বিভিন্নভাবে শয়তান আদম সন্তানদের প্ররোচনা দেয়। ইবলিশ এ ঘোষণা আল্লাহর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পরই দিয়েছে। মানুষকে ভুল পথে যাওয়ার এই প্ররোচনা বা ফাঁদ তৈরি নানাভাবে করতে দেখা যায় শয়তানকে।
প্রথমত, মদ ও জুয়ার মাধ্যমে প্রতারণা। মদ হলো এমন পানীয় যা পান করলে শুরু হয়ে যায় বিবেকহীনতা। নেশাগ্রস্ত হওয়ায় স্বাভাবিক বোধ হারিয়ে স্ত্রীকে ডাকে মা এবং মাকে ডাকে স্ত্রী, বাপকে ডাকে শ্বশুর এবং শ্বশুরকে ডাকে বাপ। মদ মূলত ব্যভিচার চেয়েও জঘন্য। কারণ তা বিবেককে নষ্ট করে দেয় এবং চিন্তা-চেতনাকে হরণ করে। এমনকি অবচেতন অবস্থায় মারাত্মক গর্হিত কাজেও লিপ্ত হয়ে পড়ে। যেমন- মাতাল অবস্থায় খুন, ধর্ষণ ইত্যাদি সংঘটিত হওয়ার প্রবণতা বেশি লক্ষ করা যায়।
জুয়াও নেশার অন্যতম একটি অংশ। জুয়ার বিভিন্ন ধরন ও পর্যায় রয়েছে। জুয়া এমন একটা নেশা যদি প্রথম জিতে যায় তা হলে অনেক অর্থ কিংবা সম্পদের অধিকারী হয়। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে শয়তান প্ররোচনা দিয়ে বলে যে, তুমি আরো খেলো। হয়তো তুমি আবার জিতবে এবং আরো অনেক অর্থের অধিকারী হবে। অতঃপর যখন আবার জুয়ার আসরে বসে তখন মুনাফাসহ নিজের আসল পর্যন্ত হারিয়ে বসে। কিন্তু শয়তান বসে থাকে না, আবার বলতে থাকে, আরে একবার হারছ তো কী হয়েছে? হার-জিত সব কিছুতে থাকে। কিন্তু মানুষ চিন্তা করে না যে, এটি তো মূলক শয়তানি কাজ।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- মদ ও জুয়া আল্লাহর স্মরণ ভুলিয়ে দেয়। এ জন্য আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘হে মুমিনগণ, নিশ্চয় মদ, জুয়া, প্রতিমা-দেবী ও ভাগ্যনির্ধারক তীরগুলো তো নাপাক শয়তানের কর্ম। সুতরাং তোমরা তা পরিহার করো, যাতে তোমরা সফলকাম হও। শয়তান শুধু মদ ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সঞ্চার করতে চায়। আর (চায়) আল্লাহর স্মরণ ও সালাত থেকে তোমাদের বাধা দিতে। অতএব, তোমরা কি বিরত হবে না?’ (সূরা মায়িদাহ, আয়াত : ৯০-৯১)
দ্বিতীয়ত, দারিদ্র্যের মাধ্যমে প্ররোচনা। শয়তান দারিদ্র্যের ভয় দেখিয়ে প্ররোচনা দিয়ে বলে যে, তুমি দরিদ্র এবং কিভাবে তোমার সন্তান-সন্ততিদের খাওয়াবে ও পরাবে? এ জন্য আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘শয়তান তোমাদেরকে দারিদ্র্যের ভয় দেখায় এবং অশ্লীল কাজে উৎসাহ দেয়। আর আল্লাহ তোমাদেরকে তার পক্ষ থেকে ক্ষমা ও অনুগ্রহের প্রতিশ্রুতি দেন। আর আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।’ (সূরা বাকারাহ, আয়াত-২৬৮)
তৃতীয়ত, অবিশ্বাস ও অশান্তি সৃষ্টি করা। একটি পরিবারে তখন অশান্তির সূচনা হয় যখন ভাইয়ের মধ্যে ভাইয়ের সম্পর্ক বিনষ্ট হয়। এটি হওয়ার অনেক কারণ থাকে। শয়তান যেভাবে হজরত ইউসুফ আ: ও তাঁর ভাইদের মধ্যে সম্পর্ক বিনষ্ট করে। আল্লাহ বলেন, ‘শয়তান ভাইয়ের মধ্যে সম্পর্ক বিনষ্ট করে।’ (সূরা ইউসুফ, আয়াত- ১০০)
আল্লাহ তায়ালা পরিবারের যে কারো আয়ের মাধ্যমে বাকি সদস্যদের রিজিকের ব্যবস্থা করেন। তাই পরিবারের যে সদস্য ভালো আয় করে তার এটি ভাবা উচিত নয় যে, আমি সব কিছু করি, আমার উপার্জনের টাকা সব এবং আমার জন্য তাদের জীবিকা নির্বাহ হচ্ছে ইত্যাদি। মূলত এ ধরনের মনোভাব অন্তরে শয়তান সৃষ্টি করে থাকে। আল্লাহ চাইলে অন্যের মাধ্যমেও সবার রিজিকের ব্যবস্থা করতে পারতেন। সুতরাং অহঙ্কার করার কোনো অর্থ নেই। শয়তান বিভিন্ন খুঁত প্রদর্শন করে ভাই ভাইয়ের মধ্যে ঝগড়া বাধিয়ে দিতে পারে। বিশেষ করে যখন ঘরে স্ত্রী থাকে তখন এর মাত্রা আরো তীব্রতর রূপ নিয়ে থাকে।
চতুর্থত, অপব্যয় শয়তানের অন্যতম নিকৃষ্ট কর্ম। সাধারণত অর্থ ব্যয়, খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ, সময়-সর্বক্ষেত্রে অপচয় লক্ষণীয়। পান করার শেষে কিছু রেখে দেয়া, খাবার গ্রহণের শেষে পরিষ্কার করে না খেয়ে অবশিষ্ট কিছু রেখে দেয়া, অপ্রয়োজনীয় কাজে অর্থ ব্যয় ও অবসর সময়কে কাজে না লাগিয়ে নষ্ট করা ইত্যাদি সব কিছুই শয়তানের অপকর্ম। এগুলো মূলত শয়তানের চারিত্রিক গুণাবলিরই। এ জন্য আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই। আর শয়তান তার রবের প্রতি খুবই অকৃতজ্ঞ।’ (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত-২৭)
কারো জাকাত আদায়ের সময় হলে শয়তান দুশ্চিন্তা নিয়ে উপস্থিত হয় এবং বলে, তুমি অনেক কষ্টের বিনিময়ে অর্থ উপার্জন করেছ আর তা সঞ্চয় করেছ অতি যতেœ। এখন কি না বিনা কারণে তোমার উপার্জিত টাকার কিছু অন্যের হাতে দিয়ে দেবে? তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? আচ্ছা, যাক যদি দিতে চাও তা হলে আরো কিছু অর্থ উপার্জন করো এবং পরের বছর ভালো করে দান করো। শয়তান এভাবে পরের বছরও একই ধোঁকার শিকার করে। ১০ হাজার টাকা জাকাত দিতে তার দুশ্চিন্তা এমনভাবে শয়তান বাড়িয়ে দেয় যেন ১০ লাখ টাকার মাথাব্যথা শুরু হয়।
ফজরের অ্যালার্ম বেজে উঠলে শয়তান বলে- আরো অনেক সময় রয়েছে, উঠবে আর কী। আর পাঁচ মিনিট রেস্ট নাও। ফলে পাঁচ মিনিট হয়ে যায় সকাল ১০টি। যখন ফজরের নামাজ মিস হয় তখন শয়তান জোহরের সময় হলে বলে, আজ ফজর মিস করেছ। এখন ভাঙাচুরা কী নামাজ পড়বে! আগামীকাল থেকে নতুন করে শুরু করিও। এভাবে শয়তান আসর, মাগরিব ও এশা নামাজও কাজা করায়।
কোনো খারাপ স্বভাব ত্যাগ করতে চাইলে তখন শয়তানের তৎপরতা আরো বৃদ্ধি পেতে থাকে। যেমন- আগে অশালীন মুভি দেখতে কিংবা গান শুনতে এবং তা এখন পরিত্যাগ করেছ। দেখবে, দুই দিন অতিবাহিত হতে না হতেই সেই মুভি দেখা কিংবা গান শোনার তীব্রতা আগের চেয়ে পাঁচগুণ বেড়ে গেছে। মূলত এই তীব্রতা হলো শয়তানের প্ররোচনা। এভাবে ভালো কাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে শয়তান বাধা সৃষ্টি করে।