যেই ভিসি গ্রেনেড ছুড়ে, সেই ভিসির পদত্যাগ চাই; যেই ভিসি ছাত্র মারে, সেই ভিসি চাই না; যেই ভিসি গুলি ছুড়ে, সেই ভিসির পদত্যাগ চাই; শিক্ষার্থীর ওপর হামলা কেন, প্রশাসন জবাব চাই; সাস্টিয়ান সাস্টিয়ান এক হও এক হও, ক্যাম্পাস কারও বাপের না, হল আমরা ছাড়ব না’। এমনসব শ্লোগানের উত্তাল তরঙ্গমালা শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে।
পুলিশের বেধড়ক লাঠিপেটা, রাবার বুলেট, শর্টগানের গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপের ঘটনায় শিক্ষকসহ শতাধিক ছাত্রছাত্রী আহত হওয়ার ঘটনায় এখন নানা দাবীর সাথে যোগ হয়েছে ভিসি পদত্যাগ এবং ক্যাম্পাস ও আবাসিক হল বন্ধের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার নতুন দুই দফা। এমনসব দাবিতে কালও শাবি ছিলো থমথমে। শিক্ষার্থীরা ঘেরাও করে ভিসি কার্যালয়। তালা ঝুলিয়ে দেয় ভিসি কার্যালয়, প্রশাসনিক ভবন ও প্রত্যেকটি একাডেমিক ভবনে। এর রেশ ছড়িয়ে পড়েছে সিলেটসহ দেশজুড়ে। বিভিন্ন স্থানে হয়েছে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ। আর দাবি আদায় না হওয়া ক্যাম্পাস না ছাড়তে অনড় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। অন্যদিকে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে সাজোয়া যানসহ ক্যাম্পাসে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।
এদিকে, ছাত্র আন্দোলনে সিলেটবাসীর প্রাণের প্রতিষ্ঠান শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের হামলার প্রতিবাদে উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছেন শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, শিক্ষার্থীদের নিয়ে উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের কোনো চিন্তা নেই। এ কারণেই তিনি ক্যাম্পাসে পুলিশ ডেকে এনেছেন এবং সেই পুলিশ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়েছে। তাঁরা শিক্ষার্থীবান্ধব নতুন উপাচার্য চান। একাধিক শিক্ষার্থী বলেন, আমাদের এক দফা এক দাবি- যেই ভিসি আমাদের ওপর হামলা চালাতে পারে, সেই উপাচার্যকে আমরা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখতে চাই না। যতক্ষণ পর্যন্ত উপাচার্য পদত্যাগ না করবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যাব। আমাদের শিক্ষার্থীর ওপর হামলার প্রতিবাদে আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাবে। তারা বলেন, হল ছেড়ে দেওয়ার যে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, আমরা তা প্রত্যাখ্যান করছি। আমরা আমাদের দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত হল ত্যাগ করব না। দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাব।
এর আগে সোমবার সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের সামনে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ করতে দেখা গেছে। এ সময় তাঁরা হল ছাড়বেন না বলে ঘোষণা দেন। পাশাপাশি ক্যাম্পাসে পুলিশি হামলার ঘটনায় উপাচার্যের পদত্যাগ দাবি করেন। সকাল সোয়া নয়টার দিকে ওই শিক্ষার্থীরা হলের সামনে থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করে ক্যাম্পাসের ভেতরের বিভিন্ন রাস্তায় স্লোগান দিতে থাকে। ধীরে ধীরে ওই মিছিলের সঙ্গে সাধারণ শিক্ষার্থীরাও জড়ো হন। এতে শিক্ষার্থীর স্রোতে রূপ নেয় শাবি ক্যাম্পাস। কয়েকশ’ শিক্ষার্থী গোলচত্বরে অবস্থান নিয়ে উপাচার্যের পদত্যাগ চেয়ে স্লোগান দেয়। এক পর্যায়ে তারা ঘেরাও করে ভিসি ভবন। ভিসি তখন ভেতরেই ছিলেন।
বেলা দুইটা থেকে শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে গণস্বাক্ষর কর্মসূচি শুরু করে। এখানে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদদে নিরীহ শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের হামলার প্রতিবাদে তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গণস্বাক্ষর নেওয়া শুরু করেছেন। বেলা সোয়া দুইটার দিকে শিক্ষার্থীরা রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দেন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ তাঁর বাসভবনে ২ জন গণমাধ্যমকর্মীর সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি তখন সব শিক্ষার্থীর সিদ্ধান্ত মেনে হল ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করেন। অল্প সময়ের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়ার আশ্বাস দেন তিনি। উপাচার্যের অভিযোগ, অনেক বহিরাগত কর্মসূচিতে যোগ দিয়ে শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করছেন। আজকের কর্মসূচিতেও অনেক বহিরাগত এসেছেন। একটি চিহ্নিত স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল করতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এসব করছে। শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আমরা তোমাদের পাশে আছি। তোমরা সহযোগিতা করো। কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত তোমরা নিয়ো না।’ ভিসি ভবন ঘেরাও :গত সোমবার বিকাল সোয়া ৪টার উপাচার্যের বাসভবন ঘেরাও করতে যান বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। এসময় গেটের সামনে তাদের বাঁধা দেয় পুলিশ। এসময় শিক্ষার্থীরা পুলিশ সদস্যদের ফুল দিতে দেখা যায়। আন্দোলনরতরা জানান, পুলিশ কোনো ধরনের লাঠিচার্জ- এমনকি গুলি করলেও করতে পারে, তাদের পক্ষ থেকে আন্দোলন শান্তিপূর্ণ হবে। এরই স্মারক হিসেবে তারা পুলিশকে ফুল দিচ্ছেন। উপাচার্যের বাসভবনের সামনে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকে শত শত ছাত্র-ছাত্রী অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন স্লোগান দিয়ে যাচ্ছে এবং অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের দাবি জানাচ্ছে। হল ছাড়তে ‘না’ শিক্ষার্থীদের : এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের ঘোষণা দেওয়ার পরপরই রোববার রাত ৯টার দিকে বিক্ষোভ জানিয়ে ক্যাম্পাসে মিছিল করেন তিনটি ছাত্র হলের অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী। পরে রাত ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চের সামনে অন্তত ৪০০ থেকে ৫০০ শিক্ষার্থী উপাচার্যের পদত্যাগ চেয়ে বিক্ষোভ করেন। বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নির্দেশেই পুলিশ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়েছে। এ ঘটনার দায় নিয়ে উপাচার্যকে পদত্যাগ করতে হবে। সেদিন রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের এ বিক্ষোভ চলে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আলমগীর কবির গণমাধ্যমে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি শান্ত। শিক্ষার্থীরা ধীরে ধীরে হল ছাড়ছেন।’ শাবির উপাচার্য কার্যালয় ও প্রশাসনিক ভবনে তালা : ভিসি কার্যালয়, প্রশাসনিক ভবন ও প্রত্যেকটি একাডেমিক ভবনে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের গোল চত্বর থেকে মিছিল নিয়ে এসে সোমবার বেলা আড়াইটার দিকে ভিসির কার্যালয়সহ বিভিন্ন ভবনে তালা ঝুলিয়ে দেন তারা। শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘যেহেতু আমাদের ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ ঘোষণা করেছে, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো প্রশাসনিক কার্যক্রমও চলতে পারবে না। শিক্ষার্থীদের বের করে দিয়ে কোনো কার্যক্রম চলতে পারে না। তাই ভিসি ভবনসহ সব ভবনে আমরা তালা ঝুলিয়ে দিয়েছি। কেবল ভর্তি কার্যক্রম চলমান থাকায় রেজিস্ট্রার ভবনে তালা দেয়া হয়নি।’ শিক্ষার্থীরা জানায়, সোমবার সকাল থেকে ভিসিসহ প্রক্টরিয়াল বডির পদত্যাগের দাবিতে শিক্ষার্থীদের যে আন্দোলন চলছে সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা আরও বেগবান হয়েছে। দলে দলে এসে আন্দোলনে একাত্মতা জানাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। তাদের ভাষ্য, বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। এখানে পুলিশ থাকবে কেন। তাদের এই ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যেতে হবে। রাতেও ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরা : সোমবার সন্ধ্যায় তারা ঘোষণা দেয়- উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের আগ পর্যন্ত তারা কিছুতেই আন্দোলন থামাবে না বা ক্যাম্পাস ছাড়বে না। সোমবার সারা রাত তারা ক্যাম্পাসে থাকবে এবং রাত কাটাবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করে। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ ঘোষণা করেছে। তাই যতক্ষণ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় চালু না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো প্রশাসনিক কার্যক্রমও চলতে দেওয়া হবে না। উপাচার্য ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নির্দেশে পুলিশ শিক্ষার্থীদের কর্মসূচিতে হামলা চালিয়ে অনেককে রক্তাক্ত করেছে। যে উপাচার্যের নির্দেশে ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের রক্ত ঝরেছে, তাঁকে শিক্ষার্থীরা একমুহূর্তও আর ক্যাম্পাসে দেখতে চান না।
এদিকে, পরিস্থিতি সামাল দিতে আবার শাবি ক্যাম্পাসে পুলিশের বিশেষ বাহিনী ‘ক্রাইসিস রেন্সপন্স টিম’-কে মোতায়েন করা হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (উত্তর) আজবাহার আলী শেখ পিপিএম। বহিরাগতদের ইন্ধনে আন্দোলন, দাবি শাবি ভিসির : বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণার পরও যারা আন্দোলনের নামে ক্যাম্পাসে অবস্থান করছে তাদের অনেকেই বহিরাগত বলে মন্তব্য করেছেন উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ।
তিনি বলেন, ‘বহিরাগতদের ইন্ধনে এখন আন্দোলন চলছে। রোববার রাত থেকেই ক্যাম্পাসে বহিরাগতরা প্রবেশ করেছে বলে আমার কাছে তথ্য আছে।’ তবে উপাচার্যের এমন দাবি নাকচ করেছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। তারা বলছেন, ঘটনা ধামাচাপা দিতে মিথ্যাচার করছেন উপাচার্য। ক্যাম্পাসে পুলিশ ছাড়া বহিরাগত কেউ নেই। গত সোমবার দুপুর ১টার দিকে নিজ বাসভবনে উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক বহিরাগত ঢুকে পড়েছে। তারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করছে। তাদের ইন্ধনে শান্তিপূর্ণ ক্যাম্পাসে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। ‘আমাদের শিক্ষার্থীরা অনেক ভালো। তারা প্রশাসনের প্রতি আস্থাশীল। আজকের আন্দোলনের সঙ্গে সাধারণ শিক্ষার্থীদের তেমন সম্পৃক্ততা নেই।’ কারও ইন্ধনে শিক্ষার্থীরা যাতে আর বিভ্রান্ত না হয় সেদিকে সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়ে উপাচার্য বলেন, ‘রোববারের যে ঘটনা ঘটেছে তা তদন্তে কমিটি করা হয়েছে। তাদের দাবি মেনে হল প্রভোস্টও পদত্যাগ করেছেন। শিক্ষার্থীদের আরও যে দাবি রয়েছে সেগুলো আমি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছি।’ তদন্ত কমিটি : রোববার শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনায় ৮ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ফিজিক্যাল সায়েন্সেস অনুষদের ডিন অধ্যাপক রাশেদ তালুকদারকে কমিটির প্রধান করা হয়েছে। সদস্যসচিব হিসেবে রাখা হয়েছে রেজিস্ট্রার মুহাম্মদ ইশফাকুল হোসেনকে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি তুলসী কুমার দাস, অ্যাপ্লায়েড সায়েন্সেস অ্যান্ড টেকনোলজি অনুষদের ডিন আরিফুল ইসলাম, অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড মিনারেল সায়েন্সেস অনুষদের ডিন রুমেল আহমদ, লাইফ সায়েন্সেস অনুষদের ডিন মো. কামরুল ইসলাম, ব্যবস্থাপনা ও ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের ডিন মো. খায়রুল ইসলাম এবং সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন দিলারা রহমান।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রাধ্যক্ষ ও সহকারী প্রাধ্যক্ষদের পদত্যাগ, হলের যাবতীয় অব্যবস্থাপনা দূর করে সুস্থ-স্বাভাবিক পরিবেশ নিশ্চিত এবং ছাত্রীবান্ধব ও দায়িত্বশীল প্রাধ্যক্ষ কমিটি নিয়োগের দাবিতে গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে আন্দোলন শুরু করেন হলের কয়েকশ’ ছাত্রী। গত শনিবার সন্ধ্যায় ছাত্রীদের কর্মসূচিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা হামলা চালায় । এরপর পরিস্থিতি হয়ে ওঠে পুরোপুরি ঘোলাটে। আন্দোলন পায় নতুন মাত্রা। পরদিন রোববার উপাচার্যকে অবরুদ্ধ করেন শিক্ষার্থীরা। তাকে উদ্ধারে অ্যাকশনে যায় পুলিশ। পুলিশ শটগানের গুলি, রাবার বুলেট, ভয়ঙ্কর সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ার পাশাপাশি ব্যাপক লাঠিপেটা করে শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করে উপাচার্যকে মুক্ত করে। এতে শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়। শিক্ষক, কর্মচারী, পুলিশ সদস্যও আহত হন।
এ অবস্থায় সন্ধ্যায় পুলিশের সহায়তায় মুক্ত হয়ে শাবি উপাচার্য বসেন জরুরি সিন্ডিকেট সভায়। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়- বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। সোমবার দুপুর ১২টার মধ্যে হল ত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয় শিক্ষার্থীদের। কিন্তু শিক্ষার্থীরা কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা প্রত্যাখ্যান কওে কালও ব্যাপক বিক্ষোভ করে।জালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলনরত দুই থেকে তিনশ’ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মামলা করেছে পুলিশ। সিলেট মহানগর পুলিশের (এসএমপি) জালালাবাদ থানার এসআই (নিরস্ত্র) মোহাম্মদ আব্দুল হান্নান বাদী হয়ে এই মামলা করেছেন।
গত সোমবার দায়েরকৃত মামলার নম্বর ৫। মামলায় কোনো শিক্ষার্থীর নামোল্লেখ করেনি পুলিশ। তবে তারা দাবি করেছে, গত রোববারের ঘটনায় শিক্ষার্থীরা শুধু ইটপাটকেলই নয়, আগ্নেয়াস্ত্র থেকে গুলিও ছুঁড়েছিল। মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রভোস্ট জাফরিন আহমেদ লিজার পদত্যাগের দাবিতে গত রোববার ১৬ জানুয়ারি ২টা ৫৫ মিনিটের দিকে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করেন। খবর পেয়ে জালালাবাদ থানার এসআই (নিরস্ত্র) মোহাম্মদ আব্দুল হান্নান,এএসআই ফারুক আহমদ, কনস্টেবল মিজানুর রহমান, কনস্টেবল নার্গিস আক্তার, এসআই নিহারেন্দু তালুকদার, কনস্টেবল তাপস বিশ্বাস, জোনাকি তালুকদার, পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মো. আবু খালেদ মামুন, এসআই মো. আসাদুজ্জামান, এসআই মো. মাহাবুর আলম মন্ডল, এসআই কাজী জামাল উদ্দিন, রফিকুল ইসলাম, মো. লোকমান হোসেন, লিটন চন্দ্র নাথ, এএসআই মো. কামাল হোসেন, মো. মোস্তাফিজুর রহমান, খোরশেদ আলম, কনস্টেবল ইয়ারুপ মিয়া, কাওছার