মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করায় এবং মুসলিম সমাজে বসবাস করায় দান, সদকা, খয়রাত এ শব্দগুলোর সঙ্গে আমরা কম-বেশি সবাই পরিচিত। এগুলো সমার্থক শব্দ। অর্থাৎ যা দান তা-ই সদকা এবং যা সদকা তা-ই খয়রাত। দান শব্দটি বাংলা আর সদকা ও খয়রাত শব্দ দুটো আরবি। আল্লাহ তায়ালা কুরআনে কারিমে আমাদের সাবধান করে দিয়েছেন, যেন মৃত্যু-মুহূর্তটি আসার আগে আগেই আমরা নিজ নিজ সাধ্যানুযায়ী উদার হস্তে একমাত্র আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য দান করতে থাকি।
তবে দানের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবে নিকটতম দরিদ্র আত্মীয়-স্বজন, অতঃপর দূরবর্তী আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী, অভাবগ্রস্ত, মিসকিন, ভিখারি প্রমুখ। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেছেনÑ ‘নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা ইনসাফ, দয়া এবং আত্মীয়-স্বজনকে (তাদের হক) প্রদানের হুকুম দেন আর অশ্লীলতা, মন্দ কাজ ও জুলুম করতে নিষেধ করেন। তিনি তোমাদের উপদেশ দেন, যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ করো।’ (সূরা : নাহল, আয়াত- ৯০)
বলা বাহুল্য, ধনী আত্মীয়গণের ওপর গরিব বা অসচ্ছল আত্মীয়-স্বজনের অধিকার স্বীকৃত ধর্মীয় বিধান। দানের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা কুরআনে কারিমের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্নভাবে নানা রকম প্রতিদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। পাশাপাশি এ দায়িত্ব পালনে অবহেলার ভয়াবহ পরিণতিও উল্লেখ করেছেন।
আল্লাহ মহাবিশে^র একচ্ছত্র অধিপতি
গোটা মানব সমাজের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় দান-খয়রাত যে কি অত্যাশ্চর্য ভূমিকা পালন করছে তা গভীরভাবে চিন্তা করলে সহজেই অনুমেয়। আল্লাহ তায়ালাই মানুষের মধ্যে কাউকে ধনী এবং কাউকে দরিদ্র করে সৃষ্টি করেছেন। সাধারণত একজন ধনী ব্যক্তি কোনো গরিবকে দান-খয়রাত করে মনে করেন, তিনি গরিব ব্যক্তিটির খুব উপকার করেছেন। সন্দেহ নেই, তার এ ধারণা এক দিক থেকে সত্য। কিন্তু কখনো কি তিনি এ কথাও ভেবেছেন যে, তার এ দান গ্রহণ করে গরিব লোকটিও যে তার উপকার করেছে? বাস্তবতা হলো তিনি গরিব লোকটিকে দান করে তার যে উপকার করেছেন, গরিব লোকটি দান কবুল করে তাকে অধিকতর উপকার করেছে। কারণ ধনীর কাছ থেকে গরিব লোকটি পেল ক্ষণস্থায়ী জাগতিক সাহায্য আর ধনী লোকটি পেলেন চিরস্থায়ী জীবনে সাফল্য অর্জনের উপকরণ। আমাদের মনে রাখতে হবে, সম্পদ হলো আল্লাহর দয়া বা দান; আমাদের অর্জন নয়। কারণ গোটা মহাবিশে^র সব সম্পদের একচ্ছত্র মালিক আল্লাহ তায়ালা। কুরআনে কারিমে তিনি বহু স্থানে বলেছেন, আমরা যেন দান করি তাঁরই প্রদত্ত সম্পদ হতে।
পৃথিবীর বিভিন্ন ধনাঢ্য ব্যক্তি বিশে^র বিভিন্ন দেশে নানা রকম জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান তৈরি করে, দারিদ্র্য বিমোচন বা গরিব দুঃখীদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা, আত্মমানবতার সেবা এবং জনহিতকর কার্যাবলি সম্পাদন করার জন্য অঢেল টাকা পয়সা দান করে থাকেন, যা আন্তর্জাতিক অনুদান নামে স্বীকৃত। আমাদের দেশের এনজিওগুলোর বেশির ভাগ এ জাতীয় দানের দ্বারা পরিচালিত। আসুন আমরা একবার চিন্তা করি, বিশে^র বিভিন্ন দেশে যদি গরিব, মিসকিন, ফকির, দুস্থ ও অসহায় মানুষ না থাকত তাহলে এই ধনী ব্যক্তিদের অঢেল টাকা কোথায় ব্যবহৃত হতো? আল্লাহ তায়ালা যে একজন সর্বশ্রেষ্ঠ প্রকৌশলী, অসীম ক্ষমতার অধিকারী তা ধনী-গরিবের এই শ্রেণী বিভাজন দ্বারা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়।
দান-খয়রাত চর্চা বা প্রদান তা ছোটই হোক বা বড়ই হোক, দেশীয় হোক কিংবা বিদেশী হোক এর নিয়ত ও উদ্দেশ্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। উদাহরণস্বরূপ, কোনো মু’মিন যে কোনো অঙ্কের টাকা বা যেকোনো পরিমাণ সামগ্রী দান করেন একমাত্র আল্লাহর নির্দেশ পালনার্থে এবং তারই সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য। এতে দান-খয়রাতের সত্যিকার উদ্দেশ্য সাধিত হয়। অর্থাৎ এ দান-খয়রাতের বিনিময় তিনি প্রধানত পাবেন চিরস্থায়ী জীবনে যা সত্যিকার অর্থে মহাসফলতা এবং কিছুটা প্রতিদান পেতে পারেন ক্ষণস্থায়ী জীবনেও।
পক্ষান্তরে, যিনি বা যারা দান করেন জাগতিক কোনো উদ্দেশ্য সাধনের জন্য, তিনি বা তারা শুধু জাগতিক সফলতাই অর্জন করবেন; চিরস্থায়ী জীবনে এর কোনো ফলই তিনি বা তারা পাবেন না। উদাহরণত, এরা কেউ দান করেছেন লোক দেখানোর জন্য বা ভিক্ষুক ও গরিব-মিসকিনের কাছ থেকে সম্মান লাভের জন্য বা কোনো জাগতিক স্বার্থ উদ্ধার করার জন্য। যারা দান করে দানগ্রহীতাকে কোনোভাবে হেয়প্রতিপন্ন করে না বা আচার ব্যবহারে কষ্ট দেয় না, তাদের জন্য চিরস্থায়ী জীবনে কোথাও আশঙ্কা বা দুশ্চিন্তা থাকবে না। কেউ দান করতে অক্ষম হলে মিষ্টি কথায় প্রার্থীকে বিদায় জানাতে হবে।
লেখক : সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টস অব বাংলাদেশ ও ম্যানেজিং পার্টনার, আজিজ হালিম খায়ের চৌধুরী, চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টস