আজ ১৩ ডিসেম্বর । ১৯৭১ সালের এইদিনে চারদিকে উড়তে থাকে বিজয় নিশান। এদিনে পূর্ব ও উত্তর দিক থেকে মিত্রবাহিনী ঢাকার প্রায় ১৫ মাইলের মধ্যে পৌঁছে যায়। ৫৭ নম্বর ডিভিশনের দু’টো ব্রিগেড এগিয়ে আসে পূর্বদিক থেকে। উত্তর দিক থেকে আসে জেনারেল গন্ধর্ব নাগরার ব্রিগেড এবং টাঙ্গাইলে নামে ছত্রিসেনারা। পশ্চিমে ৪ নম্বর ডিভিশনও মধুমতি পার হয়ে পৌঁছে যায় পদ্মার তীরে। রাত নয়টায় মেজর জেনারেল নাগরা টাঙ্গাইল আসেন।
এদিন লে. কর্নেল সফি উল্লাহ ‘এস’ ফোর্স ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা হয়ে ডেমরা পর্যন্ত চলে আসে। সমুদ্রপথে শত্রুদের পালানোর সুযোগ কমে যাওয়ায় ঢাকায় পাকিস্তানী সৈন্যসংখা বাড়তে থাকে। ঢাকা চূড়ান্ত লড়াইয়ের স্থল বলে চিহ্নিত হতে থাকায় সম্ভাব্য নিয়তির আশঙ্কাও দ্রুত বাড়তে থাকে। সৈয়দপুরে এদিনে আত্মসমর্পণ করে ৪৮ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অধিনায়কসহ ১০৭ পাকিস্তানী সেনা। ৪র্থ বেঙ্গল চট্টগ্রামের দিকে এগুনোর পথে নাজিরহাটে শত্রুসেনারা বাধা দেয়। এখানে ২৪তম ফ্রন্টিয়ার ফোর্স তাদের তিন কোম্পানি এবং বেশকিছু ইপিসিএএফসহ অবস্থান নেয়। সেখানে ব্যাপক যুদ্ধের পর পালিয়ে যায় শত্রু সেনারা। এদিকে বাংলাদেশের নিয়মিত বাহিনীর সর্বপ্রথম ইউনিট হিসেবে ২০-ইবি ঢাকার শীতলক্ষ্যার পূর্বপাড়া মুরাপাড়ায় পৌঁছায়।
এদিন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্স আশঙ্কা করে বলেন, পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে শিগগিরই যুদ্ধ বেধে যেতে পারে। তিনি ঘোষণা করেন যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধ চায় না। তবে যুদ্ধ বাঁধলে সে তাতে জড়িয়ে পড়বে না। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কথা বললেও এই দিনই ২৪ ঘণ্টা থেমে থাকার পর বঙ্গোপসাগরের দিকে যাত্রা শুরু করে মার্কিন সপ্তম নৌবহর। একাত্তরের এই দিনে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের মুলতবি বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব তৃতীয়বারের মতো সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটো দেয়ার ফলে বাতিল হয়ে যায়।
অন্যদিকে, প্রকাশ্য ঘোষণা না দিলেও ১৩ ডিসেম্বর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের পাকিস্তানী অধিনায়ক লে. জেনারেল একে নিয়াজীসহ সেনা কর্মকর্তারা আত্মসমর্পণ করার ব্যাপারে একমত হয়েছিলেন। ভারতীয়দের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছিল পরদিন ১৪ ডিসেম্বর। সৈয়দপুরে এদিনে আত্মসমর্পণ করেন ৪৮ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অধিনায়কসহ ১০৭ পাকিস্তানী সেনা।
কবি আসাদ চৌধুরীর ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’ শীর্ষক গ্রন্থেও এদিনের ঘটনাবলীর একাংশ তুলে ধরা হয়Ñ “মিত্রবাহিনী যতই ঢাকার দিকে এগোচ্ছিল বিমান হামলা যতই বাড়ছিলো নিয়াজীর সাহায্য প্রার্থনা ততই বাড়ছিল। পিন্ডি এতদিন শুধু আশ্বাসই দিয়েছে, বাদামী এবং হলুদ বন্ধুদের আগমন সম্পর্কে তারা প্রায় নিশ্চিতই ছিল। বিশেষ করে ভিয়েতনামের দিকটি শেষ করে মালাক্কা ঘুরে এন্টারপ্রাইজ বহনকারী মার্কিন সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে এসে গেছে এতো সবাই জানে। ছুঁতা একটাই, বাংলাদেশে অবস্থিত মার্কিন নাগরিকদের নিরাপত্তা। ভারত-সোভিয়েত চুক্তি হয়েছে মাত্র কয়েক মাস আগে। সোভিয়েত হুমকি এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য। যাই হোক, পারমাণবিক শক্তি চালিত বিমানবাহিনী এন্টারপ্রাইজ বাংলাদেশে আর নাক গলায়নি।”
বর্ণিত গ্রন্থে আরো উল্লেখ করা হয়, “ঢাকার পাকিস্তানী সেনাবাহিনী জানে পালাবার পথ নেই। বাংলাদেশে সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বীরসিপাহীরা একে অপরের সঙ্গে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। মুক্তিবাহিনীর হাতে পড়লে বা সাধারণের হাতে পড়লে, এদের খতম করার জন্য কোনো অস্ত্রেরই প্রয়োজন হবে না, নিজেদের কুকীর্তি সম্পর্কে অন্তত ওদের ভালো জ্ঞান ছিল। পূর্ব ও উত্তর দিক থেকে মিত্রবাহিনী ঢাকায় প্রায় পনেরো মাইলের ব্যবধানে এসে গেছে। ৫৭ ডিভিশন পূর্ব দিকে আর উত্তর দিক থেকে গন্ধর্ব নাগরার ব্রিগেড আর ছত্রীসেনা। মিত্রবাহিনীর কামানের গোলা কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টে বৃষ্টির মতো ঝরছে। বিমান আক্রমণও খুব জোরে চলছে, উদ্দেশ্য হানাদার বাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে দেয়া। বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় শত শত পাকিস্তানী সেনা আত্মসমর্পণ করে। ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে আত্মসমর্পণ করে ১১৩৪ জন।”
একাত্তরে আজকের দিনে মুক্তিবাহিনীর অব্যাহত অগ্রযাত্রা স্বাধীন পতাকা উড়ানো হয় বগুড়া জেলা শহর ও কাহালু উপজেলা, টাঙ্গাইলের মির্জাপুর, মানিকগঞ্জ শহর ও ধামরাই উপজেলা, সিরাজগঞ্জের তাড়াশ ও নাটোরের লালপুরসহ আরো কয়েকটি জনপদে। শত্রুমুক্ত হওয়ায় ঘটনাগুলো প্রতি মুহূর্তেই মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের মনে উদ্যম ও শক্তি সঞ্চার করে। ( গ্রন্থনা: ইবরাহীম খলিল)