সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:২১ অপরাহ্ন

প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ‘তাওয়াক্কুল’

খাদিজা বিনতে জহির সুমাইয়া:
  • আপডেট সময় সোমবার, ১ নভেম্বর, ২০২১

জীবনে চলার পথে চারপাশ থেকে একের পর এক বিপদ যখন আমাদেরকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে, হুট করে যখন আমাদের প্রিয়জন-প্রিয়মুখ রবের সাক্ষাতে চলে যায়, ভিন্ন ভিন্ন অবস্থায়- ভিন্ন ভিন্ন রূপে যখন আমাদের জীবনে দুর্ভোগ নেমে আসে- এমন সব পরিস্থিতিতে আমরা হতাশ হয়ে যাই, দুমড়ে-মুচড়ে ভেতরটা গুঁড়িয়ে যায়, ধৈর্যচ্যুত হয়ে অভিযোগের সুরে আল্লাহকে বলি, ‘আল্লাহ! আমি কী দোষ করেছি যে আমার সাথেই এমনটা হবে?’
জীবনের এরকম মুহূর্তগুলোকে পরীক্ষা হিসেবে গ্রহণ করে নেয়াই হলো প্রকৃত মুমিনের কাজ?
শিক্ষাজীবনে ‘সারপ্রাইজ টেস্ট’ শব্দটা শিক্ষার্থীদের জন্য রীতিমতো আতঙ্ক। হুট করে ক্লাস টেস্টের মুখোমুখি হলে আমরা চিন্তিত হয়ে পড়ি। কিন্তু দুনিয়ার জীবনে আল্লাহ তায়ালা যে আমাদেরকে বিভিন্ন বিপদে-আপদে ফেলে পরীক্ষা করবেন সে সম্পর্কে তিনি আগেই আমাদেরকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। সূরা বাকারার ১৫৫ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব ভয়, ক্ষুধা এবং (তোমাদের) জানমাল ও ফসলাদির ক্ষয়ক্ষতির মাধ্যমে। পরীক্ষা সম্পর্কে এমন পূর্ব সতর্কবার্তা পাওয়ার পরও যদি আমরা এটিকে আকস্মিক বিপদ মনে করে হা-হুতাশ করি তাহলে সেটি আমাদের কুরআন অনুধাবন করতে না পারার ব্যর্থতা।
কুরআনে যেমন মুসলমানদের পরীক্ষা নেয়ার কথা উল্লেখ আছে, তেমনি সেই প্রতিকূল পরিস্থিতি কার পক্ষ থেকে আসবে/কেন আসবে সেটিও উল্লেখ করা আছে। সূরা তাগাবুনের ১১ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত কারো ওপর কোনো বিপদ আসে না।’ কুরআন নিজে সাক্ষ্য দিচ্ছে, আপনার ওপর আরোপিত এই বিপদ আল্লাহর অনুমতিতে আপনার কাছে এসেছে, তাহলে আপনি কেনো সেটাতে এত মুষড়ে পড়ছেন?
চরম ক্রান্তিলগ্নে, কঠিন বিপদে যদি নিজেকে বোঝানো যায়- এই বিপদ আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে। তিনি চেয়েছেন বলে এমনটা হয়েছে, তিনি না চাইলে এরকম বিপদ কখনোই আপনাকে গ্রাস করত না, তাহলে এর চেয়ে বড় সেলফ মোটিভেশন আর কিছু হতে পারে না।
আরেকটি বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন, আমাদের ওপর আরোপিত এই বিপদ আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনো শাস্তি নয়, বরং এগুলো ঈমানের পরীক্ষা। সূরা বাকারার ১৫৪ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমাদের বুকে যা আছে তা পরীক্ষা করা ছিল আল্লাহর ইচ্ছা আর তোমাদের অন্তরে যা কিছু আছে তা পরিষ্কার করা ছিল তাঁর কাম্য।’
বিপদ কেন আসে, কার পক্ষ থেকে আসে- এটুকু জানার পর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে বিপদের সময় আমাদের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে, প্রতিকূল পরিস্থিতিতে আমাদের তাওয়াক্কুলের পরিমাণ কতটুকু বাড়াতে হবে, তা জানা।
