ইসলামী শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে আমাদের ধারণা খুবই অস্পষ্ট। এর কারণ, রাসূলুল্লাহ সা: ছিলেন আল্লাহর প্রেরিত দূত। আল্লাহর বাণী প্রচার করাই তাঁর একমাত্র দায়িত্ব ছিল। জীবনবাজি রেখে, বছরের পর বছর সমাজ থেকে বহিষ্কৃত জীবন কাটিয়ে, নিপীড়ন, নির্যাতন, অত্যাচার সয়ে, ষড়যন্ত্র, প্রাণনাশের হুমকি ও প্রচেষ্টা উপেক্ষা করে, যুদ্ধের পর যুদ্ধ করে, আহত হয়ে, শত শত আপনজন ও অনুসারীর শহীদ হওয়ার শোক বুকে নিয়ে, পাথর নিক্ষেপে রক্তাক্ত হয়ে, জন্মস্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হয়ে তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেন রাসূলুল্লাহ সা:। অবশেষে চূড়ান্ত বিজয়ের পর রাসূলুল্লাহ সা: সব শত্রুকে ক্ষমা করে দিয়ে, বিদায় হজের ভাষণে তাঁর কাজ সমাপ্তির ঘোষণা দেন। মানুষের কাছ থেকে তাঁর দায়িত্ব সম্পন্ন হওয়ার সাক্ষ্য নেন। অতঃপর আরাফাতের মাঠেই কুরআনের শেষ ক’টি আয়াত নাজিল হয়, আল্লাহর তরফ থেকে দ্বীন পরিপূর্ণ হওয়ার ঘোষণা দেয়া হয়। অতঃপর উম্মাহর হাতে পরিপূর্ণ ইসলাম তুলে দিয়ে রাসূলুল্লাহ সা: মদিনায় ফিরে যান। তার কিছুদিন পর তিনি ইন্তেকাল করেন।
রাসূলুল্লাহ সা: ছিলেন আদর্শ শাসক। মানুষকে তিনি সাহায্য করতেন, অভুক্তের মুখে নিজের খাবার তুলে দিয়েছেন। তিনি চাইলেই সব পেতেন, কিন্তু নিজের জন্য কখনো কিছু চাননি। তাঁর প্রতি সবার আনুগত্য ছিল বিনাপ্রশ্নে। তিনি সবার অভিভাবক, সবার ভরসা, সব সমস্যার সমাধান। তাঁর চোখে সবাই সমান, তাঁর দরজা সবার জন্য খোলা। মসজিদই ছিল তাঁর বিচারকার্য পলিচালনার স্থান। তাঁর কোনো প্রহরী ছিল না। তিনি ছিলেন মানুষের হৃদয়ে আসীন। জাগতিক ক্ষমতার জৌলুস তাঁর পায়ের তলায় চাপা পড়েছিল। সমগ্র আরব তাঁর পদানত হলেও তিনি কোনো রাজাসনে বসেননি, কোনো উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠা করেননি। পরিবার সন্তান-সন্ততির জন্য কোনো ধনভাণ্ডার রেখে যাননি।
রাসূলুল্লাহ সা:-এর যে ঐশী শক্তি, তাঁর যে অলিখিত ক্ষমতা, তাঁর প্রতি যে আনুগত্য, সেটার উত্তরাধিকারী কেউ হতে পারে না। তবে তাঁর পরে মুসলিম উম্মাহ এক পতাকাতলে কীভাবে জীবন যাপন করবে তার রূপরেখা তিনি শেষ ভাষণে দিয়েছেন। সেই ভাষণের মূল কথা ছিল, বৈষম্য ও শোষণমুক্ত সমাজপ্রতিষ্ঠা করে আল্লাহ ও রাসূলের পথে মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ থাকা।
সর্বাগ্রে পবিত্র কুরআনে কী বলা হয়েছে তা আমাদের জানা দরকার। রাষ্ট্রীয় জীবন সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের একটি আয়াতেই রাষ্ট্রীয় সংবিধানের সূত্র দেয়া আছে যার তাৎপর্য ব্যাপক। আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! আনুগত্য করো আল্লাহর, আনুগত্য করো রাসূলের এবং তোমাদের মধ্য থেকে যারা কর্তৃত্বপ্রাপ্ত। যদি তোমরা নিজেদের মধ্যে কোনো বিষয়ে মতানৈক্য পোষণ করো, তবে তা নিয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের শরণাপন্ন হও যদি তোমরা আল্লাহ ও শেষ দিনে বিশ্বাসী হও; এটাই সর্বোত্তম এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত’ (সূরা নিসা-৫৯)।
এই আয়াত নাজিলের প্রেক্ষাপট : এই আয়াতের অর্থ উপলব্ধি করতে প্রথমে এর নাজিলের প্রেক্ষাপট জানা প্রয়োজন। এ নিয়ে দুই রকমের প্রেক্ষাপট পাওয়া যায়। প্রথমটি অনুসারে, আয়াতটি আবদুল্লাহ ইবনে হুদাফাহ ইবনে কায়েস ইবনে আদি সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছিল। যাকে আল্লাহর রাসূল একটি সামরিক অভিযানে পাঠিয়েছিলেন। ইবনে মাজাহ, আত-তিরমিজিতে এটাকে হাসান-গরিব উল্লেখ করেছেন। ইমাম আহমাদ লিপিবদ্ধ করেছেন যে, আলী বলেছেন, আল্লাহর রাসূল আল-আনসারের এক ব্যক্তির নেতৃত্বে একটি সৈন্যদল প্রেরণ করেন। পরে ওই সেনাপতি কোনো কারণে সৈন্যদের ওপর রাগান্বিত হন এবং তাদেরকে বলেন, ‘আল্লাহর রাসূল কি তোমাদেরকে আমার আনুগত্য করার নির্দেশ দেননি?’ তারা বলল, ‘হ্যাঁ’। তিনি বললেন, ‘কিছু কাঠ সংগ্রহ করো’ এবং তারপর তিনি কাঠে আগুন লাগিয়ে বললেন, ‘আমি তোমাদের আগুনে প্রবেশ করতে নির্দেশ দিচ্ছি।’ লোকেরা আগুনে প্রবেশ করতে গিয়ে একে অপরের মুখের দিকে তাকাচ্ছিল, তাদের মধ্যে একজন যুবক বলল, ‘তোমরা আগুন থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর রাসূলের কাছে সবে আশ্রয় নিয়েছ। অতএব, যতক্ষণ তোমরা আল্লাহর রাসূলের কাছে ফিরে না যাও ততক্ষণ তাড়াহুড়ো করো না এবং তিনি যদি তোমাদের সেখানে প্রবেশের নির্দেশ দেন, তাহলে সেখানে প্রবেশ করো। তারা যখন রাসূলুল্লাহ সা:-এর কাছে ফিরে যান, তখন তারা যা ঘটেছিল তা রাসূলকে বললে রাসূল সা: বলেন, ‘যদি তোমরা তাতে প্রবেশ করতে তবে কখনোই তা থেকে বের হতে পারতে না।’
এই হাদিসে যে রকম বলা হয়েছে, একজন সুস্থ মস্তিষ্কের সেনাপতি সে রকম আদেশ দিতে পারেন, সেটা ভাবা যায় না। তাই এই হাদিস সন্দেহজনক, যেমন বলেছেন ইবনে মাজাহ।
দ্বিতীয়, শানে নুজুল অনুসারে ইবনে আব্বাস রা: বলেন, আল্লাহর রাসূল সা: খালিদ ইবনে ওয়ালিদকে এক আরব গোত্রের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে পাঠালেন। ওই অভিযানে তার সঙ্গী ছিলেন আম্মার ইবনে ইয়াসির। রাতে তারা ওই গোত্রের কাছাকাছি এসে পৌঁছালে পরদিন সকালে অভিযান পরিচালনা করবেন বলে থামেন। ইতোমধ্যে ওই গোত্র সামরিক অভিযান সম্পর্কে অগ্রিম জানতে পারে এবং একজন মুসলমান ছাড়া বাকিরা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। ওই ব্যক্তি তার পরিবারকে সরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে বলে খালিদের শিবিরে গিয়ে আম্মারকে বললেন, হে আবুল ইয়াকজান! আমি তোমাদের একজন। আমার লোকেরা তোমাদের আসার কথা শুনে পালিয়ে গেছে। আমি মুসলিম বলেই থাকলাম। এতে কি আমার কোনো উপকার হবে, নাকি আমিও আমার স¤প্রদায়ের মতো পালিয়ে যাব? আম্মার বললেন, থাকো, কারণ এটা তোমার জন্য