অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদ বিদেশে নিয়ে লুকানোর এবং কর ফাঁকির গোপন জগত নিয়ে অনুসন্ধানী এক রিপোর্ট – যার নাম দেয়া হয়েছে প্যান্ডোরা পেপারস্ – নিয়ে বিশ্বজুড়ে তোলপাড় চলছে এখন। বিশ্বের ১১টি দেশের ৬০০ সাংবাদিক কয়েক মাস ধরে কাজ করে এক কোটি ২০ লক্ষ গোপন নথি ফাঁস করতে সমর্থ হয়েছেন। এসব নথিতে দেখা গেছে বিশ্বের অত্যন্ত ক্ষমতাধর কিছু লোক অবৈধভাবে অর্জিত ধন-সম্পদ, টাকা-পয়সা বিদেশে পাচার করে তা লুকিয়ে রেখেছেন। টাকা পাচারের সাথে সংশ্লিষ্ট এসব ব্যক্তির মধ্যে রয়েছেন ৯০ দেশের ৩০০ জনেরও বেশি রাজনীতিক। যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সের লাক্সমি কুমার বলেন, ক্ষমতাধর মানুষেরা বিশ্বের বেশ কিছু দেশ ও অঞ্চলে নিবন্ধিত নামসর্বস্ব বিভিন্ন কোম্পানির মাধ্যমে ‘টাকা পয়সা পাচার করে লুকিয়ে রাখতে সক্ষম হচ্ছেন।’ এ কাজে তাদের সাহায্য করছেন আইনজীবী, আ্যাকাউনটেন্ট ও কেতাদুরস্ত সব পরামর্শক ও দালাল, বলেন তিনি।
পঞ্চাশ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হলো যেভাবে: অনুসন্ধানী এ সাংবাদিকদের জোট আইসিআইজি’র ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, পশ্চিমা বেশ কয়েকটি শক্তিধর দেশের সরকারও হাজার হাজার কোটি ডলারের সম্পদ পাচার ও কর ফাঁকির এ মহোৎসবে পরোক্ষ ভূমিকা রাখছে। আইসিআইজি বলছে, বিশ্ব অর্থনীতির ১০ শতাংশ পাচার হয়ে কয়েক ডজন ‘ট্যাক্স হেভেন‘ অর্থাৎ প্রায় কর-বিহীন অঞ্চলে নিবন্ধিত হাজার হাজার কাগুজে কোম্পানির খাতায় জমা হচ্ছে। পরিণতিতে এসব দেশের সরকার বছরে কম বেশি ৮০,০০০ কোটি ডলার আয়কর থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কিন্তু কোথায় এসব ট্যাক্স হেভেন? কীভাবে গজায় হাজার হাজার এসব ‘শেল‘ অর্থাৎ খোলস-সর্বস্ব কোম্পানি? কিভাবে গোপন থাকে বিনিয়োগের নামে পাচার করা অবৈধ টাকার পাহাড়?
ট্যাক্স হেভেনের পরিধি: পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কর ফাঁকির সব নিরাপদ আস্তানা। এর ভেতর রয়েছে স্বাধীন সার্বভৌম কিছু দেশও – যেমন পানামা, নেদারল্যান্ডস, মাল্টা, মরিশাস। সেইসাথে রয়েছে কয়েকটি দেশের অভ্যন্তরে কিছু অঞ্চল – যেমন যুক্তরাষ্ট্রের ডেলাওয়ার বা ওয়াইয়োমিঙ অঙ্গরাজ্য। আবার কোন কোন দেশ তাদের মূল ভূখ-ের বাইরে কিছু অঞ্চলকে এমন ট্যাক্স হেভেন করে রেখেছে – যেমন ব্রিটিশ শাসিত ক্যারিবীয় দ্বীপ ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জ বা কেইম্যান দ্বীপপুঞ্জ। এখন থেকে পাঁচ বছর আগে ‘পানামা পেপারস‘ নামে কর ফাঁকি নিয়ে ফাঁস হওয়া নথিপত্রে দেখা গিয়েছিল যে পানামা-ভিত্তিক একটি আইন প্রতিষ্ঠান ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জে হাজার হাজার শেল কোম্পানি নিবন্ধনের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। এক হিসাবে, বিশ্বের ৬০টির মত দেশ এবং অঞ্চল রয়েছে যেখানে এসব ‘খোলস’ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। এসব জায়গায় কোম্পানি করের হার খুবই কম। অনেক জায়গায় কর একবারেই দিতে হয় না। অবৈধ সম্পদ গোপন রাখতে বা কর ফাঁকির জন্য যেসব লাখ লাখ মানুষ যখন এসব খোলস কোম্পানি খোলেন, তখন তাদের কাছ থেকে ওই সব দেশ বা অঞ্চলের সরকার অনেক ফি পায়। প্রচুর আইনজীবী, অ্যাকাউনটেন্ট বা পরামর্শকের কাজের সুযোগ তৈরি হয়। কারা ট্যাক্স হেভেন ব্যবহার করেন এক কথায় এর উত্তর হলো, বিশ্বের ধনী লোকজন। কিন্তু একইসাথে অনেক মানুষ যারা ব্যাংকের ঋণ ফেরত দিতে বা কারো পাওয়া শোধ করতে চান না, তারাও তাদের টাকা-পয়সা ট্যাক্স হেভেনগুলোতে নেয়ার চেষ্টা করেন। একইসাথে সাথে রয়েছে ঘুষখোর, মাদক ব্যবসায়ী বা অস্ত্র চোরাচালানে জড়িত লোকজন – যারা তাদের অবৈধ আয় গোপন রাখতে উন্মুখ।
