লোভনীয় অফার দিয়ে গ্রাহকদের পণ্য না দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে দেশের বেশ কিছু ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান। অনলাইনভিত্তিক ব্যবসার এসব প্রতিষ্ঠানের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও কোনো সুরাহা পাচ্ছেন না ভুক্তভোগী গ্রাহকেরা। অর্ডার করা পণ্য তো পাননিই, এখন অগ্রিম দেওয়া টাকা ফেরত পাবেন কি না এ নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েছে তারা। কোনো উপায় না দেখে অনেক গ্রাহক দণ্ডবিধি আইনে মামলা করেছেন আত্মসাৎকারী ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের মালিক ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। অধিকাংশ মামলায় দণ্ডবিধির ৪০৬ ও ৪২০ ধারায় অভিযোগ আনা হচ্ছে। এছাড়া প্রতারক প্রতিষ্ঠানগুলোর নামে কেউ কেউ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেও মামলা করছেন। এসব মামলার ধারাগুলোতে সর্বোচ্চ শাস্তি সাত বছরের কারাদণ্ড। এছাড়া আদালত আসামিদের অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে ও দণ্ডিত করতে পারেন। হাজার হাজার কোটি টাকার ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে গড়ে ওঠা ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে গ্রাহকদের পাওনা অর্থের পরিমাণ অনেক। তবে গ্রাহকদের করা মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান থাকলেও আইনে গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেওয়ার সুযোগ নেই। আসামিরা যদি আপস মীমাংসা করেন, কেবল তখনই টাকা ফেরত পেতে পারেন ভুক্তভোগীরা। আইনবিদরা বলছেন, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে আটকে থাকা বিপুল অংকের এ অর্থ ফেরত পেতে গ্রাহকদের দেওয়ানী আদালতে মামলা করতে হবে। অনেক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের মালিক ও কর্ণধারের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা করেছেন গ্রাহকেরা। অধিকাংশ মামলায় দণ্ডবিধি আইনের ৪০৬ ও ৪২০ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। এ ধারাগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ শাস্তি সাত বছরের কারাদণ্ড। আদালত চাইলে অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ড দিতে পারেন। আইনানুযায়ী এ মামলাগুলোর মাধ্যমে গ্রাহকদের পাওনা টাকা ফেরত পাওয়ার সুযোগ নেই। কেবল দুপক্ষের আপস মীমাংসার মাধ্যমেই গ্রাহকেরা টাকা ফেরত পেতে পারেন
সম্প্রতি ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, কিউকম ও রিং আইডি মতো কিছু ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের মালিক ও কর্মকর্তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা করেন প্রতারণার শিকার গ্রাহকেরা। মামলার পর এসব প্রতিষ্ঠানের বেশ কিছু কর্তাব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গ্রেফতারদের কাউকে কাউকে একাধিকবার রিমান্ডেও নেওয়া হয়েছে।
দণ্ডবিধি আইনের মামলায় অভিযোগ প্রমাণে যে শাস্তি: দণ্ডবিধির ৪০৬ ধারায় অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গের শাস্তির বিষয়টি বলা আছে। ওই ধারা অনুসারে, কোনো ব্যক্তি যদি অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গ করে, তবে সে ব্যক্তি তিন বছর পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্ৰম কারাদণ্ডে, অথবা অর্থ দণ্ডে, অথবা উভয়বিধ দণ্ডে ই দণ্ডিত হবে। দণ্ডবিধির ৪২০ ধারায় বলা আছে, প্রতারণা ও সম্পত্তি সমর্পণ করার জন্য অসাধুভাবে প্রবৃত্ত করা কোনো ব্যক্তি যদি প্রতারণা করে এবং প্রতারিত ব্যক্তিকে অসাধুভাবে অপর কোনো ব্যক্তি যদি কোনো সম্পত্তির অংশ বা অংশবিশেষ প্রণয়ন, পরিবর্তন বা বিনাশ সাধনে প্রবৃত্ত করে অথবা অসাধুভাবে প্রতারিত ব্যক্তিকে এমন কোনো স্বাক্ষরিত বা সিল মোহরযুক্ত বস্তুর সমুদয় অংশ বা অংশবিশেষ প্রণয়ন পরিবর্তন বা বিনাশ সাধনে প্রবৃত্ত করে, যা মূল্যবান জামানতে রূপান্তরযোগ্য, তবে ওই ব্যক্তি সাত বছর পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে এবং তদুপরি অর্থদণ্ড ও হতে পারে। দণ্ডবিধি আইনের মামলা করে ই-কমার্সের ভুক্তভোগী গ্রাহকেরা টাকা ফেরত পাবেন না। এজন্য তাদের যেতে হবে দেওয়ানী আদালতে। সেখানে মামলা করলে তবেই টাকা ফেরত পাওয়ার ক্ষেত্র তৈরি হতে পারে
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর (এপিপি) তাপস কুমার পাল জাগো নিউজকে বলেন, অনেক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের মালিক ও কর্ণধারের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা করেছেন গ্রাহকেরা। অধিকাংশ মামলায় দণ্ডবিধি আইনের ৪০৬ ও ৪২০ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। এ ধারাগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ শাস্তি সাত বছরের কারাদণ্ড। আদালত চাইলে অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ড দিতে পারেন। আইনানুযায়ী এ মামলাগুলোর মাধ্যমে গ্রাহকদের পাওনা টাকা ফেরত পাওয়ার সুযোগ নেই। কেবল দুপক্ষের আপস মীমাংসার মাধ্যমেই গ্রাহকেরা টাকা ফেরত পেতে পারেন।