ভালো’। লোকটি তার পরিবারের কাছে ফিরে গিয়ে তাদের থাকতে বলল। পরের দিন সকালে, খালিদ ওই গোত্রের ওপর আক্রমণ করেন, কিন্তু ওই লোকটি ছাড়া আর কাউকে খুঁজে না পেয়ে তাকে বন্দী করেন এবং তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেন। এতে আম্মার খালিদের কাছে গিয়ে বললেন, লোকটিকে যেতে দাও, কারণ সে মুসলিম, আমি তাকে আগেই সাধারণ ক্ষমা দিয়েছি এবং তাকে থাকতে বলেছি। খালিদ বললেন, আমি নেতা থাকতে তুমি আমার কাছ থেকে অন্যদের সুরক্ষা দাও! আম্মার বললেন, ‘হ্যাঁ, আপনি নেতা থাকা অবস্থায় অন্যদের আপনার কাছ থেকে সুরক্ষা দিচ্ছি। এতে তাদের মধ্যে ক্ষুব্ধ কথা কাটাকাটি হয়। অতঃপর তারা নবী সা:-এর কাছে গিয়ে লোকটির কথা জানান। রাসূলুল্লাহ সা: লোকটিকে সাধারণ ক্ষমা মঞ্জুর করেন। সেই সাধারণ ক্ষমা যা আম্মার লোকটিকে দিয়েছিলেন, তারপর আম্মারকে তার নেতার প্রকাশ্য অনুমতি ছাড়া ভবিষ্যতে কাউকে সাধারণ ক্ষমা দিতে নিষেধ করেন। আম্মার ও খালিদ আল্লাহর রাসূলের সামনে একে অপরকে কটূক্তি করেন এবং যখন আম্মার খালিদের সাথে খুব অভদ্রভাবে কথা বলছিলেন, তখন খালিদ খুব রেগে গিয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, আপনি কি এর অনুমতি দেবেন? আমাকে অপমান করে এক দাস? আল্লাহর কসম, আপনি না থাকলে সে আমাকে অপমান করত না। রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, ‘হে খালিদ, আম্মারকে ছেড়ে দাও। কেননা, যে আম্মারকে অপমান করবে আল্লাহ তাকে অপমান করবেন, আর যে আম্মারকে ঘৃণা করবে আল্লাহ তাকে ঘৃণা করবেন। এতে আম্মার প্রস্থান করলে খালিদ তাকে অনুসরণ করেন এবং তার চাদর ধরে তাকে ক্ষমা করতে বলেন, আম্মারও ক্ষমা করে দেন। অতঃপর এই আয়াত নাজিল হয়, যারা কর্তৃত্বে রয়েছে তাদের প্রতি আনুগত্যের নির্দেশ দিয়ে।
আয়াতের তাফসিরের সীমাবদ্ধতা : আয়াতটির অনেক ব্যাখ্যা নানা তাফসিরে দেয়া হয়েছে। আয়াতের চারটি প্রধান অংশের মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় অংশ তথা ‘আনুগত্য আল্লাহ ও আনুগত্য রাসূলের প্রতি’, এ নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। আল্লাহর প্রতি আনুগত্য মানে কুরআনের অনুশাসন মানতে হবে, রাসূলুল্লাহ সা:-এর প্রতি আনুগত্য মানে তিনি যা করতে বলেছেন বা বারণ করেছেন তা মানতে হবে। কিন্তু আয়াতের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ‘আর (মান্য করো) তোমাদের মধ্য থেকে যিনি কর্তৃত্বপ্রাপ্ত। তোমরা নিজেদের মধ্যে কোনো বিষয়ে মতানৈক্য পোষণ করলে তা নিয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের শরণাপন্ন হও’-এর অর্থানুসারে ‘ঊলিল আমর’ বা কর্তৃত্বপ্রাপ্ত কে, তোমাদের মধ্য থেকে বলতে কী বোঝায়, কাদের সাথে কাদের কী কী বিরোধ, শাসক ও শাসিতের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে ফায়সালা করবে কে? এসব অপরিহার্য বিষয়ে তাফসির অস্পষ্ট। এটি অস্বাভাবিক নয় যে, ক্ষমতা দখলকারী ও স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের অধীনে বাস করে শাসকের বৈধতা ও তার সাথে শাসিতের বিরোধ নিষ্পত্তি সম্পর্কিত এই আয়াতের মর্মবাণী নিয়ে তাফসিরকারকদের স্বাধীন মত প্রকাশ করার সুযোগ বা সাহস হয়নি।
তাফসির : আনুগত্য প্রসঙ্গে আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ও রাসূলুল্লাহ সা:-এর পর ‘উলিল আমর’- দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের প্রতি আনুগত্য প্রসঙ্গ স্থান পেয়েছে। এই শব্দের সাথে ‘আতিউ’ (বা আনুগত্য করো) শব্দ ব্যবহৃত হয়নি। এ থেকে ব্যাখ্যা দাঁড়ায় যে, আল্লাহ তায়ালা এবং রাসূলুল্লাহ সা:-এর প্রতি আনুগত্য আর ‘উলিল আমর’ যেই হোক না কেন, তাদের প্রতি আনুগত্য এক জিনিস নয়। আল্লাহ তায়ালা এবং রাসূলুল্লাহ সা:-এর প্রতি আনুগত্য নিঃশর্ত, ‘উলিল আমর’-এর প্রতি আনুগত্য শর্তসাপেক্ষ। আবু দাউদ রা: বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা: থেকে বর্ণিতÑ রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘মুসলিমকে তার পছন্দ হোক বা অপছন্দ হোক, কর্তৃপক্ষের হুকুম শুনতে ও মানতে হবে, যদি না তাকে পাপের আদেশ দেয়া হয়। যখন তাকে পাপের আদেশ দেয়া হয়, তখন তাতে কোনো শ্রবণ বা আনুগত্য হয় না।’ আনাস রা: থেকে বর্ণিতÑ রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘শুনুন এবং আনুগত্য প্রদর্শন করুন, এমনকি যদি একজন ইথিওপিয়ান ক্রীতদাস যার মাথা কিশমিশের মতো, তাকে আপনার প্রধান করা হয়। বুখারি এই হাদিসটি লিপিবদ্ধ করেছেন। সহিহ হাদিস মতে, আল্লাহর অবাধ্যতায় কারো আনুগত্য নেই। ‘আনুগত্য কেবল ধার্মিকতায়’। এই হাদিসটি দু’টি সহিহ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ রয়েছে। অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘আনুগত্য শাসকদের বা তাদের আদেশের জন্য নয় (বুখারি, মুসলিম)। ‘পাপপূর্ণ কাজে আনুগত্য করা হারাম। আনুগত্য কেবল সঠিক ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক’ (বুখারি, মুসলিম)।
তাফসির : ‘উলিল আমর মিনকুম’ প্রসঙ্গে
‘উলিল আমর’ কে? শানে নুজুলে বর্ণিত দু’টি ঘটনাতে ‘উলিল আমর’ একজন সেনানায়ক। রাসূলুল্লাহ সা: তাকে সেনাপতি নিয়োগ দিয়েছেন। তিনি নিজে নিজে সেনাপতি হননি। আয়াতের ‘উলিল আমর’ সব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সুতরাং, ‘উলিল আমর’ বলতে সেই শাসক, সেই সেনানায়ক, সেই অফিসপ্রধান, সেই কর্মাধ্যক্ষ, সেই শ্রমিক সর্দার বা দলনেতাকে বোঝাবে যিনি বৈধভাবে নিয়োজিত। দেশের শাসক নিয়োগ করেন জনগণ, সেই ক্ষমতা বা আইন বলে তিনি বা তার প্রতিনিধি যোগ্যতা মোতাবেক বিভিন্ন পদে ও দায়িত্বে অন্যদের নিয়োগ দেন। বৈধভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত না হলে ‘উলিল আমর’ হওয়া যায় না, তার প্রতি আনুগত্যের প্রশ্ন নেই। আর যোগ্যতা যতই থাক, উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কর্তৃক কোনো পদে নিযুক্ত না হলে নিজে নিজে বা অন্ধকারে ‘উলিল আমর’ হওয়া যায় না।
