মহান আল্লাহর অগণিত নিয়ামতের মধ্যে বাবা-মায়ের জন্য অন্যতম নিয়ামত হচ্ছে সন্তান-সন্ততি। কারণ আল্লাহ তায়ালা একমাত্র সন্তান-সন্ততি দানের মালিক। এই পৃথিবীতে এমন অনেক মানুষ আছেন, যাদের এই দুনিয়ার ধন-সম্পত্তির কোনো কমতি নেই। কিন্তু কোনো সন্তান-সন্ততি নেই। আবার অনেকে আছেন দিনে আনে দিনে খাই, তার চার-পাঁচ সন্তান আছে। পবিত্র আল-কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘ধন, ঐশ্বর্য ও সন্তান-সন্ততি পার্থিব জীবনের অলঙ্কার-শোভা’ (সূরা কাহাফ-৪৬)। অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নভোমণ্ডল ও ভূম-লের রাজত্ব একমাত্র আল্লাহ তায়ালারই। তিনি যাকে ইচ্ছা সৃষ্টি করেন, যাকে ইচ্ছা কন্যাসন্তান এবং যাকে ইচ্ছা পুত্রসন্তান দান করেন। অথবা তাদের দান করেন পুত্র ও কন্যা উভয়ই এবং যাকে ইচ্ছা বন্ধ্যা করে দেন। নিশ্চয়ই তিনি সর্বজ্ঞ, ক্ষামাশীল’ (সূরা শুরা : ৪৯-৫০)।
এ কারণে বাবা-মায়ের জন্য সন্তান-সন্ততিকে বলা হয় আল্লাহর পক্ষ থেকে শ্রেষ্ঠ উপহার। সন্তান-সন্ততি জন্ম দেয়ার পরই বাবা-মায়ের কাজ শেষ নয়। তাদের সৎপথে পরিচালিত হওয়ার মতো করে গড়ে তোলা বাবা-মায়ের অন্যতম দায়িত্ব। কারণ সন্তান দুই ধরনের হয়- সুসন্তান ও কুসন্তান। সুসন্তান বাবা-মায়ের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতের জন্য কল্যাণকর। আর কুসন্তান বাবা-মায়ের জন্য অভিশাপ। কারণ কুসন্তানের জন্য বাবা-মাকে দুনিয়াতে অপমানিত হওয়ার পাশাপাশি হাশরের ময়দানে আল্লাহর দরবারে আসামি হিসেবে দাঁড়াতে হবে।
সুসন্তানকে ইসলামের পরিভাষায় নেককার সন্তান বলা হয়। নেককার সন্তান এই দুনিয়ার জন্য বরকতময়, আবার পরকালেরও সঞ্চয়পত্র। মানুষ মৃত্যুর পর আমলের সব রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়, কিন্তু কিছু আমল দুনিয়ায় থাকাকালীন অবস্থায় করে যাওয়ার কারণে তার সওয়াব মৃত্যুর পরও পেতে থাকে। হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- রাসূল সা: ইরশাদ করেছেন, ‘যখন কোনো ব্যক্তি মারা যায়, তখন তার আমলের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। তবে তিনটি আমল কখনো বন্ধ হয় না। এক. সদকায়ে জারিয়া; দুই. ওই ইলম যা দ্বারা অন্যরা উপকৃত হয়; তিন. নেককার সন্তান যে তার জন্য দোয়া করে’ (সহিহ মুসলিম-১৬৩১, সুনামে আবু দাউদ-২৮৮০)।
মৃত্যুর পরবর্তী জীবন খুব কঠিন। মৃত্যুর পর যেখানে এই পৃথিবীর কোনো ধন-সম্পত্তি, ঐশ্বর্য কাজে আসবে না। কেউ চাইলেই নিজের ভুলগুলো সংশোধন এবং আমল বাড়িয়ে হাশরের ময়দানে নাজাতের ব্যবস্থা করতে পারবে না। কিন্তু, মৃত্যুর পরও তিনটি পদ্ধতিতে আমল জারি থাকে। এই তিনটি আমলের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নেককার সন্তান। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র আল-কুরআনে পৃথিবীর সব সন্তানকে তাদের বাবা-মায়ের জন্য তিনটি দোয়া শিখিয়েছেন। বাবা-মা জীবিত কিংবা মৃত যে অবস্থায় থাকুক না কেন, প্রত্যেক সন্তানের দায়িত্ব হলো প্রতিদিন এ দোয়াসমূহ পাঠ করা। এসব দোয়া হলো, এক. রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বায়ানি সাগিরা। অর্থ- (হে আমাদের) পালনকর্তা! তাদের উভয়ের প্রতি দয়া করো, যেভাবে তারা আমাকে শৈশবে লালন-পালন করেছেন’ (সূরা বনি ইসরাইল-২৪)। দুই. রাব্বানাগফিরলি ওয়ালিওয়ালিদাইয়্যা ওয়া লিমান দাখালা বাইতিয়া মুমিনাও জ্বালিমিনা ইল্লা তাবারা। অর্থ- হে আমার প্রতিপালক! আমাকে, আমার বাবা-মাকে, যে আমার ঘরে ঈমানদার হয়ে প্রবেশ করবে তাকে এবং মুমিন নারী-পুরুষকে ক্ষমা করুন এবং আপনি জালেমদের ধ্বংস ছাড়া আর কিছুই বাড়িয়ে দেবেন না’ (সূরা নূহ-২৮)। তিন. রাব্বানাগফিরলি ওয়ালিওয়ালি দাইয়্যা ওয়া লিলুমুমিনিনা ইয়াওমা ইয়াকুমুল হিসাব। অর্থ- হে আমার প্রতিপালক! যে দিন হিসাব কায়েম হবে, সে দিন আপনি আমাকে, আমার বাবা-মাকে ও মুমিনদেরকে ক্ষমা করে দেবেন’ (সূরা ইবরাহিম-৪১)। এই দোয়াগুলোতে রয়েছে সন্তান-সন্ততি ও মুমিন নারী-পুরুষ সবার জন্য কল্যাণকর।
প্রত্যেক বাবা-মায়ের উচিত আল্লাহ তায়ালার কাছে নেককার সন্তানের জন্য দোয়া করা। হজরত জাকারিয়া আ:-এর নেক সন্তান চাওয়ার পদ্ধতিটি আল্লাহর কাছে অধিক পছন্দনীয় ছিল। হজরত জাকারিয়া আ: বার্ধক্যে উপনীত হওয়ার পর আল্লাহর কাছে বলেন, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে একা রেখো না। তুমি তো উত্তম ওয়ারিস দানকারী’ (সূরা আম্বিয়া-৮৯)। আল্লাহ তায়ালা হজরত জাকারিয়া আ:-এর দোয়া কবুল করেছিলেন এবং তাকে হজরত ইয়াহিয়া আ:কে দান করেছিলেন। আবার মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইবরাহিম আ: যখন ৮৬ বছর বয়সে আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন, ‘হে আমার প্রতিপালক! আপনি আমাকে এক সৎকর্মশীল সন্তান দান করুন’ (সূরা আস-সাফফাত-১০০)। অতঃপর আল্লাহ তায়ালা তাকে ইসমাঈল আ:কে দান করেন। কিন্তু আমাদের দেশে অনেকে সন্তান-সন্ততি আল্লাহর কাছে না চেয়ে বিভিন্ন মাজার, দরগাহ কিংবা পীর বাবার কাছে চায়। এটি কখনো ইসলাম সমর্থন করে না। আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ সন্তান-সন্ততি দিতে পারে এ রকম বিশ্বাস করা শিরক। আর শিরক হচ্ছে জঘন্যতম জুলুম। পৃথিবীর সব পিতাদের আল্লাহ তায়ালা একটি দোয়া আল-কুরআনে শিখিয়ে দিয়েছিলেন। দোয়াটি হলো- রাব্বানা হাবলানা মিন আজওয়াঝিনা ওয়া জুররিয়্যাতিনা কুররাতা আইয়ুনি ওয়াঝআলনা লিলমুত্তাক্বিনা ইমামা। অর্থ- ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের স্ত্রী ও সন্তানদের পক্ষ থেকে আমাদের জন্য চোখের শীতলতা দান করেন এবং আমাদেরকে মুত্তাকিদের জন্য আদর্শস্বরূপ করেন’ (সূরা ফুরকান-৭৪)।
তাই প্রত্যেক বাবা-মায়ের উচিত তাদের সন্তানদের ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত করা এবং ইসলামের সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদান করা। আল্লাহ তায়ালা সব মুসলমানদের নেককার সন্তান দান করুক এবং বাবা-মাকে সন্তানের প্রতি দায়িত্ব পালন করার তৌফিক দান করুক। পরিশেষে, মুসলমানের সন্তান-সন্ততি পরকালে যেন তাদের বাবা-মায়ের মুক্তির কারণ হয় এই কামনা করছি। আমীন। লেখক: শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।