আইনজীবী জি এম মিজানুর রহমান বলেন, দণ্ডবিধি আইনের মামলা করে ই-কমার্সের ভুক্তভোগী গ্রাহকেরা টাকা ফেরত পাবেন না। এজন্য তাদের যেতে হবে দেওয়ানী আদালতে। সেখানে মামলা করলে তবেই টাকা ফেরত পাওয়ার ক্ষেত্র তৈরি হতে পারে।
আইনজীবী খালেদ হোসেন বলেন, প্রতারণার অভিযোগে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের অনেকে গ্রেফতার রয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলাও হয়েছে। এসব মামলায় আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি সাত বছরের কারাদণ্ডের বিধান থাকলেও ভুক্তভোগী বা প্রতারিতদের পাওনা অর্থ ফেরত পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। গ্রাহকদের টাকা আত্মসাতের মামলায় গত ১৬ সেপ্টেম্বর ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন এবং তার স্বামী প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ রাসেলকে গ্রেফতার করে র্যাব। গ্রেফতারের আগে ও পরে তাদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা করেন গ্রাহকেরা। ভুক্তভোগীদের কেউ মোটরসাইকেল-এসির মতো অর্ডার করা পণ্যের টাকা ফেরত না পেয়ে দণ্ডবিধি আইনের ৪০৬ ও ৪২০ ধারায় মামলা করেন। বর্তমানে এ দম্পতি কারাগারে রয়েছেন। যদিও রাসেল-শামীমার মুক্তি চেয়ে ইভ্যালি গ্রাহকদের অনেকে মানববন্ধনও করেছেন। এক হাজার ১০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে করা মামলায় গত ১৭ আগস্ট ই-অরেঞ্জের মালিক সোনিয়া মেহজাবিন ও তার স্বামী মাসুকুর রহমান ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন আবেদন করেন। আদালত জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। এরপর প্রতারণার অভিযোগে এ দম্পতির বিরুদ্ধে একাধিক মামলা করেন ভুক্তভোগী গ্রাহকেরা। মামলার পর তাদের একাধিকবার রিমান্ডে নেওয়া হয়। সর্বশেষ গত ৭ অক্টোবর গুলশান থানায় প্রতারণার পৃথক দুই মামলায় তাদের দুদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন মহানগর হাকিম আদালত। পরে দুজনকে কারাগারে পাঠানো হয়।
এছাড়া এ মামলায় গ্রেফতার রয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির চিফ অপারেটিং অফিসার (সিওও) আমানউল্লাহ। একাধিক মামলায় তাকেও দেওয়া হয়েছে রিমান্ডে। ই-অরেঞ্জের গ্রাহকের টাকা আত্মসাতের অভিযোগের মধ্যে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গত ৩ সেপ্টেম্বর ভারত-নেপাল সীমান্তে বিএসএফের হাতে আটক হন বনানী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সোহেল রানা। তিনি ই-অরেঞ্জের মালিক সোনিয়া মেহজাবিনের আপন ভাই ও প্রতিষ্ঠানটির পৃষ্ঠপোষক হিসেবে পরিচিত। সোহেল রানাকে ভারত থেকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য দিল্লিতে অবস্থিত ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরোকে (এনসিবি) এরই মধ্যে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ।
স¤প্রতি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান কিউকম কোম্পানির মালিক রিপন মিয়ার বিরুদ্ধে রাজধানীর পল্টন থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও প্রতারণার অভিযোগে মামলা করেন একজন ভুক্তভোগী। মামলার পরিপ্রেক্ষিতে গত ৩ অক্টোবর তাকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) মতিঝিল বিভাগ। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, কিউকমের কাছে গ্রাহকদের প্রায় ২৫০ কোটি টাকার পণ্য আটকে আছে। গ্রেফতারের পরদিন ৪ অক্টোবর রিপন মিয়াকে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করে পুলিশ। এরপর পল্টন থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও প্রতারণার অভিযোগে করা মামলায় তাকে দুই দিনের রিমান্ড নেওয়া হয়। রিমান্ড শেষে গত ৭ অক্টোবর তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন বিচারক। রাজধানীর ভাটারা থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলায় রিং আইডির পরিচালক সাইফুল ইসলামকে গত ১ অক্টোবর রাজধানীর গুলশান এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। পরদিন ২ অক্টোবর সাইফুলকে দুদিনের রিমান্ডে পাঠানো হয়। রিমান্ড শেষে গত ৫ অক্টোবর তাকে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করে পুলিশ। এরপর মামলার তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাকে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। অন্যদিকে তার আইনজীবী জামিন চেয়ে আবেদন করেন। ঢাকা মহানগর হাকিম আতিকুল ইসলাম তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়ে জামিন শুনানির জন্য ১১ অক্টোবর (সোমবার) দিন ধার্য করেন। পরে গত সোমবার শুনানিতে সাইফুলের আইনজীবী জামিন চাইলেও আদালত তা নামঞ্জুর করেন।