‘উলিল আমর’-এর পরের শব্দ ‘মিনকুম’ মানে তোমাদের মধ্য থেকে। এটি সমষ্টি থেকে বাছাই বা নির্বাচন জ্ঞাপক, এখানে কোনো পরিবার, গোষ্ঠী বা বংশের প্রশ্ন নেই, যোগ্যতাসাপেক্ষে সবার সমান অধিকার। যেকোনো রাষ্ট্রীয় পদ কারো পারিবারিক বা গোষ্ঠীগত দখলীয় সম্পত্তি নয়। কেউ ক্ষমতা জবরদখল করলে বা নিজে নিজে শাসক সাজলে সেটা ‘মিনকুম’-এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্যের সাথে যায় না। এখানে ‘আলাইকুম’ বা তোমাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত (যেভাবেই প্রতিষ্ঠিত হোক না কেন), ‘মিন আহলে বাইত’ বা রাসূলুল্লাহ সা:-এর পরিবারের মধ্য থেকে, ‘মিনালকুরাইশ’ বা কুরাইশদের মধ্য থেকে বিশেষণ ব্যবহার না করে ‘মিনকুম’ বা ‘তোমাদের মধ্য থেকে’ পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ জন্য রাজতন্ত্র, গোষ্ঠীতন্ত্র বা স্বৈরতন্ত্র ইসলামে সিদ্ধ নয়। এখানে সমষ্টিগত স্বার্থ ও প্রশ্ন জড়িত, তাই এর সমাধানও সমষ্টিগত উপায়ে জড়িত। আর এটি পবিত্র কুরআনের দাবি।
আবার কেউ কোনো পদের জন্য লালায়িত হলে ইসলামের বিধানে তিনিও সেই পদের যোগ্যতা হারান। সাহাবি আবু মুসা রা: থেকে বর্ণিতÑ তিনি বলেন, ‘আমি এবং আমার দুই চাচাতো ভাই নবী করিম সা:-এর ঘরে প্রবেশ করলাম। তাদের একজন বললেন, আল্লাহর রাসূল, আমাদের এমন কিছু দেশের শাসক নিয়োগ করুন যেগুলো সর্বশক্তিমান ও মহিমান্বিত আল্লাহ আপনার তত্ত্বাবধানে অর্পণ করেছেন। অন্যজনও একই রকম কথা বলেন।’ রাসূল সা: বললেন, ‘আমরা এই পদে এমন কাউকে নিযুক্ত করি না যে এটি চায় এবং এমন কাউকে নিযুক্ত করি না যে এর জন্য লালায়িত।’
এভাবে কুরআন ও হাদিসের বর্ণনায় জনজীবনে কে কীভাবে গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হতে পারেন তার বিবরণ আমরা সংক্ষেপে অথচ সুস্পষ্টভাবে পেয়ে যাই। কিন্তু জটিল প্রশ্ন হলোÑ ‘মতানৈক্য পোষণ করলে তা নিয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের শরণাপন্ন হও’-এর ব্যাখ্যা কী? আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের শরণাপন্ন হওয়া নিয়ে কোনো অস্পষ্টতা নেই। প্রশ্ন হলোÑ কার সাথে কার বিরোধ কে নিষ্পত্তি করবে? কুরআন ও হাদিসের আলোকে কঠোর নিরপেক্ষ সিদ্ধান্ত কে দিতে পারবে? শুধু কুরআন ও হাদিসের জ্ঞান থাকলেই কি হবে? বিচারককে জ্ঞানী হতেই হবেÑ এটা প্রথম শর্ত, কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা তাকে ঈমানদার, কঠোর নিরপেক্ষ ও সৎসাহসী হতে হবে। পরীক্ষিতভাবে তিনি নিজে কঠোর সত্যের অনুসারী না হলে তার বিচারকের আসনে বসার নৈতিক অধিকার থাকে না। সাধারণের মধ্যে বিরোধ এক কথা, রাজার সাথে প্রজার বিরোধ একেবারে অন্য কথা। কুরআনের আয়াতে শাসকের সাথে শাসিতের বিরোধকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। অতএব, সেখানে বিচারক একতরফা শাসক কর্তৃক নিযুক্ত হলে তার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাবে। সুতরাং কে, কীভাবে বিচার বা ফায়সালা করবেন তার অগ্রিম রূপরেখা নির্ধারণে বিবদমান পক্ষগুলোর মতামত সমান গুরুত্ব পাওয়া আবশ্যক।
