রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তিন ব্যক্তির দোয়া আল্লাহর কাছ থেকে ফেরত আসে না। এক. ইফতারের সময় রোজাদারের দোয়া। দুই. ন্যায়পরায়ণ শাসকের দোয়া। তিন. মজলুমের দোয়া। আল্লাহ তাআলা তাদের দোয়া মেঘমালার ওপরে তুলে নেন এবং তার জন্য আসমানের দরজাগুলো খুলে দেন। মহান রব বলেন, আমার সম্মানের শপথ, কিছুটা বিলম্ব হলেও আমি তোমাকে অবশ্যই সাহায্য করব।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৩৫৯৮) জুলুম একটি আরবি শব্দ। এর অর্থ হলো নির্যাতন বা অবিচার। সাধারণ অর্থে কাউকে অন্যায়ভাবে শারীরিক, মানসিক, আর্থিক বা যেকোনো পন্থায় অবিচার বা নির্যাতন করাকে জুলুম বলে। তবে জুলুমের সবচেয়ে উত্তম সংজ্ঞা হলো, কোনো কিছু নিজ স্থান বাদ দিয়ে অন্য কোনো স্থানে প্রয়োগ করা বা রাখা। এই সংজ্ঞাটি ব্যাপক অর্থবহ। সব ধরনের জুলুম এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।
জুলুম একটি সামাজিক ব্যাধি। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বত্র ব্যাপক আকার ধারণ করেছে এটি। অন্যের ওপর অন্যায় বা অবিচার করে নিজের পতন ও ধ্বংস ডেকে আনে জালিমরা। আপদ-বিপদ ও দুর্যোগ-বিশৃঙ্খলায় আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম একটি কারণ হলো জুলুম। তাই আল্লাহ তাআলা সবাইকে তা থেকে নিষেধ করেছেন। এমনকি আল্লাহ নিজের জন্যও এটিকে হারাম করেছেন। রাসুল (সা.) হাদিসে কুদসিতে আল্লাহর কথা বর্ণনা করে বলেন, ‘হে আমার বান্দা, আমি নিজের ওপর জুলুম হারাম করেছি এবং তোমাদের জন্যও তা হারাম করেছি। অতএব তোমরা একে অপরের ওপর জুলুম কোরো না।’ (মুসলিম, হাদিস : ৬৭৩৭) আল্লাহ তাআলা সবাইকে ন্যায়পন্থার নির্দেশ দিয়েছেন। কল্যাণ ও ন্যায়পন্থা হলো মানবজীবনের সাফল্যের মূল চাবিকাঠি। পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘আল্লাহ তাআলা তোমাদের ন্যায়পন্থা, অনুগ্রহ ও নিকটাত্মীয়দের হক প্রদানের নির্দেশ দেন এবং অশ্লীল ও নিষিদ্ধ কার্যাবলি থেকে নিষেধ করেন।’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ৯০)
মানুষের অধিকার হরণ করা ও তাদের ধন-সম্পদ আত্মসাৎ করা অনেক বড় জুলুম। এই ধরনের জুলুমের কারণে পুরো পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। শান্তি ও সম্প্রীতি বিনষ্ট হচ্ছে। বিত্তবানরা দারিদ্র্য শ্রেণিকে ও ক্ষমতাবানরা সাধারণ লোকের প্রতি হিংসার বশবর্তী হয়ে নির্যাতন, নিপীড়ন করে। ফলে একসময় জালিম বা অন্যায়কারীর জীবনে নেমে আসে নানা বিপদ-আপদ। যারা মানুষের ওপর জুলুম করে এবং প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে তাদের ব্যাপারে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই যারা মানুষকে অন্যায়ভাবে কষ্ট দেয়, আল্লাহ তাআলা তাদের শাস্তি প্রদান করবেন।’ (মুসলিম, হাদিস : ২৬১৩)। পবিত্র কোরআনের অসংখ্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা জুলুমের ব্যাপারে মানবজাতিকে সতর্ক করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘অচিরেই জালিমরা জানতে পারবে, তাদের প্রত্যাবর্তনস্থল কোথায় হবে।’ (সুরা : শুআরা, আয়াত : ২২৭) অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘জালিমরা কখনো সফলকাম হয় না।’ (সুরা : আনআম, আয়াত : ৫৭)
