পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিত্যক্ত পাহাড়ী জমিতে অন্যান্য কৃষি ফসলের পাশাপাশি মসলা চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছে এখানকার কৃষক। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের মসলা চাষ প্রকল্পের আওতায় পাহাড়ের বিভিন্ন এলাকায় গড়ে তোলা হচ্ছে উচ্চ মূল্যের মসলার বাগান।
এ প্রকল্পের আওতায় ইতিমধ্যে তিন পার্বত্য জেলায় পরিত্যক্ত জমি চাষের আওতায় আনার পাশাপাশি মসলা চাষে সুফল পাওয়া যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়নবোর্ডের পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত এলাকায় উচ্চ মূল্যের মসলা চাষ’ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো: শফিকুল ইসলাম।
প্রকল্প পরিচালক মোঃ শফিকুল ইসলাম বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থাকে(বাসস) জানান, পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী জমি মসলা জাতীয় বাগানের জন্য অত্যন্ত উপযোগী হওয়ায় অন্যান্য কৃষি ফসলের পাশাপাশি মসলা জাতীয় ফসল চাষে এখানকার কৃষকদের আগ্রহের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড পাহাড়ের প্রান্তিক কৃষকদের জন্য উচ্চ মূল্যের মসলা চাষ প্রকল্প গ্রহণ করেছে।
তিনি জানান, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত এলাকায় উচ্চ মূল্যের মসলা চাষ’ প্রকল্পটি পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি পাইলট প্রকল্প। প্রকল্পটি ২০১৮ সালের জুন থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত চলমান থাকবে। এ পাইলট প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৪ কোটি ৮৭ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা।
তিনি জানান, তিন পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিত্যক্ত বিভিন্ন পাহাড়ী এলাকায় উন্নত জাতের উচ্চ মূল্যের মসলা যেমন-দারুচিনি, তেজপাতা, আলুবোখারা, গোলমরিচ, জুম মরিচ, ধনিয়া, বিলাতি ধনিয়া ইত্যাদি চাষাবাদ করে স্থানীয় চাহিদা পূরণের পাশাপাশি দেশের মসলা চাহিদার বিরাট একটি অংশ পূরণ করা সম্ভব এবং মসলা জাতীয় ফসলের আবাদের ফলে কৃষকগণ লাভবান হবেন এবং তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন হবে।
অন্যান্য কৃষি ফসলের পাশাপাশি মসলার আবাদে আগ্রহী রাঙ্গাামাটি সদর উপজেলার মগবান ইউনিয়নে মসলা বাগান সৃজনকারী চাষী যুদ্ধমনি চাকমা বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থাকে (বাসস) জানান, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড থেকে আমাকে উচ্চ মূল্যের মসলা চাষ করার জন্য দারুচিনি, গোলমরিচ, তেজপাতার চারা, সার ও সেচ যন্ত্রপাতি দিয়েছে। আমি এখন জুমচাষ বাদ দিয়ে মসলা চাষ শুরু করেছি। আশা করছি এ মসলা চাষে আমি আরো অধিক লাভবান হব। তিনি বলেন, তার সৃজিত বাগান দেখে এলাকার অনেক কৃষকই মসলা জাতীয় ফসলের বাগান করতে আগ্রহী দেখাচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের মসলা চাষ প্রকল্পের রাঙ্গামাটি সদর উপজেলার মাঠ সংগঠক জগদীশ্বর চাকমা বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থাকে(বাসস) জানান, পাহাড়ের কৃষকরা জুম চাষসহ অন্যান্য ফসলের চাষাবাদ করলে ও মসলা চাষ সম্পর্কে তাদের কোন ধারনা ছিলনা। এ প্রকল্পটি শুরু হওয়ার পর কৃষকদেরকে প্রথমে আমরা মসলা চাষ নিয়ে উদ্বুদ্ধ করি এবং জুম চাষের বিকল্প হিসেবে মসলা চাষে এগিয়ে আসার আহবান জানাই। কৃষকরা মসলা চাষে অধিক লাভের বিষয়টি বুঝতে পেরে তারা মসলা চাষে এগিয়ে আসতে শুরু করেছে। তাছাড়া কৃষকদের চারা রোপণ করা, জৈব সার ব্যবহারসহ মসলা চাষের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমরা কৃষকদের মাঠ পর্যায়ে হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দিয়েছি।
