লকডাউনের প্রথম দিন
মহামারি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে গতকাল বৃহস্পতিবার (১ জুলাই) সকাল ৬টা থেকে সারাদেশে কঠোর লকডাউন শুরু হয়েছে । ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ৮টি বিভাগে অভিযান চালিয়ে সরকারি নির্দেশনা অমান্য করায় ৭৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আটক করা হয়েছে ২৪৯ জনকে, সাজা দেয়া হয়েছে আটজনকে। ৫৬ জনকে ৬ হাজার ২০৭ টাকা এবং ১০টি দোকানকে ৩৪ হাজার ১০০ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। গতকাল বৃস্পতিবার (১ জুলাই) দুপুর ১টা পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে এসব তথ্য জানান ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) ইফতেখায়রুল ইসলাম। এছাড়া ২২২টি গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়েছে, জরিমানা করা হয়েছে ২ লাখ ৯৭ হাজার ১০০ টাকা। রেকারিং করা হয়েছে ৪৬টি গাড়ি আর জব্দ করা হয়েছে ছয়টি গাড়ি।
রাস্তাঘাট ফাঁকা, সেনাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর: সাত দিনের কঠোর বিধিনিষেধ শুরু হয়েছে সকাল ৬টা থেকে। বিধিনিষেধ চলাকালে রাজধানীর রাস্তা-ঘাট ফাঁকা হয়ে পড়ে। সেনা সদস্যদের টহলসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপতা ছিল চোখে পড়ার মতো। তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ জরুরি প্রয়োজনে বাইরে বেরিয়ে পড়ে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বাইরে আসা লোকদের জরুরি প্রয়োজন খতিয়ে দেখেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার (১ জুলাই) রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় এই চিত্র দেখা গেছে। কঠোর বিধিনিষেধ চলাকালে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় খোলা ছিল ওষুধসহ কাঁচাবাজার এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দোকান। যেসব দোকান খোলা বেশি প্রয়োজনীয় নয় সেগুলো সকালেই পুলিশ অনুরোধ করে বন্ধ করে দিয়েছে। বিভিন্ন আবাসিক এলাকার মধ্যে গেট টেনে রিকশাসহ অন্যান্য গাড়ি চলাচলের রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছেন মহল্লাবাসী।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরে শিয়া সমজিদ মোড়ে দায়িত্বপালন করা পুলিশের এসআই মাসুম বিল্লাহ বলেন, ‘সন্দেহ হলেই জরুরি প্রয়োজন খতিয়ে দেখছি। বিনা প্রয়োজনে কেউ বাইরে বের না হোক কিংবা গ্যাদারিং যেন না করা হয়‑ সে বিষয়টি নিশ্চিত করার চেষ্টা করছি। তবে এতো কিছুর মধ্যেই কিছু মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। সকাল থেকে রাজধানীর মোহাম্মদ এলাকায় মাইকিং করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হতে নিষেধ করা হয়েছে।
মোহাম্মদপুর বসিলার প্রধান সড়কে জামিয়া রহমানিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসার সামনে ট্রাকসেলে সূলভমূল্যে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য বিক্রি করা হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে। তবে ট্রাক সেলে যারা লাইন ধরে নিত্যপণ্য কিনছেন তারা স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। গাদাগাদি করে লাইনে দাঁড়িয়ে চাল, আটাসহ অন্যান্য পণ্য কিনছেন। অনেকে মাস্ক ব্যবহার করেননি। এই ট্রাক সেলের আশেপাশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দেখা যায়নি। কঠোর লকডউনে খোলা ছিল তৈরি পোশাক শিল্প কারখানা। মিরপুরে মন্টিল এ্যাপারেল ও ভিশন গার্মেন্টে শ্রমিকরা ঢুকেছে সকালেই। স্বাস্থ্যবিধি মেনে শ্রমিকদের ঢুকতে দেখা গেলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে, ভেতরে স্বাস্থ্যবিধি কড়াকড়িভাবে মানা হচ্ছে না। তৈরি পোশাক খাতে কাজ করা একজন শ্রমিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, করোনার এই সময়ে কাজের পরিধি বেড়েছে। আগে আমরা রাত ৮টায় বাড়ি যাইতাম আর এখন রাত সাড়ে ১০টায় ছুটি পাই। রাজধানীর বড় মগবাজার থেকে নয়াটোলা পর্যন্ত কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে কর্মচাঞ্চল্য দেখা গেছে মানুষদের মধ্যে। বিভিন্ন কর্মে নিয়োজিতরা সকালে যে যার গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়ার কারণে অনেক রিকশাচালক রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলেন যাত্রীর অপেক্ষায়। অনেক রিকশাচালককে মাস্ক না পরার কারণে পুলিশ অল্প সময়ের জন্য আটকে রেখে ছেড়ে দিচ্ছে। মিরপুর ১১, ৬ ও ৭ নম্বর সেকশন ঘুরে দেখা গেছে, বিধিনিষেধ অনেকটাই শিথিল। রাস্তায় সাধারণ মানুষের উপস্থিতি কম থাকলেও রিকশার উপস্থিতি বেশি। ব্যক্তিগত গাড়ি, মাইক্রোবাস চলতে দেখা গেছে। এসব এলাকা ঘুরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনও টহল চোখে পডেনি। লকডাউনকে সামনে রেখে বুধবার (৩০ জুন) দুপুর থেকে এলাকাগুলোতে মাইকিং করা হয়।
তবে লকডাউনে ভিন্ন চিত্র দেখা গেলো মিরপুর ৭ নম্বর সেকশনে। সেকশনের রাস্তাগুলোতে মানুষের আনাগোনা বেশি ছিল। ভ্যানে ভ্যানে সবজি বিক্রি হচ্ছে। ২ নম্বর সড়কে লোকজন চায়ের স্টলে বসে আড্ডা দিতে দেখা গেছে। এদের অনেকেরই মাস্ক নেই। খিলগাঁও, বাসাবো ও রাজারবাগ এলাকায় লকডাউনের আওতামুক্ত ছাড়া সব ধরণের দোকানপাট বন্ধ দেখা গেছে। রাস্তা-ঘাটে সাধারণ মানুষের উপস্থিতিও তেমন একটা দেখা যায়নি। মাঝেমধ্যে পুলিশকে এলাকায় টহল দিতে দেখা গেছে।
সকাল থেকে খিলগাঁও রেলগেট এলাকায় বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে। তারা সড়কে বের হওয়ার কারণ জানতে চাচ্ছেন। উপযুক্ত কারণ না দেখাতে পারলে তাদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে। এছাড়া ওই সড়কে স্কাউটের স্বেচ্ছাসেবকদেরও দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে। পুলিশ সদস্য ইসমাইল হোসেন বলেন, আমরা কঠোরভাবে দায়িত্ব পালন করছি। বিনা কারণে কেউ বাসা থেকে বের হলে তাকে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। তবে এই এলাকায় যেহেতু একটি কাঁচাবাজার রয়েছে অনেকেই সেখানে বাজার করতে আসেন। এর বাইরে কাউকে যাতায়াত করতে দেওয়া হচ্ছে না। সকাল থেকে কলাবাগান এলাকার প্রধান সড়কগুলো বেশ ফাঁকা দেখা যায়। এসময় অল্প সংখ্যক ব্যক্তিগত গাড়ি রাস্তায় চলছিল। তাছাড়া রিকশা ও জরুরি সেবায় নিয়োজিত পরিবহনের সংখ্যা সেই তুলনায় বেশি। ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সিগন্যালে পুলিশের চেকপোস্ট দেখা যায়। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, চিকিৎসকের গাড়ি পরিচয় দেওয়া মাত্র ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। অন্যান্য গাড়ি থামিয়ে পরিচয়পত্র দেখে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। প্রধান সড়কের তুলনায় মানুষের আনাগোনা বেশি অলিগলিতে। কেউ নিত্যপণ্য নিতে বেরিয়েছেন কেউবা নাস্তা কিনতে হোটেলের সামনে ভিড় জমিয়েছেন।
