জনগণের ভোটাধিকার রক্ষায় বিএনপির নেতৃত্বধীন দল আন্দোলনের কোন বিকল্প দেখ না। বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, দল গুছিয়ে বিএনপি একটি বৃহত্তর আন্দোলনে পা বাড়াবে। নীতিনির্ধারকরা সেই পর্বকে ‘ডু অর ডাই’ গেমও বলছেন। মাস চারেক পরেই শেষ হচ্ছে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ। এরপর নতুন যে কমিশন দায়িত্ব নেবে তার অধীনেই হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নতুন এই ইসি গঠন নিয়ে ইতোমধ্যে রাজনৈতিক অঙ্গনে তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়েছে। নির্বাচন কমিশন গঠনে সুনির্দিষ্ট কোনো আইন না থাকায়, প্রতিবারই জটিলতা দেখা দেয়। সার্চ কমিটির মাধ্যমে কমিশন গঠনের যে সংস্কৃতি চালু আছে, তা নিয়েও বিতর্কের শেষ নেই। সার্চ কমিটির প্রতি দারুণ অনাস্থা রয়েছে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর। তাদের বক্তব্য, সার্চ কমিটির মাধ্যমে সরকারই তাদের অনুগত লোকদের দিয়ে কমিশন গঠন করে। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে সম্ভাব্য নাম চাওয়া হলেও তা চূড়ান্তভাবে আমলে নেয়া হয় না। এ ক্ষেত্রে বিশেষ করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) হিসেবে যাকে নির্বাচন করা হয়, সে সরকারের লোক হিসেবেই বিবেচিত হয়।
সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘(১) প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনধিক চারজন নির্বাচন কমিশনারকে লইয়া বাংলাদেশের একটি নির্বাচন কমিশন থাকিবে এবং ওই বিষয়ে প্রণীত কোনো আইনের বিধানাবলিসাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগদান করিবেন।’ সংবিধানের আলোকে ওই আইন না হওয়ায় প্রতিবারই নির্বাচন কমিশন গঠনে জটিলতা দেখা দেয়। সেই জটিলতা এড়াতে শেষ দুইবার সার্চ কমিটি গঠন করে ব্যবস্থা নেয়া হলেও বিতর্ক থামেনি।
সরকার এবারও একই পদ্ধতি অনুসরণ করবে বলে ইতোমধ্যে জানিয়েছে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে। নতুন করে অন্য কোনো কথা বলার অবকাশ নেই। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠনের যে অভিজ্ঞতা আমাদের আছে, সেই অভিজ্ঞতা হচ্ছে, এক. এটি একেবারেই সরকারের নিজস্ব লোকজনকে দিয়ে, প্রাধান্য দিয়ে গঠন করা হয়। দুই. এটা ধোঁকাবাজি ছাড়া কিছু নয়। ২০১৮ সালে সার্চ কমিটির মাধ্যমে কে এম নুরুল হুদার যে কমিশন গঠন করা হয়েছিল, সেই কমিশন পুরোভাবে সরকারের চেয়েও অনেক ক্ষেত্রে আগ বাড়িয়ে দলীয় ভূমিকা পালন করেছে। এই সার্চ কমিটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হবে না। বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ সালের শুরুর দিকে দল গোছানোর কাজ শেষ করে মাঠের কর্মসূচিতে নামবে দলটি; যা বিভিন্ন পর্যায় পেরিয়ে নির্বাচনের আগে কঠোর হতে পারে। পাশাপাশি দলটি কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানোর দিকেও মনোযোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
নির্বাচন ইস্যুতে সেই পুরনো সঙ্কটের দিকেই এগোচ্ছে রাজনীতি। বিগত দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে আন্দোলন করে আসা বিএনপি এবার আরো আঁটঘাট বেঁধে মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে। নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায় না হলে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা ইতোমধ্যে দিয়ে রেখেছে দলটি। অন্য দিকে সরকারি দল বলেছে, গত দুটি সংসদ নির্বাচনের মতো একই পন্থায় দলীয় সরকারের অধীনেই হবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন। বিরোধী দলগুলো থেকে সংবিধান সংশোধন করে ফের তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল করার যে দাবি তোলা হয়েছে, তাও নাকচ করে দেয়া হয়েছে। পরিস্থিতি বলছে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচনের আগে পরিস্থিতি আবারো ঘোলাটে হতে পারে। দেখা দিতে পারে রাজনৈতিক গোলযোগ।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে এবং পরে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে দীর্ঘ আন্দোলন করেছে সরকারের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি। এই দাবিতে দীর্ঘসময় ধরে দেশব্যাপী হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছে তারা। দাবি আদায় না হওয়ায় ওই নির্বাচন বয়কট করে আন্দোলনে থাকে দলটি। রাজনৈতিক অঙ্গনে তখন আলোচনা ছিল, সরকার দ্রুত আরেকটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেবে, কিন্তু সেটি বিএনপি আদায় করে নিতে পারেনি। উল্টো আওয়ামী লীগ সরকারই দিনকে দিন নানামুখী কূটনৈতিক তৎপরতা ও রাজনৈতিক কলাকৌশল প্রয়োগ করে ক্ষমতা অটুট রাখে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগেও বিরোধী জোটের দাবি ছিল নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার। এই দাবিতে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্ট হরতাল-অবরোধের দিকে না গিয়ে আলোচনার টেবিলে ছিল। কিন্তু কোনোরূপ প্রত্যাশার জায়গা তৈরি না করেই নির্বাচনে অংশ নেয় ফ্রন্ট। মাত্র সাতটি আসন লাভ করে তারা। বিএনপি ওই ফলাফল প্রত্যাখ্যান করলেও কোনো আন্দোলনের কর্মসূচিতে যায়নি। জানা গেছে, কর্মসূচি ঘোষণা নিয়ে তখন বিএনপি ও ড. কামাল নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের মধ্যে মতদ্বৈধতা ছিল।
গত মাসে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা দলীয় ফোরামে নেতাদের নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়ার আহ্বান জানানোর পর নির্বাচনমুখী রাজনীতি গতি লাভ করে। বিএনপি এর পরপরই কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি, জেলা পর্যায়ের নেতা ও পেশাজীবীদের সাথে সিরিজ বৈঠক করে। এসব বৈঠকে মূলত সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার উপর জোর দেন নেতারা। দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ না নেয়ার কথা বলেন। ওই সিরিজ বৈঠকের পর বিএনপি দ্রুত দল গোছানোর কাজে হাত দিয়েছে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সারা দেশে দল গোছানোর কাজ শেষ করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। অঙ্গসংগঠনগুলোতেও নতুন কমিটি দেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া দেশে কোনো নির্বাচন হবে না। আন্দোলন গড়ে তুলে এই দাবি আদায় করা হবে। অন্য দিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, গত দুটি নির্বাচন যে পদ্ধতিতে হয়েছে, সেইভাবেই হবে আগামী জাতীয় নির্বাচন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি সরাসরি নাকচ করে দিয়েছেন।