ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণার এক যুগ রোববার (১২ ডিসেম্বর) পূর্ণ হয়েছে। সেই ঘোষণার পর গত ১২ বছরে ডিজিটাল পরিসরে অনেক দূর এগিয়েছে দেশ। কিন্তু বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে আরও অনেক পদক্ষেপ নেওয়ার ওপর জোর দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, টেলিযোগাযোগ সেবায় এখনো ইকোসিস্টেম তৈরি না হওয়ায় এ খাতে বিপুল সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। মানবসম্পদ উন্নয়ন ও ই-গভর্ন্যান্স বাস্তবায়ন এখন বড় চ্যালেঞ্জ। বিপুল সংখ্যক ফ্রিল্যান্সারকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে পদক্ষেপ নেওয়ার উপরও জোর দিয়েছেন তারা।
দেশের প্রযুক্তিখাতের উদ্যোক্তা থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে এমন মতামত পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবীর বলেন, আমাদের নিজস্ব স্যাটেলাইট আছে, সাবমেরিন ক্যাবল এখন মাল্টিপল হয়ে গেছে। এগুলো আমাদের একটি বড় অর্জন। এর ভেতরেও কিছু লিমিটেশন আছে। যদিও আমাদের দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী প্রায় ১১ কোটি। এর মধ্যে মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন ৯৪ শতাংশ লোক। আর মাত্র ৬ শতাংশ ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট যদি আমরা বাড়াতে না পারি তাহলে লাভ হবে না। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট প্রান্তিক পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে হবে।
দক্ষ জনবল বাড়াতে না পারলে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়তে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের দক্ষ জনসম্পদ তৈরিতে মনোযোগী হতে হবে। এই দক্ষতা হতে হবে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ঘিরে যে নতুন নতুন প্রযুক্তি এসেছে, সেগুলোর ওপর। যেমন ব্লকচেইন, রোবটিকস ,আর্টিফিসিয়াল ডিজাইন। এসব নতুন প্রযুক্তির বিষয়ে আমাদের দক্ষতা অর্জন করতে হবে।
সরকারকে দেশে তৈরি সফটওয়্যার ব্যবহারের আহ্বান জানিয়ে সৈয়দ আলমাস কবীর বলেন, সরকারের কাছে আমাদের একটাই দাবি, যে বড় বড় প্রজেক্ট হচ্ছে বা হবে, সেগুলোতে অবশ্যই দেশীয় কোম্পানিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। দেশীয় কোম্পানি যদি কোনো কারণে এটি না করতে পারে তখন বিদেশি কোম্পানিকে অবশ্যই আমরা নিয়ে আসবো। তাদের কাছ থেকে শিখবো। কিন্তু সেখানেও যেন বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা শিখতে পারতে তার একটা ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের বড় বড় প্রজেক্টগুলো যেমন- এয়ারপোর্ট টার্মিনালের কাজ হচ্ছে, মেট্রোরেল হচ্ছে, নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট হচ্ছে, কর্ণফুলী টানেল হচ্ছে, পায়রা সমুদ্রবন্দর হচ্ছে। এই বড় বড় প্রজেক্টগুলোতে অনেক আইটি কিংবা আইটি রিলেটেড কম্পোনেন্টস দরকার হবে। এখানে সফটওয়্যার দরকার হবে। হার্ডওয়্যারের দরকার হবে। এক্ষেত্রে যেন লোকাল কোম্পানি কাজগুলো পায় সেদিকে আমি নজর দিতে বলছি।
তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাতসহ অনেক জায়গায় বিদেশি সফটওয়্যার প্রয়োজন না থাকলেও পাঁচ কিংবা দশ গুণ দাম দিয়ে এগুলো কেনা হয় এবং সেগুলোর মেইনটেন্যান্স তিন থেকে চার গুণ বেশি লাগে। এটা করার কোনো প্রয়োজন নেই বলে আমার মনে হয়।
দেশে উৎপাদিত সফটওয়্যার ওই পর্যায়ে যাওয়ার সক্ষমতা অর্জন করেছে কি না, এ প্রশ্নের জবাবে বেসিস সভাপতি বলেন, অবশ্যই। আমাদের দেশে ৬০টি ব্যাংক আছে। এর মধ্যে ৩০টি ব্যাংকে দেশীয় সফটওয়্যার ব্যবহার কোর ব্যাংকিং করে। তাহলে বাকি ৩০টি করতে পারে না কেন? আসলে আমরাই তাদের ভরসাটা দিতে পারিনি। কিন্তু সরকার যদি এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়, তাদের উৎসাহিত করে, তাদের একটা ট্যাক্স সুবিধা দিলে দেশীয় সফটওয়্যার ব্যবহার বাড়বে। দেশীয় সফটওয়্যার ব্যবহার করলে এক পার্সেন্ট ট্যাক্স কম দিতে হবে, সরকার যদি এ ধরনের একটি ইনসেন্টিভ ঘোষণা করে তাহলে অনেকেই উৎসাহিত হবে দেশীয় প্রোডাক্ট ব্যবহার করার জন্য।
রাজশাহীর ‘ফ্লিট বাংলাদেশ’র কর্ণধার মো. খায়রুল আলম ২০০৮ সালে ‘ফ্রিল্যান্সার ডটকম’ থেকে একটা কাজ করেছিলেন ২০০ ডলারের। কাজ করে পাঠিয়ে দেওয়ার পর ক্লায়েন্ট তার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। প্রথমে এ ধরনের ধাক্কা খেয়েও দমে যাননি তিনি। ফ্রিল্যান্সিং চালিয়ে গিয়ে সাড়ে তিন বছর আগে ‘ফ্লিট বাংলাদেশ’ নামে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন তিনি। খায়রুলের প্রতিষ্ঠান এখন শত শত তরুণের কাজ যোগাচ্ছে। ওয়ালমার্ট এবং অ্যামাজনের মতো প্রতিষ্ঠানের স্টোর ম্যানেজমেন্টের কাজ করছেন রাজশাহীতে বসে।
