সূচকে এক ধাপ পেছালেও প্রতিবেশিদের চেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশসূচকে এক ধাপ পেছালেও প্রতিবেশিদের চেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ ক্ষুধা ও অপুষ্টি নিরসনে প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়ে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। ১১৬টি দেশের তথ্য নিয়ে প্রকাশ করা এবছরের বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। বৃহস্পতিবার ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট এই সূচক প্রকাশ করেছে। এতে গত বছরের চেয়ে এক ধাপ নিচে নেমে নেপালের সঙ্গে বাংলাদেশের অবস্থান ৭৬তম। আর পাকিস্তান ৯২তম এবং ভারতের অবস্থান ১০১তম। আর বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে যাওয়া মিয়ানমারের অবস্থান ৭১তম।
গত বছর ১০৭টি দেশের তথ্য নিয়ে প্রকাশ করা হয় বিশ্ব ক্ষুধা সূচক। এতে মিয়ানমার, ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে ছিলো বাংলাদেশ। গত বছর বাংলাদেশের অবস্থান ৭৫তম। আর মিয়ানমার ৭৮তম, পাকিস্তান ৮৮তম এবং ভারতের অবস্থান ছিলো ৯৪তম। ১০০ পয়েন্টের ভিত্তিতে প্রতিটি দেশের স্কোর হিসাব করে বিশ্ব ক্ষুধা সূচক প্রকাশ করে থাকে ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট। সূচকে সবচেয়ে ভালো স্কোর হলো শূন্য। স্কোর বাড়ার অর্থ হলো সেই দেশের ক্ষুধা পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। আর স্কোর কমে যাওয়ার অর্থ হলো সেই দেশের খাদ্য ও পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে।
ক্ষুধা সূচক অনুযায়ী, বাংলাদেশের স্কোর ১৯.১। এর অর্থ বাংলাদেশে মাঝারি মানের ক্ষুধা রয়েছে। এবারের সূচকে পাঁচেরও কম স্কোর নিয়ে ক্ষুধা সূচকের শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে ১৮টি দেশ। এর মধ্যে রয়েছে চীন, বেলারুশ, ব্রাজিল, তুরস্ক, কিউবা ও কুয়েত।
বর্তমানে চাল উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়: স্বাধীনতার আগে পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিবছর খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল গড়ে ১৫ থেকে ২০ লাখ টন। হানাদারদের গণহত্যা ও তা-বের কারণে এদেশে ঘাটতি আরও বেড়ে ১৯৭১-৭২ অর্থবছরে দাঁড়ায় ৩০ লাখ টন, যা সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মোট উৎপাদনের প্রায় ৩০ শতাংশ। এরপর থেকে প্রতিবছর কমছে জমি; বাড়ছে মানুষ। তারপরও ৫০ বছরে কৃষির কল্যাণে সেই ঘাটতির বাংলাদেশ এখন বাড়তি খাদ্যশস্য উৎপাদনকারী। বেশ কিছু তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ১৯৭০-৭১ সালে দেশে মোট খাদ্যশস্যের উৎপাদন ছিল এক কোটি ১০ লাখ টন। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে চার কোটি ৫৩ লাখ টন। যদিও এ সময়ের ব্যবধানে প্রতিবছর দেশে মানুষ বাড়ছে ২০ লাখ, কৃষিজমি কমেছে আট লাখ হেক্টর করে। তারপরও খাদ্যের উৎপাদন বাড়ায় জনপ্রতি খাদ্যের সরবরাহ কমেনি, বরং বেড়েছে। ১৯৭২ সালে যেখানে একজন মানুষ প্রতিদিন খাদ্য পেতেন (খাদ্যশস্যের প্রাপ্যতা) ৪৫৬ গ্রাম, তা ২০২০ সালে বেড়ে হয়েছে ৬৮৭ গ্রাম।
স্বাধীনতার পর বিভিন্ন খাতে দেশের যে অর্থনৈতিক অগ্রগতি হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান খাত হলো কৃষিখাত। ৫০ বছরের বাংলাদেশের কৃষির সর্বোচ্চ সফলতা এসেছে শেষ এক-দেড় দশকে
