মানবজাতিকে আল্লাহ তায়ালা দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন তাঁর ইবাদতের জন্য, তাঁকে সন্তুষ্ট করার জন্য, তার গোলামি করার জন্য। আখিরাতে সুখে থাকতে দুনিয়া থেকে সামান তৈরির জন্যই দুনিয়াতে আমাদের পাঠানো হয়েছে। কুরআন ও হাদিসে বিভিন্ন আঙ্গিকে এ বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি মানব, দানবকে কেবল আমার উপাসনার জন্যই সৃষ্টি করেছি’ (সূরা জারিয়াত-৫৬)। অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনি জীবন, মৃত্যুকে সৃষ্টি করেছেন যেন তোমাদের কে সবচেয়ে সুন্দর আমল করতে পারে সেটা পরীক্ষা করতে পারেন’ (সূরা মূলক-২)। কিন্তু দুনিয়াতে এসে মানুষ বিভিন্ন কারণে সৃষ্টিকর্তার অবাধ্যতায় লিপ্ত হয়ে যায়। শয়তান তাকে কুমন্ত্রণা দিয়ে সত্যপথ থেকে সরিয়ে দেয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয় শয়তান প্রকাশ্য শত্রু এবং পথভ্রষ্টকারী’ (সূরা কাসাস-১৫)। পথভ্রষ্ট হয়ে মানুষ গুনাহ করে। কখনো বড় গুনাহ তো কখনো ছোট গুনাহ। সব ধরনের গুনাহ থেকেই বেঁচে থাকা আবশ্যক। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তোমরা প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সব ধরনের গুনাহ ছেড়ে দাও। নিশ্চয়ই যারা গুনাহ করবে অচিরেই তাদেরকে কৃতকর্মের প্রতিফল দেয়া হবে’ (সূরা আনআম-১২০)।
ছোট গুনাহ তথা সগিরা গুনাহ তো বিভিন্ন নেকআমলে মাফ হয়ে যায়। যেমনÑ হাদিসে এসেছে, ‘নিশ্চয় সালাত কবিরা গুনাহ ছাড়া অন্যান্য পাপ মোচন করে’ (আরিজাতুল আহওয়াজি ২/১৪৬)।
তাছাড়া কবিরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার দ্বারাও সগিরা গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘যদি তোমরা কবিরা গুনাহ থেকে বিরত থাকো তো তোমাদের সগিরা গুনাহগুলো আমি মাফ করে দেবো’ (সূরা নিসা-৩১)। সগিরা গুনাহ অসংখ্য অগণিত। সেগুলোর সংখ্যা নিয়ে কোনো আলোচনা কোথাও নেই। আর কবিরা গুনাহেরও নির্দিষ্ট কোনো সংখ্যা বলা যায় না। ইবনে আব্বাস রা:কে একবার কবিরা গুনাহের সংখ্যা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেছেন, কবিরা গুনাহ প্রায় ৭০টি (তাখরিজু শরহিস সুন্নাহ ১/৮৭)।
বিভিন্ন হাদিসে বর্ণিত বড় বড় সাতটি কবিরা গুনাহ নিয়ে নি¤েœ আলোচনা করা হলোÑ ১. শিরক করা : দুনিয়াতে সবচেয়ে জঘন্যতম কবিরা গুনাহ হচ্ছে, আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক মনে করা। এ থেকে তওবা করে ঈমান নিয়ে মৃত্যুবরণ না করতে পারলে চিরস্থায়ী জাহান্নাম থেকে মুক্তির অন্য কোনো উপায় নেই। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা তাঁর সাথে শরিক করার গুনাহ কখনো ক্ষমা করবেন না। এ ছাড়া যেকোনো গুনাহ যাকে ইচ্ছা তাকে ক্ষমা করতে পারেন। যে আল্লাহর সাথে শিরক করল সে ভয়াবহ রকমের পাপ করল’ (সূরা নিসা-৪৮)। ২. মা-বাবার অবাধ্য হওয়া : কুরআন ও হাদিসের একাধিক জায়গায় মা-বাবার আনুগত্যের কথা বলা হয়েছে। তাদের অবাধ্য হওয়াকে বড় কবিরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বর্ণিত হয়েছে, সবচেয়ে বড় কবিরা গুনাহ হচ্ছে, আল্লাহর সাথে কাউকে শিরক করা, মা-বাবার অবাধ্য হওয়া, মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া, মিথ্যা বলা। (বর্ণনাকারী বলেন) রাসূল সা: এটি তিনবার বলেছেন। বারবার এই শব্দগুলো বলছিলেন; এমনকি একপর্যায়ে