শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৪৫ পূর্বাহ্ন

তত্ত্বাবধায়ক নিয়ে আওয়ামী লীগ-বিএনপি বাকযুদ্ধ

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় রবিবার, ৩ অক্টোবর, ২০২১

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ছাড়া নির্বাচনে যাবে না বিএনপি। আওয়ামী লীগ বলছে কোন দিন তা সম্ভব নয়। এ নিয়ে আওয়ামী লীগ বিএনপি বাকযুদ্ধ চলছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, নির্বাচন-নির্বাচন খেলা আর হবে না। নির্বাচন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনেই হতে হবে। নিরপেক্ষ সরকার এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের অধীনে ছাড়া বিএনপি কোন নির্বাচন মেনে নেবে না। গত শনিবার (২ অক্টোবর) রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে আয়োজিত এক আলোচনাসভায় সভাপতির বক্তব্যে মির্জা ফখরুল এসব কথা বলেন। সরকারের উদ্দেশে মির্জা ফখরুল বলেন, মানুষের ভাষা পড়েন, দেয়ালের ভাষা পড়েন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান করে সরে যান। নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া আমরা কোন নির্বাচনে অংশ নেবো না।’ বিএনপির আলোচনা সভা সকাল ১০টায় শুরু হওয়ার কথা থাকলেও সকাল ৯টা থেকে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে সমাবেশস্থলে জড়ো হয়ে শুরু করে করে। মিলনায়তনে জায়গা না পেয়ে সহস্রাধিক নেতাকর্মী হলরুমের বাইরে অবস্থান নেয়। বিএনপির নেতাকর্মীদের উদ্দেশে মির্জা ফখরুল বলেন, কেবল স্লোগান দিয়ে আন্দোলন হয় না। ব্যাপকগণ আন্দোলনের ডাকে সাড়া দেয়ার মত করে সংগঠনের ইউনিটগুলোকে তৈরি করতে হবে। আলোচনা সভায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু, ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন, অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুব উল্লাহ, অধ্যাপক দিলারা চৌধুরীসহ অনেকে বক্তব্য রাখেন। এদিকে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সরকারের সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বিএনপির দাবি প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘পৃথিবীর অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে যেভাবে নির্বাচন হয়, বাংলাদেশেও সময়মতো সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। মীমাংসিত বিষয় নিয়ে অযথা মাঠ গরম করবেন না।’ শনিবার (২ অক্টোবর) নিজের সরকারি বাসভবন থেকে ভার্চুয়াল ব্রিফিংয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, বিএনপির জনসমর্থনের জোয়ার তো গত ১৩ বছরে কোনো নির্বাচনে দেখা যায়নি। ‘তারা ভরাডুবির ভয়ে এখন নির্বাচনবিমুখ। তাই রাজপথ আর ভোটের ময়দান ছেড়ে গণমাধ্যম এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় রাজনীতিকে সীমাবদ্ধ করে রেখেছেন।’ বিএনপির সবকিছুতেই শর্ত এবং মামার বাড়ির আবদার উল্লেখ করে ওবায়দুল কাদের বলেন, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করলে নাকি তারা নির্বাচনে অংশ নেবেন। আসলে বিএনপি ভালো করেই জানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়টি একটি মীমাংসিত বিষয়। তিনি বলেন, উচ্চ আদালতের রায়ের আলোকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল হয়েছে, এ পদ্ধতি ছিল একটি অন্তর্র্বতীকালীন ব্যবস্থা, দীর্ঘমেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার চলতে পারে না। অনুরূপ ব্যাখ্যা দিয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ চাঁদপুরে এক দলীয় সমাবেশে বলেছেন, বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আর কখনো হবে না। যদি কোনো রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে সেটা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারের মধ্যে পড়ে।
শনিবার দুপুরে চাঁদপুর স্টেডিয়ামে আয়োজিত চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের তৃণমূল প্রতিনিধি সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ইতিমধ্যেই দেশের সর্বোচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে যে এটি আর কখনো কার্যকর হবে না। যারা এখনো দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়কে অবজ্ঞা করে তাদের মনমতো কোনো সরকার দেখতে চায় তাদের সেই স্বপ্ন পূরণ হবে না।’
বাংলাদেশে যেভাবে অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব…: জার্মান বার্তা সংস্থা ডয়েসে ভেলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনেকেই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনো সম্ভাবনাই দেখছেন না। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি যদি ‘শুভবুদ্ধির’ পরিচয় দেয়, তাহলেই কিন্তু বাংলাদেশে খুব সুন্দর একটি নির্বাচন আয়োজন সম্ভব। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়াও সম্ভব। এরশাদকে ক্ষমতায় রেখে কোনো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় জেনেই ‘নির্বাচনকালীন সরকার’ হিসেবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি চেয়েছিল বলেই তা সম্ভব হয়েছিল। আবার আওয়ামী লীগ আর বিএনপি সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে হলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনের রীতি অনুসরণ করে যেতে চায়নি বলেই এখন এই অবস্থা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যতটা সম্ভব ‘সুষ্ঠু’ নির্বাচন চলতে থাকুক, বিএনপি যদি তা-ই চাইতো তাহলে তারা কখনো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করত না। আবার আওয়ামী লীগও যদি ভালো দৃষ্টান্ত রেখে শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংশ্লিষ্ট ফাঁক-ফোকড়গুলো বন্ধ করে, পুরো ব্যবস্থাটিকে আরো কার্যকর করতে চাইতো, তাহলে আদালতের রায় কার্যকর করার অজুহাতে একেবারে টুটি চেপে ধরত না।
স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ প্রথম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সে সময় ৩০০ আসনে সরাসরি নির্বাচন হয়। আর সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংখ্যা ছিল ১৫টি। ঐ সংসদের প্রথম অধিবেশন বসেছিল ৭ এপ্রিল, তেজগাঁওয়ে অবস্থিত তখনকার জাতীয় সংসদ ভবনে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৯৩টিতে জয়লাভ করে। বঙ্গবন্ধু সে সময় ঢাকা-১২ আসন থেকে বিজয়ী হয়েছিলেন।
১৯৯৬ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। ২০০৪ সালে এই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট আবেদন করা হয়। আদালত তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বৈধ বলে রায় দিয়েছিল। ঐ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়। ২০১১ সালে, অর্থাৎ আওয়ামী লীগের শাসনামলে আপিল বিভাগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সর্ম্পকিত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে। তবে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করলেও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ বলেছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আরও দু’টি সংসদ নির্বাচন হতে পারে।
আওয়ামী লীগ কিন্তু ‘বাতিল’ মানলেও ‘আরো দু’টি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে’ এই অংশটুকু মানেন্ িআদালত বলেছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় যে দুর্বলতাগুলো ধরা পড়েছে, সেগুলো সংসদে ‘সংশোধন’ করে নিতে। আওয়ামী লীগ সংশোধন করেনি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপ করেছে সেদিন বিরোধী দলে থাকা সত্ত্বেও বিএনপি এবং জামায়াত সংসদে না গিয়ে বাইরে থেকে শুধু বিবৃতি দিয়েছে।
গণতন্ত্র আর সুষ্ঠু নির্বাচন প্রসঙ্গে আসলে শুধু ভাষণ-বিবৃতিই দিয়ে চলেছে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি। দল দু’টি ভাষণ-বিবৃতিতে যতটা আন্তরিক, গণতন্ত্র এবং একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনব্যবস্থা চালু রাখায় ততটা আন্তরিক কখনোই ছিল বলে মনে হয় না। ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় তারা যদি গণতন্ত্রের প্রতি খুব আস্থাশীল হতো, তাহলে আজ এই সংকট তৈরি হতো না। তারা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিলেই বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com