আমদানি রপ্তানির আড়ালে অর্থ পাচার হয় যেভাবে: তবে বড় বড় অনেক বহুজাতিক কোম্পানি যারা বিশ্বজুড়ে লেনদেন করে, তারাও কর ফাঁকির জন্য ট্যাক্স হেভেনে ভিন্ন নামে সহযোগী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান খোলে বলে বহু প্রমাণ পাওয়া গেছে। কাগজে-কলমে ভাগ হয়ে যায় ব্যবসার লেনদেন ও মুনাফা এবং তাতে করে মূল কোম্পানির করের পরিমাণ কমে যায়। নাইকি বা অ্যাপেলের মত কোম্পানির বিরুদ্ধেও ট্যাক্স হেভেন ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে, এ সংক্রান্ত তথ্য-প্রমাণও ফাঁস হয়েছে।
শেল বা খোলস-সর্বস্ব কোম্পানি: বিভিন্ন ট্যাক্স হেভেনে নিবন্ধিত এসব নাম-সর্বস্ব কাগুজে কোম্পানি আদতে কোনো ব্যবসা না করলেও আইনের চোখে এগুলো বৈধ। এসব কোম্পানিতে সার্বক্ষণিক কোন কর্মী নেই। এমনকি অধিকাংশ কোম্পানির কোনো অফিসও নেই। যেমন, আইসিআইজি‘র গত বছরের এক রিপোর্টে বলা হয় যে কেইম্যান দ্বীপপুঞ্জে একটি ভবনেই ছিল ১৯ হাজার কাগুজে কোম্পানির ঠিকানা। এসব কোম্পানির নথিপত্রে মূল মালিকদের কোনো নাম ঠিকানা নেই। কিন্তু পর্দার আড়াল থেকে তারাই এগুলোতে বিনিয়োগ করা অর্থ লেনদেন করেন। তারাই কোম্পানির নামে নানা দেশে জমি-জমা ঘরবাড়ি কেনেন, শেয়ার বাজারে টাকা খাটান। তাদের সাহায্যের জন্য রয়েছে বহু আইনজীবী বা আ্যাকাউনটেন্ট। মোটা ফিয়ের বিনিময়ে তারাই এসব ক্ষেত্রে বুদ্ধি জোগান, কাজ করে দেন। অনেক ক্ষেত্রে কোম্পানি খোলার খরচ অবিশ্বাস্যরকম কম আর জটিলতা নেই বললেই চলে। আইসিআইজি‘র এক রিপোর্ট অনুযায়ী, ‘কোম্পানি খোলা এতই সহজ যে একটি ইমেল বা একটি ফোনকলেই কাজ হয়ে যায়।’ খরচ ও কাগজপত্র বা সই-সাবুদের সংখ্যা নির্ভর করে কোথায় কোম্পানি খোলা হচ্ছে এবং কোন আইনজীবী এ কাজটি করে দিচ্ছেন তার ওপর। যেমন, ‘পানামা পেপারস্‘ কেলেঙ্কারি ফাঁসের জেরে বন্ধ হয়ে যাওয়া পানামা-ভিত্তিক আইনজীবী প্রতিষ্ঠান মোসাক ফনসেকা কোম্পানি প্রতি ফি নিতো ৩৫০ ডলার। তবে আইনজীবীদের এ ফি দু’হাজার ডলার পর্যন্ত হতে পারে। টাকা পাচার নিয়ে লেখা বই সিক্রেসি ওয়ার্ল্ডের লেখক জেক বার্নস্টেইন এক সাক্ষাৎকার মার্কিন দৈনিক বিজনেস ইনসাইডারকে বলেছেন, অনেক ট্যাক্স হেভেনে এমন আইনও রয়েছে যে কোম্পানি মালিকের নাম পরিচয় প্রকাশ করা যায় না। ‘আপনি ভুয়া পরিচালকও রাখতে পারেন, যারা কিছু পয়সার বিনিময়ে মানুষের কাছে আপনার কোম্পানির মালিক হয়ে প্রতিনিধিত্ব করবে।’
কেন বন্ধ হচ্ছে না এই প্রতারণা? আইসিআইজির বেন হলম্যান লিখেছেন, বিশ্বের প্রভাবশালী কিছু দেশ এ ব্যাপারে চোখ বন্ধ করে থাকছে। এমনকি প্রবণতা টিকিয়ে রাখতে সহযোগিতাও করছে। যেমন, ব্রিটিশ শাসিত একাধিক ক্যারিবীয় দ্বীপ বিশ্বের প্রধান সব ট্যাক্স হেভেন। সেসব জায়গায় নিবন্ধিত কোম্পানির নামে লন্ডনে জমি-বাড়ি কেনাকাটা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি অঙ্গরাজ্য যেমন ডেলাওয়ার, ওয়াইয়োমিঙ, নেভাডা, সাউথ ডাকোটাও ট্যাক্স হেভেন হিসাবে পরিচিত। কোম্পানি করের হার এসব রাজ্যে খুবই কম। বিদেশ থেকে কে এখানে টাকা এনে কোম্পানি খুললো এবং কোথায় তা খাটালো, তা নিয়ে এসব রাজ্যের তেমন মাথাব্যথা নেই। মার্কিন অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক হিসাবই বলছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বছরে কমবেশি ৩০ হাজার কোটি ডলার যুক্তরাষ্ট্রে পাচার হয়ে আসছে। সূত্র : বিবিসি