মনে মনে আমরা বলছিলাম, তিনি চুপ করেন না কেন (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-৬৯১৯)! ৩. অন্যায়ভাবে হত্যা করা : শরিয়তে কেবল তিন কারণে হত্যা করা বৈধ হয়Ñ ১. কিসাস তথা কারো হত্যার বদলা নেয়া; ২. রজম তথা বিবাহিত পুরুষ বা নারী ব্যভিচারের শাস্তিস্বরূপ পাথর নিক্ষেপে হত্যা করা ও ৩. ইরতিদাদ তথা ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করার শাস্তিস্বরূপ হত্যা করা। এ ছাড়া অন্য কোনো কারণে মুসলমানকে হত্যা করা কবিরা গুনাহ। তবে এই আইন ইসলামী রাষ্ট্রের জন্য। যে রাষ্ট্রে ইসলামী আইন কার্যকর সেই রাষ্ট্রের সরকার এই আইন কার্যকর করবে।
৪. সুদ খাওয়া : সামাজিক বড় বড় জুলুমের মধ্যে এটি অন্যতম একটি জুলুম। সুদি অর্থব্যবস্থা মানবজাতিকে পঙ্গু করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। এ জন্যই মহান রব সুদকে সম্পূর্ণরূপে হারাম করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ তায়ালা ব্যবসাকে করেছেন হালাল আর সুদকে করেছেন হারাম’ (সূরা বাকারা-১৭৫)। ৫. এতিমের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করা। কালামে পাকে এ ব্যাপারে কঠিন নির্দেশনা এসেছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয় যারা অন্যায়ভাবে এতিমের সম্পদ ভক্ষণ করে তারা মূলত আগুন দিয়ে নিজের উদরপূর্তি করে। আর তারা অচিরেই জাহান্নামে দগ্ধ হবে’ (সূরা নিসা-১০)। ৬. যুদ্ধের ময়দান থেকে পলায়ন করা : এটাও অনেক বড় গুনাহের কাজ। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর যারা যুদ্ধের দিন পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে ভয়ে; কোনো কৌশল বা নিজ বাহিনীর সাথে মিলিত হওয়ার জন্য নয় তারা আল্লাহর ক্রোধ নিয়ে ফিরল। তাদের ঠিকানা হলো জাহান্নাম। তা খুব নিকৃষ্ট প্রত্যাবর্তনস্থল’ (সূরা আনফাল-১৫)। ৭. হিজরতের পর পুনরায় কুফরের ভূমিতে ফিরে আসা।
একাধিক হাদিসে এ সাত গুনাহকে বড় কবিরা গুনাহ বলা হয়েছে। এগুলো থেকে বেঁচে থাকতে পারলে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিতÑ সহিহ বুখারি : ২৭৬৬, সহিহ মুসলিম : ৮৯ নং হাদিসেও এই সাতটি উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া আরো বহু কবিরা গুনাহ রয়েছে। মুফতি মনসূরুল হক রচিত কিতাবুল ঈমানের কবিরা গুনাহের অধ্যায়ে ১২৩টি কবিরা গুনাহের আলোচনা করা হয়েছে।
কবিরা গুনাহ তওবা ছাড়া মাফ হয় না। কবিরা গুনাহের কারণে ঈমান দুর্বল হয়ে যায়। দীর্ঘ দিনের অর্জিত আমলের নূর নষ্ট হয়ে যায়। এর ভয়াবহতা এমন যে, একটি কবিরা গুনাহই জাহান্নামে নেয়ার জন্য যথেষ্ট। বর্ণিত হয়েছে- যে গুনাহ তার কর্তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবে সেটাই কবিরা গুনাহ (ফাতহুল বারি ১২/১৯১)।
পরকালে জাহান্নাম ছাড়াও কবিরা গুনাহের দুনিয়াবী অনেক ক্ষতি রয়েছে। তন্মধ্যে কিছু হচ্ছে-১. রিজিক কমে যায়; ২. ইলম থেকে বঞ্চিত হতে হয়; ৩. হায়াতে বরকত কমে যায়। কিছু দিন পর গুনাহের প্রতি ঘৃণা অন্তর থেকে চলে যায়; ৪. সবচেয়ে ভয়াবহ ক্ষতি হচ্ছে, ঈমানহারা হয়ে মৃত্যুর সম্ভাবনা রয়েছে, (আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন)। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সগিরা, কবিরা সব ধরনের গুনাহ থেকে পুরোপুরি বেঁচে থাকার তাওফিক দান করুন। আমীন। লেখক : আলেম, প্রাবন্ধিক