কৃষি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত ৫০ বছরে দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়েছে বছরে গড়ে প্রায় ৩ শতাংশ হারে। এর মধ্যে দানাদার খাদ্যশস্য ছাড়াও বিভিন্ন প্রকার খাদ্যের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। সব মিলিয়ে খাদ্য উৎপাদনে বিশ্বের নতুন বিস্ময়ের নাম বাংলাদেশ।
বর্তমানে চাল উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। তাছাড়া পাট উৎপাদনে বাংলাদেশের স্থান দ্বিতীয়, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, চাষকৃত মৎস্য উৎপাদনে দ্বিতীয়, আম উৎপাদনে সপ্তম ও আলু উৎপাদনে অষ্টম। তথ্য বলছে, ৫০ বছরে গম উৎপাদন বেড়েছে দ্বিগুণ, ভুট্টা ১০ গুণ। ২০২০ সালে গম উৎপাদন হয়েছে ১২ লাখ ৫০ হাজার টন, পরিমাণের দিক দিয়ে যা স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে অর্ধেক ছিল। শুধু তাই নয়, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ভুট্টায় সর্বোচ্চ সফলতা আসে। এরপর ২০২০ সালে ৫৪ লাখ টন ভুট্টা খাদ্যশস্যের তালিকায় যুক্ত হয়।
এদিকে প্রধান খাদ্যশস্যের বাইরে দেশে সবজি উৎপাদনে নীরব বিপ্লব ঘটেছে। সবজি উৎপাদন বৃদ্ধির হারের দিক থেকে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়। স্বাধীনতার পর দেশে সবজির উৎপাদন বেড়েছে পাঁচগুণ। গত বছর সবজি উৎপাদন বেড়ে এক কোটি ৭২ লাখ ৪৭ হাজার টনে পৌঁছেছে। এর মধ্যে আলু উৎপাদনে বাংলাদেশ উদ্বৃত্ত এবং বিশ্বে সপ্তম। গত বছর আলু উৎপাদন হয়েছে এক কোটি ৯ লাখ টন, যা দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদার থেকেও প্রায় ৪০ হাজার টন বেশি। এছাড়া ফল উৎপাদনে বিশ্বে ২৮তম বাংলাদেশ। মৌসুমী ফল উৎপাদনে গত বছর বিশ্বের শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় নাম লিখিয়েছে বাংলাদেশ।
৫০ বছরে দেশে ভুট্টা উৎপাদন বেড়েছে ১০ গুণ: খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) হিসাবে, ১৮ বছর ধরে বাংলাদেশে সাড়ে ১১ শতাংশ হারে ফল উৎপাদন বাড়ছে। একই সঙ্গে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ চারটি ফলের মোট উৎপাদনে বাংলাদেশ শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় উঠে এসেছে। কাঁঠাল উৎপাদনে বিশ্বের দ্বিতীয়, আম সপ্তম এবং পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম স্থানে বাংলাদেশ। অন্যদিকে কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, বছরে ১০ শতাংশ হারে ফল চাষের জমি বাড়ছে। এক দশকে দেশে আমের উৎপাদন দ্বিগুণ, পেয়ারা দ্বিগুণের বেশি, পেঁপে আড়াই গুণ এবং লিচু উৎপাদন ৫০ শতাংশ হারে বেড়েছে। এছাড়া বড় সাফল্য রয়েছে পানীয় উৎপাদনে। এক সময় উৎপাদন থেকে চাহিদা বাড়ায় আমদানিনির্ভর হয়ে পড়েছিল চা। সে পরিস্থিতি কেটে এখন চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেড়েছে। ২০১৯ সালে চা উৎপাদনেও রেকর্ড করে বাংলাদেশ। ১৬৬ বছরের চা চাষের ইতিহাসে যা প্রথম।
ওই বছর চা উৎপাদন হয়েছে নয় কোটি ৬০ লাখ ৬৯ হাজার কেজি, যা তার আগের বছরের চেয়ে এক কোটি ৩৯ লাখ কেজি বেশি। লন্ডনভিত্তিক ‘ইন্টারন্যাশনাল টি কমিটি’ প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, এখন চা উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে নবম। পাশাপাশি মাছ, মাংস, দুধ ও ডিম উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। মাছ উৎপাদন বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। মৎস্য খাতে বর্তমান গড় প্রবৃদ্ধির হার প্রায় ৬ শতাংশ। বিশেষ করে ইলিশের উৎপাদনে সাম্প্রতিক প্রবৃদ্ধি ছিল চোখে পড়ার মতো।
পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ইলিশ এখন বাংলাদেশে উৎপাদন হচ্ছে। অন্যদিকে মাংস উৎপাদনে চতুর্থ স্থানে দেশ; গবাদিপশু পালনে ১২তম। তাছাড়া পুষ্টির অন্যান্য উপাদান ডিম ও দুধ উৎপাদনে বিপুল পরিমাণে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। কৃষিখাতে অভূতপূর্ব সাফল্যের বিষয়ে একুশের পদকপ্রাপ্ত কৃষি অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, ‘স্বাধীনতার পর বিভিন্ন খাতে দেশের যে অর্থনৈতিক অগ্রগতি হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান খাত হলো কৃষিখাত। ৫০ বছরের বাংলাদেশের কৃষির সর্বোচ্চ সফলতা এসেছে শেষ এক-দেড় দশকে।‘ তিনি বলেন, ‘বর্তমান সরকার প্রথম থেকেই খাদ্যনিরাপত্তা ও ঘাটতি কমাতে আন্তরিক ছিল। যেভাবে সরকার কৃষিখাতে আর্থিক সমর্থন ও নীতিগত সহায়তা দিয়েছে তা অন্য যেকোনো সময়ের থেকে বেশি। কৃষিখাতে এ অভূতপূর্ব সাফল্য সরকারের সহায়তা ছাড়া সম্ভব ছিল না।’
এই কৃষি অর্থনীতিবিদ জানান, গত অর্ধশতাব্দীতে দেশে শস্যের উৎপাদন গড়ে ৩ শতাংশ হারে বেড়েছে। যেখানে সারাবিশ্বে উৎপাদন বৃদ্ধির হার ২ দশমিক ৩ শতাংশ। শস্যের নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনে বাংলাদেশ এখন শীর্ষে। অন্যদিকে সরকারি গুরুত্বের কারণে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগও প্রচুর বেড়েছে। কৃষি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জমির সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার কারণে দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। সাম্প্রতিককালে নতুন প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে এ খাতে। কৃষিকাজে যন্ত্রের ব্যবহার এখন অনেক সম্প্রসারিত হয়েছে। এখন ৯৫ শতাংশ জমি আবাদ হচ্ছে যন্ত্রপাতির মাধ্যমে। এছাড়া উচ্চ ফলনশীল জাতের আওতায় এসেছে ৮৫ শতাংশ ধানি জমি। দেশে বিভিন্ন সংস্থার গবেষণায় প্রচুর উচ্চ ফলনশীল, স্বল্পমেয়াদি ও পরিবেশসহিষ্ণু নতুন জাত উদ্ভাবন হয়েছে। জাত সম্প্রসারণ ও নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে বাংলাদেশ এখন শীর্ষ। ফলে দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে খাদ্যশস্যের উৎপাদন।
তারা বলছেন, আগের ছোট ছোট পর্যায়ের কৃষি এখন পরিণত হয়েছে বাণিজ্যিক কৃষিতে। পাশাপাশি কৃষিবান্ধব নীতি, সরকারি প্রণোদনা ও সহায়তায় কৃষকের উন্নয়ন হয়েছে। এক সময় যে সার ও বীজ নিয়ে ছিল হাহাকার, সেটা এখন বেশ সহজলভ্য। অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় ফসল আবাদের জন্য কৃষক এখন বেশি পরিমাণ গুণগতমানসম্পন্ন বীজ ও সার পাচ্ছেন। কৃষি সংশ্লিষ্টরা এও বলছেন, সব কিছুর পরও যে কৃষির প্রাণ কৃষকরাই তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাদের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের কোনো পরিসংখ্যান নেই। ১৯৭০ সালে কৃষিজমিতে বছরে একটি ফসল হতো, তারাই এ জমি তিন ফসলি করেছেন। কোথাও কোথাও একটি জমিতে বছরে চারটি ফসল ফলিয়ে বিশ্বকে তাক লাগিয়েছেন বাংলার কৃষক। বন্যা, খরাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগেও সোনার ফসল ফলিয়েছেন তারা। এমনকি দাম না পাওয়াসহ অন্যান্য বিপর্যয়ও দমাতে পারেনি কৃষকদের।