আরবের প্রাচীন বিচারব্যবস্থায় কোনো আদালতের অস্তিত্ব ছিল না। বিচারব্যবস্থা ছিল একান্তভাবেই সালিসনির্ভর। ইসলামেও সেই প্রথা প্রবেশ করে, স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সা: গোত্রীয় সমস্যার সমাধানে সালিসকারক হিসেবে ভূমিকা পালন করেছেন। খোলাফায়ে রাশেদিনের চার খলিফার আমল পর্যন্ত এই মুক্ত বিচারব্যবস্থা বহাল ছিল। ইতিহাস বলে, হজরত আলী রা: এবং গভর্নর মুয়াবিয়ার তীব্র বিরোধ নিরসনেও সালিসের আশ্রয় নেয়া হয়েছিল।
কিন্তু ইতিহাস থেকে আমরা এও জানি যে, উমাইয়ারা ইসলামী পতাকা উড়িয়ে আরবের ক্ষমতা দখল করার পর সালিসি ব্যবস্থা বাতিল করে তদস্থলে কাজীর আদালত প্রতিষ্ঠা করে। কাজীর নিয়োগ ও অপসারণের পূর্ণ কর্তৃত্ব আমিরের হাতে রেখে প্রতিষ্ঠিত এই বিচারব্যবস্থায় কাজীরা হয়ে যান শাসকের প্রতিনিধি। কোনো কোনো কাজী সেনাপতি হয়ে যুদ্ধও করতেন। আবার যেকোনো বিরোধে চূড়ান্ত রায় দেয়ার ক্ষমতা আমির নিজের কাছে সংরক্ষণ করতেন, আর তাকে বৈধতা দেয়ার যুক্তি জড়ো করতে হতো কাজীদের। এভাবে যুগে যুগে রাজানুগত কাজীদের রায়ের সমষ্টিগত সঙ্কলন কালক্রমে শরিয়াহ নামের কথিত ইসলামী আইনি বিধানে পরিণত হয়। তাতে শাসকের সাথে বিরোধ নিষ্পত্তির সুযোগ চিরতরে অপসৃত হয়ে যায়। হজরত উসমান রা: ও হজরত আলী রা:-এর খিলাফতের কাজকর্ম নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়ার, বিতর্ক হওয়ার সুযোগ ছিল, সে সুযোগ উমাইয়া শাসনামলে বাতিল হয়ে যায়। কুরআনের বাণী পড়ে থাকে কুরআনের পাতায়। মানুষের মনে যুগের পর যুগ সঞ্চিত হয় ক্ষোভ ও অভিযোগের পাহাড়।
ইসলামী শাসনব্যবস্থা : আল-কুরআনের আয়াতে শাসক ও শাসিতের মধ্যে সম্পর্ক পরিষ্কার। শাসককে জনগণ কর্তৃক ও উলিল আমরকে অবশ্যই উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত হতে হবে। শাসক সম্পর্কে জনগণের আপত্তি জানানোর ও প্রতিকার পাওয়ার আইনি অধিকার থাকতে হবে। ইসলামী শাসনব্যবস্থায় জনগণের দ্বারা ও জনগণের মধ্য থেকে নিয়োজিত শাসক যতক্ষণ পর্যন্ত ইসলামী বিধানের আলোকে দেশের শাসন পরিচালনা করবেন ততক্ষণ পর্যন্ত তার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করা বাধ্যতামূলক। তবে, যেকোনো বিষয় নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করার অধিকার জনগণের থাকবে এবং জনগণের নিজেদের মধ্যে বা জনগণের সাথে শাসকের বিরোধ দেখা দিলে তার সুরাহার জন্য নিরপেক্ষ ও প্রভাবমুক্ত বিচারব্যবস্থা থাকতে হবে; অবশ্যই কুরআন ও হাদিসের আলোকে সব বিরোধের নিষ্পত্তি করতে হবে। লেখক: অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব।