বার বার আবেদনেও মুক্তিযোদ্ধার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাচ্ছেননা ব্রিটেন প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হক। অথচ, তিনি মৌলভীবাজারের ১ম ব্যাচের মুক্তিযোদ্ধা এবং স্বাধীন বাংলাদেশের সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক পাসপোর্টের অধিকারী। জানা গেছে- ২৬ এপ্রিল ১৯৭১ সালে তিনি সৈয়দ মহসীন আলীর সাথে শ্রীমঙ্গলে গিয়ে মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগ দেন। সেখান থেকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আশারাম বাড়ী বিএসএফ ক্যাম্পে এবং পরে মাসিমপুর ক্যান্টনমেন্টের ইকো সেক্টরের শিলচর ক্যাম্পে মাহবুবুর রব সাদি, নুরুল হক (ইন্টেলিজেন্ট কমান্ডার) ও ভারতীয় ক্যাপ্টেন হামিদের অধীনে প্রশিক্ষণ নেন। এরপর মেজর সিআর দত্তের নেতৃত্বাধীন ৪নং সেক্টরে ভারত ব্রিগেডিয়ার ওয়ার্ডের অধীনে কাজ করে কৈলাশহর সাব-সেক্টরে যোগদান করেন। পরবর্তীতে ক্যাপ্টেন হামিদের নির্দেশে তিনি মৌলভীবাজার, ভানুগাছ, শমসেরনগর, শ্রীমঙ্গল ও রাজনগরে গোয়েন্দা হিসেবে দ¦ায়িত্ব পালন করেন। একপর্যায়ে পাক বাহিনী তাকে দেখা মাত্র গুলির নির্দেশ দেয়। তার সহযোদ্ধা রাজনগরের আব্দুল কাইয়ুম তাকে এ সংবাদ জানালে তিনি মুন্সিবাজার থেকে নমৌজা গ্রামের এক স্কুল মাষ্টারের সাথে ভারতে গিয়ে কৈলাশহর থানায়, সেখান থেকে ধর্মনগর এবং ধর্মনগর থেকে মুক্তিযোদ্ধা মুকিত শহীদ হবার সংবাদ দিতে তেলিয়ামুড়া যান। সেখান থেকে ফেরার পথে সহযোদ্ধা খুশির মাইন দুর্ঘটনার খবর পেয়ে ছুটে যান করিমগঞ্জে। মাইন দূর্ঘটনায় মুক্তিযোদ্ধা খুশি দুই হাত ও দুই চোখ হারান। সহযোদ্ধা খুশিকে দেখতে গিয়ে করিমগঞ্জে মেজর সিআর দত্তের সাথে দেখা হলে তারই অনুরোধে তিনি ৩ সপ্তাহ খুশিকে দেখাশুনা করেন। পরে খুশিকে মাছিমপুর হেডকোয়ার্টারে নিয়ে যাওয়া হয়। এসময় তার ব্রিটেন প্রবাসী পিতা আব্দুল খালিক তাকে দ্রুত কলিকাতায় গিয়ে পাসপোর্ট তৈরীর নির্দেশ দেন। পিতার নির্দেশে তিনি কলিকাতায় গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক লে. কর্ণেল ওসমানী ও বঙ্গবন্ধু পুত্র শেখ কামালের সাথে আলাপ করে পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেন। তার পাসপোর্টের আবেদন ফরমে লে. কর্ণেল ওসমানী ও বঙ্গবন্ধু পুত্র শেখ কামাল সনাক্তকারী হিসাবে স্বাক্ষর করেন। এর প্রেক্ষিতে তিনি ষ্টেটলেস পাসপোর্ট (ট্রাভেল পারমিট নং-৫৭৩৯/পি/৭২, ইস্যু তাং-৫ মে ১৯৭২ইং) এবং ব্রিটিশ হাই কমিশন থেকে ভিসা পান। এরই মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অর্জিত হলে তিনি কলিকাতা থেকে যশোর, বরিশাল, খুলনা, চাঁদপুর ও ঢাকা হয়ে মৌলভীবাজারে পৌঁছেন। এদিকে, ৭ জুন কলিকাতা থেকে ব্রিটেন যাবার তারিখ থাকায়, তিনি ৪ সপ্তাহ পর আবার কলিকাতা ফিরে যান। কিন্তু, সেখানে পতিত হন নতুন আরেক বিড়ম্বনায়। ভারত থেকে বিদেশ যাবার আগে থানা থেকে পুলিশের অনুমতিপত্র নিতে গেলে পুলিশ তার ষ্টেটলেস পাসপোর্ট আটক করে। কারণ, ওইসময় তিনি আর ষ্টেটলেস ছিলেননা। ফলে, আবার বাংলাদেশ হাই কমিশন থেকে নতুন পাসপোর্ট নিতে হয়। এর মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হকই সর্বপ্রথম বাংলাদেশী আন্তর্জাতিক পাসপোর্টধারী হবার গৌরব অর্জন করেন। এরপর ব্রিটিশ হাই কমিশন থেকে নতুন ভিসা নিয়ে ৭ আগষ্ট ১৯৭২ সালে তিনি ব্রিটেনে যান। মুক্তিযুদ্ধকালে আব্দুল হক ব্রিটেন থেকে কলিকাতায় আগত বাঙ্গালীদেরকে হোটেলে থাকা ও দেশে যাবার বিমান টিকেট ব্যবস্থা করে দেন। দমদম এয়ারপোর্টে লন্ডন আওয়ামীলীগের প্রেসিডেন্ট গৌছ খান ও চেয়ারপার্সন তালুকদারের সাথে দেখা হলে তিনি তাদেরকে হোটেল বুকিং, কলিকাতা-ঢাকা বিমান টিকেট ও বঙ্গবন্ধুর কাছে টেলিগ্রাম প্রেরণে সহায়তা করেন। ওইসময় বাংলাদেশের কন্ঠশিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায় তাকে ভারতীয় সুরকার গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। সেই সুবাদে গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের অনুরোধে তিনি আরতি ধরকে নিয়ে একটি গানের আসর আয়োজন করেন। পরবর্তীতে গৌরী প্রসন্ন মজুমদার তাকে কলকাতার এইচএমবি ষ্টুডিওতে সরস্বতী পূজার গানের এক অনুষ্ঠানে নিয়ে গিয়েছিলেন- যে অনুষ্ঠানের প্রধান আকর্ষণ ছিলেন কন্ঠশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হকের সহযোদ্ধা ছিলেন জুড়ীর মোঃ খুশি ও ফারুক, মৌলভীবাজার সদরের আব্দুস সোবহান একলিম, খোরশেদ আহমদ, জ্যেতির্ময় কর, কামালপুরের আনছার হোসেন চৌধুরী, সুভাস চন্দ্র দত্ত, সৈয়দ আব্দুল মন্নান, কামালপুর রাধানগরের মোঃ লাল প্রমুখ। তার সহযোদ্ধাদের কেউ কেউ এখনও বেচে আছেন। দীর্ঘদিনেও তাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে গেজেটভূক্ত না করায় ২০০৯ সালে তিনি দেশে এসে সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) বরাবর আবেদন করেন। ২০১৩ সালে তিনি আবার দেশে এসে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করলে তাকে পুণরায় আবেদন করতে বলা হয়। এর প্রেক্ষিতে তিনি মৌলভীবাজার-৩ আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের সদস্য ও পরবর্তীতে সমাজকল্যাণ মন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মহসীন আলীর সহায়তা কামনা করেন এবং তার পরামর্শ ও সহায়তায় তারই সুপারিশ সহকারে জামুকা মহাপরিচালক বরাবর পুণরায় আবেদন (ডকেট নং-১৬০২৯, তাং-১৪/১১/২০১৩ইং) করেন। ১ম বার যাচাই বাছাইয়ে তিনি নির্বাচিত হলেও অজ্ঞাত কারণে ২য় বার তার নাম বাদ দেয়া হয়। মৌলভীবাজারের প্রথম ব্যাচের মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক লে. কর্ণেল এমএজি ওসমানী ও বঙ্গবন্থধু পুত্র শেখ কামাল স্বাক্ষরিত পাসপোর্ট আবেদনের প্রেক্ষিতে স্বাধীন বাংলাদেশের সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক পাসপোর্টধারী এবং ১৬৬নং মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম থাকা সত্তেও ব্রিটেন প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হককে গেজেটভুক্ত করা হয়নি আজও। উপরোক্ত তথ্যাদি জানিয়ে স্বাধীনতার ৫০ বছরেও গেজেটভূক্তি বঞ্চিত মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হক আক্ষেপ করে বলেন- আমি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হওয়া সত্তেও এবং ১৬৬নং মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম থাকা সত্তেও আমাকে মুক্তিযোদ্ধা গেজেটভুক্ত করা হচ্ছেনা। যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করে সেই দেশের কাছেই আমি স্বীকৃতিপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত রয়েছি আজও। এর চেয়ে দুঃখের বিষয় আর কি হতে পারে?