মো. খায়রুল আলম বলেন, এখন বলা হচ্ছে আমাদের দেশে সাড়ে ছয় লাখ ফ্রিল্যান্সার রয়েছেন। এসব ফ্রিল্যান্সারকে উদ্যোক্তা হিসেবে পরিণত করতে হবে। এটা না করলে কর্মসংস্থান বাড়বে না। বৈদেশিক অর্জন বাড়বে না। তাদের উদ্যোক্তা পর্যায়ে নিয়ে যেতে না পারলে খুব একটা ভালো ফল আশা করা যাবে না। কারণ একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ মাসে তিন চার লাখ টাকা অর্জন করতে পারবেন। এর চাইতে বেশি আয় করা সম্ভব নয়। যেমন আমার অফিসে এখন সাড়ে ৫০০ কর্মীকে দিয়ে কাজ করাচ্ছি। এরা প্রত্যেকে এক লাখ টাকা করে আয় করেন। তাহলে এখানে বৈদেশিক অর্জন হবে প্রায় প্রায় পাঁচ কোটি টাকা। তাই ফ্রিল্যান্সাদের উদ্যোক্তা হিসেবে তৈরি করতে হবে। আমিও প্রত্যন্ত এলাকা যেমন রাজশাহীর পুঠিয়ায় একটি টিম করেছি। সেখানে ৫০ জনের জন্য জাস্ট অফিস করে দিয়েছি। তারা নিজেরাই উদ্যোক্তা হয়ে কাজ করবে। তবে অনেকেই উদ্যোক্তা হতে ভয় পায়। এই ভয় দূর করতে হবে। এই ভয় দূর করার জন্য প্রণোদনা দেওয়া যেতে পারে।
২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ইশতেহারে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বাস্তবায়নের পরিকল্পনা উল্লেখ করেন। ঘোষিত ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’র মূলমন্ত্র চারটি। মানবসম্পদ উন্নয়ন, ইন্টারনেট সংযোগ প্রদান, ই গভর্ন্যান্স ও তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পখাত গড়ে তোলা। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১১ সালে টুজি, ২০১৩ সালে থ্রিজি, ২০১৮ সালে ফোরজি এবং ২০২১ সালে এসে রাষ্ট্রীয় টেলিযোগাযোগ সেবা দানকারী প্রতিষ্ঠান টেলিটকের মাধ্যমে ফাইভ-জি যুগে পদার্পণ করেছে বাংলাদেশ। দেশে আজ সক্রিয় মোবাইল সিম ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ১৮ কোটি, মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারী প্রায় ১১ কোটি, ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবহারকারী এক কোটি ৭০ হাজার। ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের শুরুতে যেখানে ব্যান্ডউইথ ব্যবহার হতো মাত্র আটশ’ জিবিপিএস, ডিজিটাল বাংলাদেশের এক যুগে এসে সেখানে ব্যান্ডউইথ ব্যবহার হচ্ছে প্রায় তিন হাজার জিবিপিএস।
বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, বর্তমানে দেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় আট কোটি। মোবাইল ব্যাংকিং খাতে গ্রাহকের সংখ্যা প্রায় আট কোটি ২০ লাখ। এখাতে দৈনিক লেনদেন হচ্ছে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। ই-কমার্স ও এফ-কমার্সের দৈনিক লেনদেন মিলিয়ে প্রায় হাজার কোটি ছাড়িয়ে গেছে। দেশে মোবাইল হ্যান্ডসেট উৎপাদনের কারখানা প্রায় ১৩টি। হ্যান্ডসেট ও এক্সেসরিজের বাজার প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার। এত সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ পুরোপুরি বাস্তবায়নে এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। টেলিযোগাযোগ সেবাখাতে এখনো ইকোসিস্টেম তৈরি না হাওয়ায় এ খাতে বিপুল সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। মানবসম্পদ উন্নয়ন ও ই-গভর্ন্যান্স বাস্তবায়ন এখন বড় চ্যালেঞ্জ। আমরা আশা রাখবো আগামী দুই-এক বছরের মধ্যেই বাংলাদেশ প্রযুক্তির শতভাগ ব্যবহারকারী রাষ্ট্র হবে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের অংশীদার হয়ে বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থেই বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় পরিণত হবে।
রাজশাহী শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে হুজুরীপাড়া ইউনিয়ন পরিষদ। সেই পরিষদের ডিজিটাল সেন্টারের উপকারিতা তুলে ধরে চেয়ারম্যান মো. গোলাম মোস্তফা বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা প্রতিটি ইউনিয়নে ব্রডব্যান্ড স্থাপন করেছেন, যেন আমরা সহজে ও নিরবচ্ছিন্ন কাজ করতে পারি। কিন্তু আমরা সার্বক্ষণিকভাবে কাজ করতে পারছি না বিদ্যুতের সমস্যার কারণে। ইন্টারনেটের সাপ্লাই ন্যূনতম পর্যায়ে। পিডিবি যত দিন ছিল ততদিন ভালোমত বিদ্যুৎ পেতাম। বর্তমানে নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি-নেসকো নেওয়ার পর আমাদের প্রচুর পরিমাণ ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। এতে লোকজনের হয়রানি হচ্ছে। কাজ করতে পারছে না ঠিকমত। নেটওয়ার্ক ও বিদ্যুতের সমস্যার বিষয়গুলো যদি আমাদের জননেত্রী শেখ হাসিনা পরিপূর্ণ করে দেন, তাহলে ভালো হয়।