হাবিব, রকিবুল হাসান, শুকুর আলী, সঞ্জিত দাস, আলমগীর হোসেন, মেহেদি হাসান, মাজহারুল ইসলাম, সুহেল মিয়া, শিবা রাণী দাস, পারুল আক্তার, বিভা রাণী দাস, তানিয়া, তান্নি বেগম, সাথী রাণী নাগ ক্যাম্পাসে অবস্থান নেন। পরবর্তীতে এসএমপির উপ-কমিশনার (উত্তর) আজবাহার আলী শেখ, অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (ক্রাইম-উত্তর) শাহরিয়ার আল মামুন, অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (প্রশাসন-উত্তর) গৌতম চন্দ্র দাসসহ এসএমপির ক্রাইসিস রেসপন্স টিমের এসআই ইব্রাহিম, নায়েক সুহেল, মাজেদ, কনস্টেবল শফিউল, ফয়সল, খালেদ, আলমাছ, মামুন, আলমগীর, রায়হান, কামরুল, ফেরদৌস, শাহীন ও এসএমপির পুলিশ লাইন্সের এসআই আতিকুর রহমান, এএসআই কামাল, কনস্টেবল ফিরোজ, হোসাইন, মানিক, মনির, সাইফুল, মির্জা, শিপলু, সুজন, স্বপ্না, কনক, তানিয়া, মাম্পি, সুপ্রমা, চম্পা, সুবিতা, সাবিনা, সাথী, তানিমা সবাই শাবিতে অবস্থান করেন। এজাহারে লিখা হয়েছে, সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রভোস্টের পদত্যাগসহ তিন দফা দাবিতে গত ১৩ জানুয়ারি রাতে শুরু হয় ছাত্রীদের আন্দোলন। পরে শাবি ভিসির মৌখিক আশ্বাসে ছাত্রীরা সাময়িকভাবে আন্দোলন স্থগিত করেন। ১৫ তারিখ অবধি দাবি বাস্তবায়ন না হওয়ায় ওইদিন সাড়ে ৫টায় গোলচত্বরে অবস্থান নিয়ে মানববন্ধন করেন ছাত্রীরা। উত্ত ঘটনাকে কেন্দ্র করে ১৬ জানু আনুমানিক বিকাল ৩টায় সাধারণ শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে যোগ দেয়। সেদিন বিকাল সোয়া ৩টায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে ভিসিকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে। তারা ড. এমএ ওয়াজদ আলী আইসিটি ভবনে তালা দিয়ে ভিসিকে অবরুদ্ধ করে রাখে। এজাহারে উল্লেখ রয়েছে, বিকাল ৩টা ৪০ মিনিটে এসএমপির উপ-কমিশনার (উত্তর) আজবাহার আলী শেখ ওই ভবনে ঢুকে শিক্ষকদের সাথে শিক্ষর্থীদের দাবি নিয়ে কথা বলে বিষয়টি সমাধানের অনুরোধ জানান। তিনি ভিসিকে ভবন থেকে বের করার চেষ্টা করেন। শিক্ষার্থীরা কারো কথা না শুনে স্লোগান অব্যাহত রাখে। একপর্যায়ে বিকাল সাড়ে ৫টায় আন্দোলনরত ২-৩শ’ উচ্ছৃঙ্খল শিক্ষার্থী হঠাৎ কর্তব্যরত পুলিশের ওপর চড়াও হয়। তারা সরকারি আগ্নোয়াস্ত্র ধরে টানাটাানি করে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। চারদিক থেকে বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল নিক্ষেপসহ আগ্নেয়াস্ত্র থেকে গুলি ছুঁড়ে। এ ছাড়াও পুলিশের ওপর ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ক্যাম্পাসে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। ঘটনায় জড়িত শিক্ষার্থীরা সেদিন সোয়া ৩টা থেকে রাত সাড়ে ১১টা অবধি ক্যাম্পাসে অবস্থান করে থেম থেমে পুলিশের ওপর আক্রমণ অব্যাহত রাখে। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ, জানমাল, আগ্নেয়াস্ত্র ও সরকারি সম্পত্তি রক্ষায় ১১ রাউন্ড রাবার কার্তুজ ও ২০ রাউন্ড সিসা কার্তুজসহ মোট ৩১ রাউন্ড শটগানের গুলি ছুঁড়ে।এ ছাড়া সিআরটি ২১টি সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। সেদিন সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় ভিসিকে উদ্ধার করা হয়। মামলার বাদী উল্লেখ করেছেন, ইটপাটকেল ও ককটেলে উপ-পুলিশ কমিশনার (উত্তর), অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (উত্তর), জালালাবাদ থানার পরিদর্শক (তদন্ত), এসআই আসাদুজ্জামান, কাজী জামাল উদ্দিন, রফিকুল ইসলাম, এএসআই কামাল হোসেন, ফারুক আহমেদ, কনস্টেবল রকিবুল হাসান, জয়নাল আবেদীন, মিজানুর রহমান, ইয়ারুপ মিয়া, কাওছার হাবিব, শুকুর আলী আহত হন। তারা ওসমানীতে চিকিৎসা নেন। শিক্ষার্থীদের ছোঁয়া গুলিতে কনস্টেবল সাবিনা আক্তারের বাম পায়ে গুরুতর জখম হয়। ইটপাটকেলে কনস্টেবল সঞ্জিত দাসের ডান হাতের আঙুল ভেঙে যায়। সিআরটির কনস্টেবল ফাহাদ হোসেন অপুর মাথায় ফেটে যায় ইটের আঘাতে। শিক্ষামন্ত্রী,র নির্দেশে আওয়ামী লীগের সাংগঠনক সম্পাদক শফিউল আলম নাদেল শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির নির্দেশ পেয়েই গতকাল মঙ্গরবার ঢাকা থেকে সিলেটে ছুটে এসে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সাথে সংহতি প্রকাশ করেছেন আওয়ামী লীগ নেতা শফিউল আলম নাদেল। আজ মঙ্গলবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে তিনি স্থানীয় কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতাসহ ক্যাম্পাসে যান। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম নাদেলের সাথে সদর উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আশফাক আহমদ, মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জাকির হোসেন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বিধান কুমার সাহা, সিসিকের ৮নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ইলিয়াছুর রহমান ইলিয়াছ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। আওয়ামী লীগ নেতারা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সাথে সংহতি প্রকাশ করেন। শিক্ষার্থীদের দাবি বাস্তবায়নে কিছুটা সময় দেওয়ার আহবান জানান তারা। একইসাথে আলোচনার মাধ্যমে যাতে সমাধানে পৌঁছা যায়, সেই পথ খোলা রাখতে আন্দোলনরতদের প্রতি আহবান জানান তারা। বিশ্ববিদ্যালয়ের গোল চত্বরে অবস্থানরত শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে শফিউল আলম নাদেল বলেন, ‘শিক্ষামন্ত্রীর নির্দেশে আমি আজকে ঢাকা থেকে এসেছি। আমাদের দল ও সরকার আপনাদের পাশে আছে। আমরা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে এই সংকট থেকে বের হয়ে আসার একটি পথ খুঁজে বের করার চেষ্টা করবো।’ তিনি বলেন, ‘আমি আপনাদের দাবির প্রতি একমত। আপনাদের প্রাথমিক দাবিগুলো যাতে দ্রুত বাস্তবায়ন হয় সে চেষ্টা করবো। তবে আমাদের একটু সময় দিতে হবে। যাতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ ফিরে আসে সে চেষ্টা চালাবো।’নাদেল বলেন, ‘আমি শুধু আজকে এটুকু বলতে চাই, আমরা আপনাদের পাশে আছি, পাশে থাকব। আপনাদের আন্দোলনে যাতে কোনো সুযোগসন্ধানী গোষ্ঠী ঢুকে না পড়ে সে ব্যাপারে আপনাদের সজাগ থাকতে হবে।’ এ সময় মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা অধ্যাপক জাকির হোসেন বলেন, ‘পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে ক্যাম্পাস থেকে এরই মধ্যে অতিরিক্ত পুলিশসহ সাঁজোয়াযান সরিয়ে নেয়া হয়েছে। আপনারা যাতে সন্তোষজনক সমাধান পান আমরা সে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ বা অবরুদ্ধ রাখার জন্য নয়। এখানে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে।’ শিক্ষার্থীরা আওয়ামী লীগ নেতাদের কথায় আশ্বস্ত হননি। তারা উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগ চেয়ে আন্দোলন অব্যাহত রাখেন। ওই সময় সাব্বির হোসেন নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমরা উপাচার্যের পদত্যাগ চাই। তিনি আমাদের ওপর গুলি চালিয়েছেন। তার ক্যাম্পাসে থাকার কোনো অধিকার নাই। উনি পদত্যাগ না করা পর্যন্ত আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাব।’ এদিকে, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলার পর বেলা পৌনে ২টার দিকে উপাচার্যর বাসভবনে যান আওয়ামী লীগ নেতারা। তাঁর সাথে কথা বলে তাঁরা ক্যাম্পাস ত্যাগ করেন।