রাজধানীর মতিঝিল, সায়েদাবাদ টার্মিনালসহ ওই এলাকার প্রধান রাস্তা সকাল থেকে ফাঁকা। সড়কে আইন-শ্খৃলা বাহিনীর সদস্যদের টহল দিতে দেখা গেছে। বিধিনিষেধ মানাতে কঠোর অবস্থানে পুলিশ: মহামারি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে বৃহস্পতিবার (১ জুলাই) সকাল ৬টা থেকে সারাদেশে কঠোর লকডাউন শুরু হয়েছে। যা আগামী ৭ জুলাই মধ্যরাত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। এই সময়ে মানুষের সার্বিক কার্যাবলী ও চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। সরকার ঘোষিত সাতদিনের কঠোর এই লকডাউনের প্রথম দিন বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই পাল্টে গেছে রাজধানীর চিত্র। সড়কে নেই অন্যান্য দিনের মতো অফিসমুখী মানুষের চাপ, নেই যানবাহনের ছুটে চলা, বন্ধ রয়েছে দোকানপাট।
সরেজমিনে রাজধানীর শুক্রাবাদ, ধানমন্ডি-৩২, পান্থপথ ও কলাবাগান এলাকা ঘুরে দেখা যায় এসব এলাকার বিভিন্ন পয়েন্টে সকাল থেকেই দায়িত্ব পালন করছেন পুলিশ সদস্যরা। স্থাপন করা হয়েছে একাধিক চেকপোস্ট। এসব চেকপোস্টে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ এবং সংশ্লিষ্ট থানার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা জন ও যান চলাচল নিয়ন্ত্রণে কাজ করছেন। জরুরি প্রয়োজনে যারা সড়কে বেরিয়েছেন তাদের মুখোমুখি হতে হচ্ছে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের।
সড়কে যেসব গাড়ি চলাচল করছে সেগুলোর অধিকাংশই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, গণমাধ্যম, অ্যাম্বুলেন্স, জরুরি ও খাদ্য পণ্যবাহী ট্রাক, সরকারি কর্মকর্তাদের বহনকারী যানবাহন ও জরুরি সেবায় নিয়োজিত মোটরসাইকেল। তবে এ সময়ে অলিগলি ও সড়কে কিছু রিকশার চলাচল দেখা যায়। সংশ্লিষ্ট আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বলছেন বেলা বাড়ার সঙ্গে পুলিশের তৎপরতা ও আরো বাড়বে। ট্রাফিক পুলিশের ধানমন্ডি জোনের উপ-কমিশনার জাহিদুল ইসলাম বলেন, করোনা সংক্রমণ হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় সরকার ঘোষিত কঠোর লকডাউনের বিধিনিষেধ বাস্তবায়নে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। সড়কে ট্রাফিক পুলিশ এবং সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশের সম্মিলিত টহল চলবে। কেউ যেন অপ্রয়োজনে বাইরে বের না হয় এবং ঘোরাফেরা না করে সেটি নিশ্চিত করতে আমাদের একাধিক টিম কাজ করে যাচ্ছে। সরকারের জারি করা বিধিনিষেধ কঠোরভাবে প্রতিপালনে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ। বুধবার (৩০ জুন) বিকেলে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে ভার্চুয়ালি সব মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার, রেঞ্জ ডিআইজি, জেলা পুলিশ সুপার ও থানার অফিসার ইন-চার্জসহ সব ইউনিট প্রধানদের এ নির্দেশ দেন তিনি।
প্রসঙ্গত, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রজ্ঞাপনে করোনাভাইরাসজনিত রোগ সংক্রমণের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় ২১টি শর্ত যুক্ত করে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। বৃহস্পতিবার (১ জুলাই) সকাল ৬টা থেকে শুরু হওয়া এ বিধিনিষেধ ৭ জুলাই মধ্যরাত পর্যন্ত বহাল থাকবে।