শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:২২ পূর্বাহ্ন

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সুদজনিত ক্ষতির ঝুঁকিতে

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় রবিবার, ৩ অক্টোবর, ২০২১

সরকারের বিভিন্ন মেয়াদি ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ করে সুদজনিত ক্ষতির ঝুঁকিতে পড়েছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। বিনিয়োগ চাহিদা কমার কারণে বছরের শুরুতে ব্যাংকঋণের সুদহার নি¤œমুখী ছিল। এতে সরকারের ট্রেজারি বিল বন্ডের সুদহারও কমে যায়। কিন্তু বর্তমানে বিনিয়োগ চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় সুদহার বেড়ে গেছে। একই সাথে বেড়েছে সরকারি ট্রেজারি বিল বন্ডের সুদহার। সুদহার বেড়ে যাওয়ায় আগে যারা বিনিয়োগ করেছিলেন, তারা সম্পদের পুনর্মূল্যায়নজনিত সমন্বয়ের কারণে লোকসানের মুখে পড়ে যাচ্ছেন। এতে ব্যাংকগুলোর সামগ্রিক লোকসান বাড়ছে। এ লোকসান কমাতে এইচটিএম অংশে ধারণকৃত ব্যাংকগুলোর গত এক বছরের বিনিয়োগ করা সরকারি বিভিন্ন বিল বন্ডের সীমা ১২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৭৫ শতাংশ পুনর্র্নিধারণ করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে দাবি জানিয়েছে। জানা গেছে, সরকারের বাধ্যতামূলক ঋণের জোগান দেয়ার জন্য কিছু ব্যাংক তালিকাভুক্ত হয়েছে। যাদেরকে প্রাইমারি ডিলার বা পিডি ব্যাংক বলে। প্রতি সপ্তাহে পূর্বনির্ধারিত ঋণ কর্মসূচি অনুযায়ী সরকার বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে ঋণ নিয়ে থাকে। সরকারের ঋণের জোগান দেয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন সরকারি ট্রেজারি বিল ও বন্ডের নিলামের আয়োজন করে থাকে। ওই নিলামে কোনো ব্যাংক সরকারের ঋণের জোগান দিতে এগিয়ে না এলে বাধ্যতামূলকভাবে পিডি ব্যাংকগুলোকে জোগান দিতে হয়। সাধারণত ২৮ দিন, ৯১ দিন, ১৮২ দিন, ৩৬৪ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের মাধ্যমে স্বল্প মেয়াদে সরকার ঋণ নিয়ে থাকে ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে। আর দীর্ঘ মেয়াদের জন্য ৫ বছর, ১০ বছর, ১৫ বছর ও ২০ বছর মেয়াদি বন্ডের মাধ্যমে ঋণ নিয়ে থাকে। বাজারে টাকার চাহিদা অনুযায়ী এসব বিল ও বন্ডের সুদহার উঠানামা করে।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে প্রায় দেড় বছর ধরে ব্যাংকে বিনিয়োগ চাহিদা কমে গেছে। আবার এ সময় রেমিট্যান্সের মাধ্যমে ব্যাংকগুলো যে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ করত, তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে বিক্রি করে স্থানীয় টাকা নিয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন প্রণোদনা কর্মসূচির আওতায় ঋণ দিয়ে পুনঃঅর্থায়নের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকে নগদ টাকা প্রবেশ করেছে। সব মিলে টাকার প্রবাহ বেড়ে যায়। তখন বিনিয়োগ চাহিদা কমে যাওয়ার কারণে প্রতিটি ব্যাংকের হাতেই উদ্বৃত্ত নগদ অর্থ ছিল। ব্যাংকগুলো তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় কমাতে সরকারকে ঋণ দিতে লাইন ধরে ছিল। এ দিকে টাকার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বর্তমানে সুদহার বেড়ে গেছে। একই সাথে বেড়েছে সরকারি ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদহার। সরকারি ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদহার বেড়ে যাওয়ায় যারা আগে কম সুদে বিনিয়োগ করেছিলেন, তারা পড়ে গেছেন বেকায়দায়; কারণ ব্যাংকগুলোকে ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ করার সময় ঘোষণা দিতে হয়, ধারণকৃত ট্রেজারি বিল ও বন্ড এইচটিএমে সংরক্ষণ করবে, না এইচএফটিতে সংরক্ষণ করবে। এইচটিএম (হেল্ড টু ম্যাচুরিটি) হলো বিনিয়োগ করা ট্রেজারি বিল ও বন্ড মেয়াদ পূর্তি পর্যন্ত ধরে রাখতে হবে। এর জন্য প্রদেয় সুদ বাজার অনুযায়ী পুনর্মূল্যায়ন করা হয় না; অর্থাৎ ট্রেজারি বিল বন্ডের সুদহার বাড়লে কোনো লোকসান গুনতে হয় না ব্যাংকগুলোর। আর এইচএফটি হলো (হেল্ড ফর ট্রেডিং) মেয়াদ পূর্তির আগে যেকোনো সময় ব্যাংকগুলো বিনিময় করতে পারে। এ কারণে মার্ক টু মার্ক ভিত্তিতে তা পুনর্মূল্যায়ন হয়; অর্থাৎ সুদহার বেড়ে গেলে ব্যাংকগুলোর লোকসান গুনতে হয়, আর সুদহার কমে গেলে মুনাফা বাড়ে; যা ব্যাংকগুলোর রিজার্ভে সংরক্ষিত হয়। আর কেউ বিক্রি করলে তা সরাসরি ব্যাংকগুলোর আয় খাতে চলে যায়। যেমন- একটি ব্যাংক ৫ শতাংশ সুদে সরকারের ১০ বছর মেয়াদি বন্ডে বিনিয়োগ করল। কিন্তু কিছু দিন পর সুদহার বেড়ে ৮ শতাংশ হলো। তখন পুনর্মূল্যায়ন করলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের লোকসান গুনতে হবে; কারণ ১০৫ টাকার বন্ড যখন ১০৮ টাকা হয়, তখন সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে ৩ টাকা লোকসান দিয়ে বন্ড বিক্রি করতে হয়। এভাবেই ব্যাংকগুলো লোকসানের মুখে পড়ে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, প্রতি সপ্তাহেই ব্যাংকগুলোর এসব বিল ও বন্ড পুনর্মূল্যায়ন হয়। সুদহার বেড়ে যাওয়ায় পুনর্মূল্যায়নজনিত কারণে বেশির ভাগ ব্যাংক লোকসানের মুখে পড়ে যাচ্ছে। এ লোকসানের পরিমাণ কমাতে এইচটিএম এসএলআরের ১২৫ শতাংশের পরিবর্তে ১৭৫ শতাংশ পুনর্র্নিধারণ করতে পিডি ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে আবেদন করেছে। প্রসঙ্গত, ব্যাংকগুলো ধারণকৃত বিল বন্ড সর্বোচ্চ এসএলআরের ১২৫ শতাংশ এইচটিএমে সংরক্ষণ করতে পারে; যা পুনর্মূল্যায়ন করতে হয় না। নতুন প্রজন্মের একটি ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপক জানিয়েছেন, নতুন ব্যাংক হিসেবে আমানত কম হওয়ায় তাদের এসএলআর সংরক্ষণ করতে হয় কম পরিমাণ। কিন্তু তাদের কাছে সরকারি ট্রেজারি বিল ও বন্ড রয়েছে অধিক পরিমাণ। এ কারণে তাদের প্রতি সপ্তাহেই মার্ক টু মার্ক ভিত্তিতে পুনর্মূল্যায়নজনিত কারণে বিপুল অঙ্কের লোকসান গুনতে হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের দাবি বিবেচনায় নিলে লোকসানের পরিমাণ কমে যেত।
সরকারি ১৮ প্রতিষ্ঠানের ব্যাংকদেনা সাড়ে ৩৩ হাজার কোটি টাকা: সরকারি ১৮টি প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাংকের পাওনা এখন প্রায় সাড়ে ৩৩ হাজার কোটি টাকা। এসব প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সময়ে ব্যাংক থেকে এই ঋণ নিয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠান আবার ঋণ নিয়ে তা সঠিক সময়ে পরিশোধও করেনি। ফলে খেলাপি ঋণের পরিমাণই গিয়ে ঠেকেছে ৬৯ কোটি টাকার ঘরে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি বছরের গত ফেব্রুয়ারি শেষে এ ধরনের ১৮টি সরকারি সংস্থার কাছে ব্যাংকগুলোর বকেয়া পাওনার স্থিতি ছিল ৩৩ হাজার ৪৫১ কোটি ২৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে ৯টি প্রতিষ্ঠানের কিছু ঋণ আবার খেলাপি হয়ে পড়েছে। এর পরিমাণ ৬৮ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। জানা গেছে, গত বছরের তুলনায় রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর পুঞ্জীভূত ব্যাংকঋণ ও খেলাপি ঋণ কমেছে। গত ২০২০ সালের জানুয়ারি শেষে ১৮টি প্রতিষ্ঠানের পুঞ্জীভূত ঋণের পরিমাণ ছিল ৩৯ হাজার ৩৪২ কোটি ৭৯ লাখ টাকা এবং ৯টি প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৮৮ কোটি ১৫ লাখ টাকা। সে হিসাবে ১৩ মাসের ব্যবধানে প্রতিষ্ঠানগুলোর পুঞ্জীভূত ঋণ কমেছে পাঁচ হাজার ৮৯১ কোটি ৫১ লাখ টাকা এবং খেলাপি ঋণ কমেছে ১৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এ বছর দেনার শীর্ষে রয়েছে ‘বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন’ (বিএসএফআইসি)। প্রতিষ্ঠানটির পুঞ্জীভূত ব্যাংকঋণ বাড়ছেই। গত ২০২০ সালের জানুয়ারি শেষে সংস্থাটির ব্যাংকঋণের পরিমাণ ছিল ছয় হাজার ৪৯১ কোটি ১৩ লাখ টাকা। চলতি বছর ফেব্রুয়ারি শেষে এটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ছয় হাজার ৯৮১ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। ‘বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড’ (বিপিডিবি)-এর দেনার পরিমাণ কমেছে। গত বছর বিপিডিবির ব্যাংকঋণের পরিমাণ ছিল সাত হাজার ৬৯১ কোটি ৬২ লাখ টাকা। এক বছরে এটি কমে দাঁড়িয়েছে ছয় হাজার ৫৯ কোটি ৮৪ লাখ টাকা।
বর্তমানে লাভজনক প্রতিষ্ঠান হলেও দেনার দায়ে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে ‘বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন’ (বিপিসি)। তবে গত এক বছরে সংস্থাটির পুঞ্জীভূত ব্যাংকঋণ কমেছে। ২০২০ সালের জানুয়ারি শেষে বিপিসির ব্যাংকঋণের পরিমাণ ছিল পাঁচ হাজার ৩৪৫ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি শেষে এটি কমে দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ৭৮৯ কোটি ৮৮ লাখ টাকা।
আলোচ্য সময়ে ‘বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন’ (বিসিআইসি)-এর দেনার পরিমাণ তিন হাজার ৫১৫ কোটি ৭ লাখ টাকা (গত বছর ছিল ৪ হাজার ১০৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা)। বিএডিসির দেনার পরিমাণ ৩ হাজার ৪০২ কোটি ৪৭ লাখ টাকা (গত বছর ছিল ৩ হাজার ১৩৪ কোটি ৬২ লাখ টাকা)। ‘বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশন’ (বিজেএমসি)-এর দেনার পরিমাণ ৯৭১ কোটি ২৩ লাখ টাকা (গত বছর ছিল ৯৩৫ কোটি ৭ লাখ টাকা)। ‘পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড’ (আরইবি)-এর ব্যাংকঋণের পরিমাণ ৯৭০ কোটি টাকা (গত বছর ছিল এক হাজার ১৪৭ কোটি ১৪ লাখ টাকা)।
‘বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড’ (বিডব্লিউডিবি)-এর দেনার পরিমাণ ৫৬৭ কোটি ৩ লাখ টাকা (গত বছর ছিল ৬৯৩ কোটি ৭৭ লাখ টাকা)। ‘পেট্রোবাংলা’র ব্যাংকঋণ ৩৩৩ কোটি ৭২ লাখ টাকা (গত বছর ছিল দুই হাজার ২০৬ কোটি ৮৫ লাখ টাকা)। ‘ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ’ (টিসিবি)-এর দেনার পরিমাণ ২৬৭ কোটি ২ লাখ টাকা (গত বছর ছিল ৫৩ কোটি ৫১ লাখ টাকা)। ‘বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল সংস্থা’ (বিএসইসি)-এর দেনার পরিমাণ ১১৪ কোটি ৬৪ লাখ টাকা (গত বছর ছিল এক হাজার ৪১১ কোটি ৭ লাখ টাকা)।
এছাড়া ‘বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন’ (বিআরটিসি)-এর দেনার পরিমাণ ৯৫ কোটি ৯৩ লাখ টাকা (গত বছরেও একই ছিল)। ‘চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ’ (সিপিএ)-এর দেনার পরিমাণ ৯৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা (গত বছর ছিল ১১৯ কোটি ৫৫ লাখ টাকা)। ‘বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিল্স করপোরেশন’ (বিটিএমসি)-এর দেনার পরিমাণ ২৫ কোটি ২ লাখ টাকা (গত বছর ছিল ২০ কোটি ৬২ লাখ টাকা)। ‘বাংলাদেশ টি বোর্ড’ (বিটিবি)-এর দেনার পরিমাণ ১০ কোটি ৫২ লাখ টাকা (গত বছর ছিল ১০৭ কোটি ৬৯ লাখ টাকা) এবং ‘বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন’ (বিএসসি)-এর দেনার পরিমাণ দুই কোটি এক লাখ টাকা। এ বিষয়ে অর্থ বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গত ফেব্রুয়ারি মাসে পরিসংখ্যান আমাদের কাছে পাঠিয়েছে। তার ওপর ভিত্তি করেই এই প্রতিবেদন করা হয়েছে। তবে জুুন শেষে দেখা যাবে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাংকের পাওনা আরো বেড়ে গেছে।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com