জুলুমের পরিণাম খুবই ভয়াবহ। জুলুম এমন একটি অন্যায় কাজ, যার শাস্তি আল্লাহ তাআলা ইহকালেও দিয়ে থাকেন। জালিমের বিচার শুধু কিয়ামতের দিবসেই হবে না, বরং দুনিয়া থেকেই আল্লাহ তাআলা তাদের জুলুমের প্রতিদান দেওয়া শুরু করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘দুটি পাপের শাস্তি আল্লাহ তাআলা আখিরাতের পাশাপাশি দুনিয়ায়ও দিয়ে থাকেন। তা হলো, জুলুম ও আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার শাস্তি।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৫১১) সমাজে বিরাজমান অত্যাচার-অনাচার ও বিশৃঙ্খলা-অস্থিরতার মূল কারণ হলো জুলুম। একে অপরের ওপর নানা রকম অবিচারের ফলে আল্লাহ তাআলা মানুষের ওপর এ বিশৃঙ্খলা চাপিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘জল ও স্থলভাগে যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে তা মানুষের কর্মের ফলস্বরূপ।’ (সুরা : রুম, আয়াত : ৪১) মজলুম বা নিপীড়িতের দোয়া কখনো ব্যর্থ হয় না। তাই মজলুমের অশ্রুফোঁটা ও অন্তরের অভিশাপ পতনের অন্যতম কারণ। মজলুমের আর্তনাদের ফলে আল্লাহর পক্ষ থেকে জালিমদের ওপর নেমে আসে কঠিন আজাব। তাদের অধঃপতন ত্বরান্বিত হয়। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তিন ব্যক্তির দোয়া আল্লাহর কাছ থেকে ফেরত আসে না। এক. ইফতারের সময় রোজাদারের দোয়া। দুই. ন্যায়পরায়ণ শাসকের দোয়া। তিন. মজলুমের দোয়া। আল্লাহ তাআলা তাদের দোয়া মেঘমালার ওপরে তুলে নেন এবং তার জন্য আসমানের দরজাগুলো খুলে দেন। মহান রব বলেন, আমার সম্মানের শপথ, কিছুটা বিলম্ব হলেও আমি তোমাকে অবশ্যই সাহায্য করব।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৩৫৯৮)
রাসুল (সা.) আরো বলেন, ‘তোমরা মজলুমের দোয়ার ব্যাপারে সতর্ক থাকো। কেননা মহান আল্লাহ ও তার দোয়ার মাঝে কোনো পর্দা থাকে না।’ (বুখারি, হাদিস : ১৪৯৬) পরিশেষে, মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করি, তিনি যেন আমাদের জালিমদের অত্যাচার-নিপীড়ন থেকে রক্ষা করেন এবং মজলুমের অভিসম্পাত থেকে বাঁচিয়ে রাখেন। আমিন।
ভুলে কারও ওপর জুলুম করলে যে দোয়া পড়বেন: মনের ভুলে কিংবা শয়তানের প্ররোচনায় অনেকেই অন্যায় করে। অন্যের প্রতি জুলুম করে। এসব ক্ষেত্রে জুলুমকারী ব্যক্তির করণীয় কি হবে? সে সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা হজরত মুসা আলাইহিস সালামের একটি ঘটনা ও ক্ষমা প্রার্থনার দোয়া কুরআনে পাকে তুলে ধরেছেন।মুসা আলাইহিস সালাম আল্লাহর কাছে সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং কোনো অন্যায়কারীকে সহযোগিতা না করার প্রতিজ্ঞা করেন- রাব্বি ইন্নি জালামতু নাফসি ফাগফিরলি ফাগাফারা লাহু ইন্নাহু হুয়াল গাফুরুর রাহিমু। রাব্বি বিমা আনআমতা আলাইয়্যা ফালান আকুনা জ্বাহিরাল লিল-মুঝরিমিন।’ (সুরা কাসাস : আয়াত ১৬-১৭) হজরত মুসা আলাইহিস সালাম হাতের আঘাতে (ঘুষিতে) এক ব্যক্তিকে মেরে ফেলেন। সঙ্গে সঙ্গে মুসা আলাইহিস সালাম বুঝতে পারেন এটি শয়তানের কা-। তখনই তিনি একথাটি বলেন এবং মনের ইচ্ছার বিপরীতে এ কাজের জন্য তিনি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। আল্লাহ তাআলা তাকে ক্ষমা করে দেন।
আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারিমে মুসা আলাইহিস সালামের সে ঘটনা ও ক্ষমা প্রার্থনার বিষয়টি মুমিন মুসলমানের শিক্ষা গ্রহণের জন্য সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন, যাতে মুমিন মুসলমানও এভাবে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে পারেন।
কুরআনে উল্লেখিত ঘটনা ও দোয়াটি হলো- আল্লাহ তাআলা বলেন- ‘যখন মুসা যৌবনে পদার্পণ করলেন এবং পরিণত বয়স্ক হয়ে গেলেন, তখন আমি তাঁকে প্রজ্ঞা ও জ্ঞানদান করলাম। এমনিভাবে আমি সৎকর্মীদের প্রতিদান দিয়ে থাকি।’ (সুরা কাসাস : আয়াত ১৪) ‘তিনি শহরে প্রবেশ করলেন, যখন তার অধিবাসীরা ছিল বেখবর। তথায় তিনি দুই ব্যক্তিকে লড়াইরত দেখলেন। এদের একজন ছিল তাঁর নিজ দলের এবং অন্যজন তাঁর শত্রু দলের। অতপর যে তাঁর নিজ দলের (ছিল) সে তাঁর শত্রু দলের লোকটির বিরুদ্ধে তাঁর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করল। তখন মুসা (আলাইহিস সালাম) তাকে ঘুষি মারলেন এবং এতেই তার মৃত্যু হলো। মুসা (আলাইহিস সালাম) বললেন, এটা শয়তানের কাজ। নিশ্চয় সে প্রকাশ্য শত্রু, বিভ্রান্তকারী।’ (সুরা কাসাস : আয়াত ১৫) অতপর হজরত মুসা আলাইহিস সালাম আল্লাহর কাছে আবেদন করলেন এবং বললেন- ‘হে আমার পালনকর্তা, আমি তো নিজের ওপর জুলুম করে ফেলেছি। অতএব, আমাকে ক্ষমা করুন। আল্লাহ তাকে ক্ষমা করলেন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল, দয়ালু।’ (সুরা কাসাস : আয়াত ১৬) মুসা আলাইহিস সালাম আল্লাহর কাছে কারো প্ররোচনায় আর কখনো কোনো অপরাধীকে সাহায্য করবেন না বলেও ঘোষণা করলেন এভাবে- – তিনি বললেন, হে আমার পালনকর্তা, আপনি আমার প্রতি যে অনুগ্রহ করেছেন, এরপর আমি কখনও অপরাধীদের সাহায্যকারী হবো না।’ (সুরা কাসাস : আয়াত ১৭) কুরআনুল কারিমের এ ঘটনা থেকেই আমরা জানতে পারি কোনো ব্যক্তি ভুলে বা শয়তানের প্ররোচনায় কারও প্রতি জুলুম করলে তার জন্য জরুরি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং আর কোনো অপরাধীকে সাহায্য না করার প্রতিজ্ঞা করা।
কুরআনের ভাষায় নাজিলকৃত সে দোয়াটি হলো- রাব্বি ইন্নি জালামতু নাফসি ফাগফিরলি ফাগাফারা লাহু ইন্নাহু হুয়াল গাফুরুর রাহিমু। রাব্বি বিমা আনআমতা আলাইয়্যা ফালান আকুনা জ্বাহিরাল লিল-মুঝরিমিন।’ (সুরা কাসাস : আয়াত ১৬-১৭) অর্থ : ‘হে আমার পালনকর্তা, আমি তো নিজের উপর জুলুম করে ফেলেছি। অতএব, আমাকে ক্ষমা করুন। আল্লাহ তাকে ক্ষমা করলেন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল, দয়ালু। হে আমার পালনকর্তা, আপনি আমার প্রতি যে অনুগ্রহ করেছেন, এরপর আমি কখনও অপরাধীদের সাহায্যকারী হবো না।’
মুসলিম উম্মাহর উচিত, মনের অজান্তে কিংবা মনের ভুলে কারও প্রতি জুলুম বা অত্যাচার করে ফেললে সঙ্গে আল্লাহর কাছে এ দোয়া করা এবং পুনরায় কোনো অপরাধী সাহায্যকারী হওয়া থেকে বিরত থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা জরুরি। আল্লাহ তাআলা মুমিন মুসলমানকে সব সময় এসব ভুল থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করার তাওফিক দান করুন। কোনো অপরাধীকে সহযোগিতা করা থেকে বিরত থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।