জ্ঞানার্জনের পথে চলতে থাকা ও সীমিত সম্পদে তুষ্ট থাকলে পারলে জীবনে প্রশান্তি লাভ করা যায়। ইসলামে এর ওপর অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এই পৃথিবীতে ধনীর ধনে যেমন তৃপ্তি মেটে না, তেমনি ইলম (জ্ঞান) অনুসন্ধানীর ইলম অর্জনেও মন ভরে না। একজন সম্পদশালী যত সম্পদের মালিক হয়, ততই তার সম্পদের চাহিদা বৃদ্ধি পেতে থাকে। যার যত সম্পদ তার তত চাহিদা। ধনীর অভাব কখনো কমে না, বরং বাড়তে থাকে। যেমনটি বিশ্বনবী সা: বলেছেন, ‘যদি আদম সন্তানের সোনার একটি উপত্যকা হয়, তবুও সে চাইবে যে, তার কাছে দু’টি উপত্যকা হোক। (কবরের) মাটিই একমাত্র তার মুখ পূর্ণ করতে পারবে। আর যে তাওবা করে, আল্লাহ তাওবা গ্রহণ করেন’ (মুত্তাফাকুন আলাইহি)। একইভাবে যিনি ইলম তথা জ্ঞানার্জন করতে থাকেন, বৃদ্ধ বয়সেও তিনি জ্ঞানের পেছনে দৌড়াতে থাকেন। জ্ঞানপিপাসা তার মিটে না কখনো। জ্ঞানসমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বলতে থাকেন, ‘আমি কিছুই জানি না, মনে হয় যেন জ্ঞানসমুদ্রের কিনারে দাঁড়িয়ে কিছু বালুকণা কুড়িয়েছি মাত্র।’ জ্ঞানী এবং সম্পদশালীর মধ্যে এই সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। দু’জনের কারোরই ধনে এবং জ্ঞানে তৃপ্তি মেটে না।জ্ঞান হল মানুষের জীবন চলার পথে আলো। আলো ছাড়া যেমন কেউ পথ চলতে পারে না, তেমনি জ্ঞান ছাড়াও প্রকৃত মানুষ হিসেবে জীবনযাপন করা যায় না। কুরআনে অপর স্থানে জ্ঞান ও অজ্ঞতা সম্পর্কে এভাবেই পার্থক্য নির্ণয় করা হয়েছে ‘হে নবী বলুন, অন্ধ ও চক্ষুষ্মান লোক কি এক হতে পারে? আলো ও অন্ধকার কি এক ও অভিন্ন হতে পারে’ (সূরা রাদ : ১৬)। জ্ঞানী লোকদের আল্লøাহ তায়ালা উচ্চ মর্যাদা দান করবেন। যেমন এরশাদ হচ্ছে, ‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমানদার এবং যাদের জ্ঞান দান করা হয়েছে আল্লাহ তাদের সুউচ্চ মর্যাদা দান করবেন’ (সূরা মুজাদালাহ : ১১)।
অর্থ যেমন মানুষের সব সুখ-শান্তি মর্যাদা, প্রতিপত্তি সব কিছুর মূলে কাজ করে তেমনি হানাহানি, প্রতিহিংসা, অশান্তি তথা সমস্ত অপকর্মের মূলেও থাকে অর্থ। অর্থের লোভেই মানুষ নীতি বিবর্জিত হয়ে খারাপ কাজে লিপ্ত হয়। অর্থের কারণেই আপনজনের ভালোবাসাহীনতা, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কছেদ, বন্ধুতে বন্ধুতে বিচ্ছেদ, জাতি-জাতিতে হানাহানি ও যুদ্ধ-বিগ্রহের সৃষ্টি হয়। জগতের যাবতীয় অনাসৃষ্টি, অঘটন, বিশৃঙ্খলা সব কিছুর মূলে রয়েছে অর্থ। অর্থ এমন এক উপাদান যার নেশায় মানুষ নিকৃষ্ট থেকে নিকৃষ্টতম কাজ করতে দ্বিধাবোধ করে না। অর্থ নেশায় চিন্তা-চেতনা, আচার-ব্যবহার, কাজকর্ম সব কিছুই অর্থমুখী হয়ে ওঠে। অর্থের জন্য মানুষ মানুষকে হত্যা করতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। অর্থ এমন এক জিনিস যার মোহে পড়ে মানুষ নীতি, চরিত্র, বিবেক বিসর্জন দেয়। তাই বলা হয়, ‘অর্থই অনর্থের মূল’।
সুষ্ঠু, সুন্দর, সুশৃঙ্খল ও স্বাভাবিক জীবনের জন্য অর্থের প্রয়োজনীয়তা বলে শেষ করা যায় না। আবার অর্থই অনাসৃষ্টি, অশান্তি ও হিংসার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই স্বল্প সম্পদে তুষ্ট ও জ্ঞানার্জনে অধিক মনযোগী হওয়া দরকার। রাসূল সা:-এর পবিত্র মুখ থেকে আরো উচ্চারিত হয়েছে, ‘রাতের কিছু সময় জ্ঞানচর্চা করা পূর্ণ রাত্রি (ইবাদতে) কাটানো অপেক্ষা উত্তম’ (দারেমি)। আরেকটি হাদিসে বর্ণিত হয়েছেÑ ‘যার মৃত্যু এমন সময় এসে পৌঁছেছে যখন সে ইসলামকে সমুন্নত রাখার প্রয়াসে জ্ঞানচর্চায় লিপ্ত বেহেশতে তার ও নবীদের মাঝে মাত্র এক ধাপ পার্থক্য থাকবে’ (দারেমি)। প্রিয় নবী সা: বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা যার কল্যাণ কামনা করেন তাকে দ্বীনের (ইসলামী জীবন ব্যবস্থার) সুষ্ঠু জ্ঞান দান করেন’ (বুখারি, মুসলিম)।
তবে মজার ব্যাপার হলোÑ জ্ঞান অন্বেষণকারী জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে অমৃতসুধা তথা পরম সুখ লাভ করেন। কিন্তু ধনী ব্যক্তি তার ধনসম্পদ বৃদ্ধির সাথে সাথে অসুখী হতে থাকেন। সম্পদ যার যত বেশি দুশ্চিন্তা অসুখ তত বেশি দেখা দেয়। তাই তো, রাজার অসুখ নিরাময়ের জন্য সুখী ব্যক্তির জামা খুঁজতে গিয়ে এমন একজন সুখী মানুষ পাওয়া গেল, যার জামা নেই। প্রবাদে বলা হয়, লোভে পাপ পাপে মৃত্যু। এ আলোচনা থেকে স্পষ্ট বুঝতে পারি যে, জ্ঞানের পথে নিজেকে সঁপে দিতে পারলে এবং স্বল্প সম্পদে তৃপ্ত থাকলে দুনিয়ায় সুখী মানুষ হিসেবে চলা সহজ হয় (ওয়ামা তৌফিক ইল্লা বিল্লাহ) লেখক: প্রভাষক, গাজীপুর রউফিয়া কামিল মাদরাসা, যশোর
ইমেইল: bhmahini@gmail.com