাকে। এ অবস্থায় মাছগুলো বড় হওয়ার সুযোগ পাবে না। তাই দেশী মাছের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিয়ে শঙ্কা রয়েই যাচ্ছে।
গত বছর জুনে দুই দফা বন্যায় প্লাবিত হয় সুনামগঞ্জ জেলা। সে সময় পানিতে টইটম্বুর ছিল নদ-নদীসহ হাওরগুলো। গত জুনেও নদীর পানি বর্তমান সময়ের চেয়ে দেড়-দুই মিটার বেশি ছিল। গত বছরের ২৬ জুন নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার ৭০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এর আগে ২০১৯ সালের একই সময়ে বন্যায় প্লাবিত ছিল সুনামগঞ্জ। কিন্তু এবার তার উল্টো। পানির দেখা নেই হাওরে।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সবিবুর রহমান বলেন, সীমান্তবর্তী ভারতের মেঘালয় ও বারাক অঞ্চলে অতি বৃষ্টিপাত হলে সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতি দেখা দেয়। এ বছর ভারতের অঞ্চল দুটিতে পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়ায় বাংলাদেশের নদ-নদীতেও বৃষ্টি ও বন্যার পানি আসেনি। তবে এবার বর্ষার শেষের দিকে জেলায় বন্যা পরিস্থিতি হতে পারে বলেও জানান তিনি।
স্থানীয় মৎস্যজীবীরা জানান, জেলায় বৃষ্টিপাত ও বন্যা না হওয়ায় হাওরে পানি নেই। পানি না থাকায় মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। আবার মাছের প্রজননও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে বিপদে পড়েছেন তারা। কারণ হাওরের মাছই তাদের জীবিকার একমাত্র উৎস। এমন পরিস্থিতিতে হাওরাঞ্চলের মৎস্যজীবীদের প্রণোদনার মাধ্যমে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন তারা।
দেখার হাওর পাড়ের বাসিন্দা নূর মোহাম্মদ বলেন, হাওরে পানি নেই বললেই চলে। পানি না থাকায় এলাকায় দেশী মাছ পাওয়া যায় না। গত মার্চ থেকে ১৭ জুন পর্যন্ত বাজারে গিয়ে মাত্র একদিন দেশী মাছ পেয়েছেন বলে জানান তিনি। তাছাড়া বাজারে মাছের দামও বেশি, যা পাওয়া যায় তার সবই চাষের মাছ।
স্থানীয় জেলে আব্দুর রহিম বলেন, অন্যান্য বছর হাওরে জাল ফেললে দৈনিক ৭০০-৮০০ টাকার মাছ পাওয়া যেত। এ বছর সারা দিন জাল দিয়ে মাছ মেরেও ২০০ টাকার মাছ পাওয়া যায় না। এর মূল কারণ হাওরে পানি না থাকা। নতুন পানি না আসায় মাছের পোনা উৎপাদন হচ্ছে না। ফলে তার মতো যারা হাওরের মাছের ওপর নির্ভরশীল, তারা বিপদে পড়েছেন।
আলাল উদ্দিন নামের এক জেলে জানান, দেখার হাওরে সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত জাল ফেলেছেন তিনি। কিন্তু সারা দিনে ১৫০-২০০ টাকার মাছও ধরতে পারেননি। এর আগের বছর হাওরে ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে ৫০০ টাকার মাছ ধরা গেছে। এমন চলতে থাকলে হাওরে দেশী মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
উন্নয়ন সংস্থা হাওর এরিয়া আপলিফটমেন্ট সোসাইটির (হাউস) নির্বাহী পরিচালক সালেহিন চৌধুরী শুভ বলেন, অন্য সময় বছরে দুবার বন্যা হয় সুনামগঞ্জ জেলায়। এ বছর বন্যা তো দূরের কথা এখন পর্যন্ত ভালো করে বৃষ্টিও হয়নি। এটা মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। কোনো বছর খুব বেশি বৃষ্টিপাত হবে, বন্যা হবে। আবার কোনো বছর বৃষ্টিহীন থাকবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবটা আগামী কয়েক বছর অবিন্যস্ত থাকবে। এরপর হয়তো জলবায়ু একটি স্থায়ী রূপ পাবে ও ঋতুচক্র পুরো পাল্টে যাবে। এ বছর বৃষ্টিহীনতার কারণে হাওরে কোনো পানি হয়নি। পানি না হওয়ার কারণে মাছের প্রজনন ব্যাপকভাবে বিঘিœত হয়েছে। ফলে দেশী জাতের মাছের আকাল দেখা দিয়েছে। একই সঙ্গে হাওরের ফসল রক্ষার জন্য নির্মিত বাঁধগুলোতে ফিশ পাসের ব্যবস্থা না থাকায় মাছের যে স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ সেটাও বন্ধ হয়ে গেছে। মূলত বৃষ্টি না হওয়া ও ফিশ পাসের ব্যবস্থা না থাকার কারণেই মাছের প্রজনন ব্যবস্থায় বিঘœ ঘটছে। ভবিষ্যতে বাঁধ তৈরির সময় পর্যাপ্ত ফিশ পাসের ব্যবস্থা রাখার ওপর জোর দেন এ কর্মকর্তা। তিনি বলেন, নদ-নদী থেকে হাওরে আর হাওর থেকে নদ-নদীতে মাছের অবাধ চলাচলের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। তাহলে হাওরের মাছের প্রজনন বৃদ্ধি পাবে।
এ ব্যাপারে সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সীমা রানী বিশ্বাস বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের নানা প্রভাব আমরা এখন দেখছি। এ বছর বৃষ্টিপাত কম হওয়াও জলবায়ু পরিবর্তনেরই প্রভাব। এবার হাওরে অল্প অল্প বৃষ্টির পানি ঢুকেছে। এটা মাছের জন্য অশনিসংকেত। পানি না হওয়ায় মাছ বংশবিস্তার করতে পারছে না। এতে হাওরে এবার মাছের প্রজনন পিছিয়ে যাবে।
পানিস্বল্পতার পাশাপাশি মাছের বংশবিস্তারের সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে হাওরে অপ্রয়োজনীয় ফসল রক্ষাবাঁধের কথা উল্লেখ করেন এ মৎস্য কর্মকর্তা। তিনি বলেন, বাঁধগুলোর কারণে আমাদের দেশী মাছগুলো ডিম ছাড়ার জন্য তার কাঙ্ক্ষিত জায়গায় পরিভ্রমণ করতে পারছে না। ফলে পাবদা, গোলশা, কৈ, মাগুরসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ যথাস্থানে ডিম ছাড়তে পারছে না।
তার পরও সবাই মিলে চেষ্টা করে মৎস্যজীবীদের পোনা রক্ষার বিষয়টি বোঝাতে, কোনা জাল ও কারেন্ট জালের ব্যবহার বন্ধ রাখতে পারলে এখনো দেশী মাছ বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব বলে মন্তব্য করেন সীমা রানী বিশ্বাস। তিনি বলেন, হাওরের মাছের পাশাপাশি আমরা দেশী মাছ চাষেও খামারিদের উদ্বুদ্ধ করছি। যেহেতু আমরা প্রাকৃতিকভাবে বিপর্যয়ের দিকে পড়ে গেছি, সেহেতু দেশী মাছ চাষের মাধ্যমে পুষ্টির চাহিদা মেটাতে হবে।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com