তাওয়াক্কুল ঈমানি গুণের ধারক। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে একাগ্রচিত্তে তাওয়াক্কুল করা মুমিনের পরিচয়। মুসা আ:-এর তাওয়াক্কুলের জোর কত বেশি ছিল বলে নীল নদের বুক চিড়ে তাঁর জন্য রাস্তা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। আপনি-আমি গিয়ে নীল নদে আঘাত করলে সে রকমটি আবার হবে? কখনোই না। আমাদের তাওয়াক্কুলটাও তেমন প্রবল হওয়া উচিত। মূসা আ: যেমন আল্লাহর ওপর ভরসা করেছিলেন, আল্লাহও তাঁর ওপর রহম করেছিলেন।
দুনিয়াতে আপনার-আমার চলমান বিপদগুলো কখনোই ইউনূস আ:-এর চেয়ে বেশি নয়। সমুদ্রের বিশালাকার মাছের পেটে চলে যাওয়ার মতো সঙ্কট দুনিয়ার জীবনে আর কী হতে পারে? কিন্তু এমন পরিস্থিতিতেও তিনি একবারের জন্যও আল্লাহর কাছে অভিযোগ করেননি। আল্লাহকে দোষারোপ করেননি। বলেননি যে, আপনি আমাকে নবী হিসেবে পাঠিয়েছেন, আমি এত দায়িত্ব পালন করলাম, তারপরেও কেন আমার ওপর এরকম বিপদ নেমে এলো? বরং মাছের পেটের সেই ঘন কালো অন্ধকারে বসে তিনি আল্লাহর একত্ববাদের ঘোষণা দিয়েছেন, আল্লাহর গুণগান গেয়েছেন, নিজেকে জালিম বলে উল্লেখ করেছেন। অত্যন্ত কায়মনোবাক্যে বারবার বলেছেন, ‘আপনি ছাড়া কোনো সত্য উপাস্য নেই, আপনি পবিত্র! নিশ্চয়ই আমি ছিলাম জালিম’ (সূরা আম্বিয়া-৮৭)।
অসুস্থ হয়ে সাত দিন হাসপাতালের বিছানায় পড়ে থাকলেই আল্লাহর কাছে আমাদের অভিযোগ-অনুযোগের শেষ থাকে না, কিন্তু দীর্ঘ সাত বছর মরণব্যাধি শরীরে নিয়েও আইয়ুব আ: আল্লাহর কাছে বলেছিলেন, ‘হে আমার প্রতিপালক! দুঃখ-কষ্ট আমাকে স্পর্শ করেছে, আপনি তো দয়ালুদের মধ্যেও সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু’ (সূরা আম্বিয়া-৮৩)।
এ ক্ষেত্রে আমাদের আরেকটা ব্যাপার খেয়াল রাখা উচিত, যেকোনো বিপদে শুধু তাওয়াক্কুল করেই হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। আল্লাহ চাইলেই নীল নদে অটোমেটিক্যাল রাস্তা বানিয়ে দিতে পারতেন, কিন্তু তারপরও তিনি মূসা আ:কে হাতের লাঠি দিয়ে নীল নদের পানিতে আঘাত করতে বলেছিলেন। আইয়ুব আ:কে পায়ের গোড়ালি দিয়ে মাটিতে আঘাত করতে বলেছিলেন, সেখান থেকে ঝরনা তৈরি হলে সেই পানিতে গোসল করার পর তিনি সুস্থ হয়েছিলেন। আল্লাহ চাইলেই কিন্তু ন্যানো সেকেন্ডের মধ্যে ঝরনার পানিতে গোসল ছাড়াই আইয়ুব আ:কে আরোগ্য দান করতে পারতেন। কিন্তু তিনি আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন, যেকোনো কিছুর জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করার প্রবণতা আমাদের মধ্যে থাকতে হবে। প্রতিকূল পরিস্থিতি থেকে মুক্তির জন্য বৈধ উপকরণ বৈধ পন্থায় ব্যবহার করা যাবে কিন্তু তাওয়াক্কুল করতে হবে আল্লাহর ওপর। লেখক: শিক্ষার্থী, আবেদা-নূর ফাজিল মাদরাসা




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com