পাহাড়ে মসলা জাতীয় ফসলের সম্ভাবনা নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থাকে(বাসস) বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নসহ এখানে বসবাসরত সকল সম্প্রদায়ের মানুষের কল্যাণের কথা বিবেচনা করেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড সৃষ্টি করেছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের কারণে বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি এ অঞ্চলে বসবাসরত কৃষকদের কল্যাণেও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়নবোর্ড সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে কাজ করে যাচ্ছে। পাহাড়ে এখন সম্ভাবনাময় কৃষি হচ্ছে মসলা জাতীয় ফসলের চাষ।
তিনি জানান, পাহাড়ের কৃষকরা যে মসলা চাষে অত্যন্ত আগ্রহী তা আমি পার্বত্য চট্টগ্রামের বাগান পরিদর্শন করে এবং কৃষকদের সাথে কথা বলেই উপলদ্ধি করতে পেরেছি। মসলা চাষে কৃষকদের আগ্রহের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে এ প্রকল্পের আওতায় তিন পার্বত্য জেলায় ২ হাজার ৬শ জন কৃষককে মসলা চাষের সাথে সম্পৃক্ত করা হয়েছে এবং প্রকল্পের সাথে সম্পৃক্ত কৃষকদের বিনামূল্যে আলুবোখরা, দারুচিনি, তেজপাতা, গোলমরিচ ইত্যাদি মসলার চারা-কলমও প্রদান করা হয়েছে।
এর পাশাপাশি কৃষকদের প্রয়োজনীয় কৃষি যন্ত্রপাতি, সার ও রোপণ কৌশল সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে এবং মসলার পাশাপাশি সাথী ফসল হিসেবে পেপেঁ চারা,উন্নত জাতের পেয়ারা, জলপাইসহ বিভিন্ন ফলের চারা সরবরাহ করা হচ্ছে বলে জানান পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়নবোর্ড চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা।
পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা বাসসকে আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের দুূর্গম এলাকায় উচ্চ মূল্যের মসলা চাষ প্রকল্পটি ৪বছর মেয়াদের জন্য নেয়া হলেও পাইলট প্রকল্প হিসেবে তা দীর্ঘ মেয়াদী প্রকল্প হিসেবেই কার্যক্রম চালিয়ে যাবে।
এক সময় পাহাড়ে মসলা বলতে শুধু আদা, হলুদের চাষকে বুঝাত। কিন্তু এখন পাহাড়ের কৃষকরা জুম চাষের পাশাপাশি বিভিন্ন রকমের উচ্চ মূল্যের মসলা চাষের দিকে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন এবং অনেক কৃষক মনে করছেন এ মসলা চাষের মাধ্যমে তারা অধিক লাভবান হবেন এবং এর মাধ্যমে কৃষক অর্থনৈতিকভাবে ও স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ পাবেন।
পরিবশেবিদদের মতে, পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার আবহাওয়া বিবেচনায়, এখানে উদ্যান ও মসলা জাতীয় ফসল আবাদের অনেক সুযোগ রয়েছে। দরিদ্র এবং প্রান্তিক কৃষকদের উদ্যান ও মসলা জাতীয় ফসল আবাদে কৃষকদের সম্পৃক্ত করা গেলে স্থানীয় চাহিদা মিটানোর পাশাপাশি দেশের মসলার চাহিদার একাংশ পূরণ করাসহ কৃষিক্ষেত্রে একটি বিরাট পরিবর্তন আসবে।
উল্লেখ্য, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাহাড়ের দুর্গম এলাকায় কম ওজনের উচ্চ মূল্যের ফসলের চাষ করার নির্দেশনার প্রেক্ষিতে পার্বত্য অঞ্চলের প্রত্যন্ত এলাকায় কৃষকরা যাতে মসলা চাষ করে অধিক লাভবান হতে পারে সে লক্ষ্যকে সামনে রেখে কাজ করছে বলে জানিয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ।