আরবের কন্যা, লালচে চুল আর গোলগাল মুখ, বাবা বলতেই যে মেয়ে পাগল; মেয়েটাকে সাথে নিয়ে, কাঁটাভর্তি গুল্ম মাড়িয়ে বাবা ধরলেন বালুকার পথ, সে বাবার দেবতা হাবল। বাবার ঘাড়ে বসে চার বছরের ছোট্ট মেয়ে হাসে, অকরুণ ভূমিতে সেই হাসির রিনিঝিনিতে শুরু হয় তপ্ত মরু বালুর বিষাদের কথা বলা; হঠাৎ মেয়েটির অবাক লাগে, কেন এই রোদ্দুরে, উত্তপ্ত পথ ধরে, তাকে নিয়ে বাবার ছুটে চলা। প্রখর শুষ্ক হাওয়ার রুক্ষতায় অস্থির চারদিক, হাবল দাস ক্লান্ততার ছাপে দাঁড়াল এক অগভীর গর্তের পাশে; লম্বা পাপড়ির গভীর চোখের অবুঝ বুকে কী জানি কী কালো মেঘের ছায়া, বাবার মুখ চেয়ে তবুও শুভ্র বেলির হাসি সে হাসে। তখন মধ্যাহ্নের সূর্য ছোট্ট দেহটায় উত্তাপ ঢালছে, তবুও সেই অগ্নিমূর্তি বাবার নিষ্ঠুর আর শক্ত প্রতিজ্ঞা; এক অজানা আশঙ্কা আর বাবার প্রতি ভালোবাসায় মেয়েটা এখনো বাবার দিকে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে, মায়াহীন আজ রক্তের বাঁধন, হঠাৎ মেয়ের ছোট্ট পিঠে সজোরে পড়ল ধাক্কা। বাবা আমার ভয় করছেÑ বলে ছোট্ট কণ্ঠের কতশত আকুতি; আজ বাবার কানে মনে পাথর ঠাসা। জাহিলিয়াতের অন্ধকারে মিটে গেছে তার মায়া-মমতা-জ্ঞান। হঠাৎ সব নিশ্চুপ, বাতাসের সাথে উড়ে আসে তীক্ষè বালুকণা; দিন যায়-বছর যায় সে আরব কন্যার দেখা আর মিলে না। মেয়েকে বাঁচিয়ে রাখা মানে গোত্রের অসম্মান আর নিজের ক্ষতি; এমন ধারণা ছিল সে আরব সমাজে। সেই কন্যা পেয়ে গেছে স্বর্গ ঠিকানা; ফুলেল সুবাসে তারা হয়েছে বরণ, সেখানে রক্ত ধোঁকা দেয় না।
আরব সমাজ যখন এতটা অধপতনে হাবুডুবু খাচ্ছে ঠিক সেই সময় জন্মালেন শ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মদ সা:। মক্কার বনি হাশেম গোত্রে আগমন হলো যাঁর; আল্লাহ প্রদত্ত গুণে গুণান্বিত মোহাম্মদ নাম তাঁর। কাবা প্রাঙ্গণে তখন শতাধিক মূর্তির অবস্থান; অন্যায় অবিচারে ধূলিত-মথিত ছিল নারীর সম্মান। পাপাচারে নিমজ্জিত আঁধার দুনিয়াতে, ছড়াতে পুণ্যের রবি; রাব্বুল আলামিন পাঠালেন স্বীয় বার্তাবাহক নবী।
নূরে নূরানিয়াত সেই ওহি বিশ্বাসে, আল্লাহর ফরমানে যে সপে দিয়েছে নিজেকে; আল্লাহর রহমতের ছায়া তার ওপর, জান্নাতুল ফেরদাউসের সুসংবাদপ্রাপ্ত সে। দ্বীনের তরে, রবের মোহাব্বতে সবাই নবীজীর কাছে যেত; রাসূল সা:-এর বক্তব্য শ্রবণে, আলোর সন্ধান পেতো। তিনি ছিলেন আল আমিন খ্যাত বিশ্বস্ত প্রিয়ভাজন; তাঁর মুখ নিঃসৃত বাণী শ্রবণে শীতল হতো উত্তাপ ভূমির শক্ত দেহ মন।
আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহা বলেন, ‘রাসূল সা: ছিলেন ধীরস্থির ও সুস্পষ্ট; প্রত্যেক শ্রোতাই তাঁর কথা বুঝতে পারত (আবু দাউদ- ৪৮৩৯)। আল্লাহ বলেন, ‘পুরুষরা নারীদের তত্ত্বাবধায়ক, মূলত এ কারণে; আল্লাহ একের ওপর অন্যকে মহীয়ান করেছেন শ্রেষ্ঠত্ব দানে (সূরা আন-নিসা-৩৪)। দিবস-জমিনির কোনো এক ক্ষণে, প্রশ্নকারী তিনবার জিজ্ঞেস করল, আমার সদ্ব্যবহার পাওয়ার কে বেশি হকদার, কাকে দেবো বেশি দাম?
নবীজী তিনবার উত্তরে বললেন, ‘তোমার মা’, চতুর্থ বার বলেছেন বাবার তরে, এভাবেই জননীকে সম্মানিত করেছে মানবতার ধর্ম ইসলাম (বুখারি)। বর্ণিত রয়েছে সূরা আন-নিসা, আয়াত নং-৭ ‘পরিত্যক্ত সম্পত্তি পিতা-মাতা ও আত্মীয়; পুরুষের সাথে নারীদের অংশও আছে, অল্প কিংবা বেশি, তা নির্ধারিত।’
বলেছেন আরশের অধিপতিÑ ‘আর যখন জীবন্ত দাফনকৃত কন্যাকে জিজ্ঞেস করা হবে, কোন অপরাধে তাকে দাফন করা হয়েছে (তখন জবাব কী দেবে তোমরা) (সূরা আত-তাকভির-৮-৯)? ওই আয়াতে কেঁপে উঠে ইসলাম পূর্ব জাহেলি সমাজে জীবন্ত দাফনকৃত কন্যার বাবাদের প্রশস্ত বুক; আয়াত শ্রবণে অনুতপ্ত বোধে বিধ্বস্ত তাদের মুখ।
মেয়ে বাবার পরিবারের জন্য সৌভাগ্যের বার্তা নিয়ে জন্মায়। মেয়ের জন্মের সাথে বাবার জান্নাতের দরজা উন্মুক্ত হয়। মেয়েকে সঠিক পালন-পালন করে বাবা পেয়ে যান কাক্সিক্ষত জান্নাত। আর জান্নাতে মেয়ের বাবা এবং রাসূল সা: থাকবেন পাশাপাশি। এমনটাই ঘোষিত হয়েছে রাসূলের মুখে।
ইসলাম নারীকে রব্বাতুল বাইত তথা ঘরের রানী উপাধিতে করেছে ভূষিত; পুণ্যবান নারীই পুরুষের হৃদয় শীতলতা বলে স্বীকৃত। সিরাজুম মুনিরা নারী জাতির উচ্চ করেছেন মান; কুরআন হাদিসের বহু জায়গায় আছে এর প্রমাণ। রাসূল সা:, তিনি পরম নির্ভরতা, নির্ভয়তা ও শাফায়াতের সান্ত¡না; সিরাতের পাতায় পাতায় আছে এ মহান জীবনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বর্ণনা, যা আমাদের অন্তর ও চক্ষুদ্বয়ে বহায় শীতলতার ঝর্ণা।