সোমবার, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:১৭ পূর্বাহ্ন

অতিঝুঁকিপূর্ণ বহুতল ভবন ঢাকার চেয়ে চট্টগ্রামে বেশি

খবরপত্র ডেস্ক
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেড়েছে বহুতল ভবন নির্মাণ। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই এসব ভবন নির্মাণে মানা হচ্ছে না নিরাপত্তা নির্দেশিকা। ফায়ার সার্ভিসের তথ্য বলছে, বর্তমানে অগ্নিনিরাপত্তায় অতিঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা ঢাকার চেয়ে চট্টগ্রামে বেশি। এসব ভবনে অগ্নিকা-সহ যেকোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে পরিস্থিতি সামাল দেয়া সম্ভব হবে না। নিরাপত্তা নিশ্চিত না করা পর্যন্ত ওইসব বহুতল ভবনের গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন রাখার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।
পরপর বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনার পর সারা দেশের বহুতল ভবনের নিরাপত্তা প্রস্তুতি পরিদর্শন শুরু করে ফায়ার সার্ভিস। ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত তারা ৫ হাজার ৫৬৭টি বহুতল ভবন পরিদর্শন করে। এর মধ্যে আবাসিক ভবনের পাশাপাশি রয়েছে বাণিজ্যিক ভবন, হাসপাতাল, শিল্প-কারখানা ও অন্যান্য শ্রেণীভুক্ত ভবন। ফায়ার সার্ভিসের পরিদর্শনে চিহ্নিত হয়েছে নিরাপত্তা নির্দেশনা উপেক্ষা করে নির্মিত ৫৩১টি অতিঝুঁকিপূর্ণ এবং ১ হাজার ২৯২টি ঝুঁকিপূর্ণ বহুতল ভবন।
জরিপের তথ্য বলছে, ফায়ার সার্ভিসের পরিদর্শনকারী দল ঢাকার ৮৫৫টি বহুতল ভবন পরিদর্শন করে ১০৪টি অতিঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করেছে। অর্থাৎ ঢাকায় অতিঝুঁকিপূর্ণ ভবনের হার ১২ শতাংশ। এর বাইরে ৪২০টি বহুতল ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ ও অতিঝুঁকিপূর্ণ ভবন শনাক্তে ঢাকায় কয়েক বছর ধরে কাজ করার পর বহুতল ভবনগুলোর নিরাপত্তা মানের কিছুটা উন্নতি হয়েছে বলে মত দিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের পরিদর্শনকারী দল। তবে চট্টগ্রামের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তারা। চট্টগ্রামের ২ হাজার ১৪৬টি বহুতল ভবন পরিদর্শন করে ৩৯৮টি ভবন অতিঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অর্থাৎ চট্টগ্রামে ফায়ার সার্ভিসের পরিদর্শন করা ভবনের মধ্যে অতিঝুঁকিপূর্ণ ভবনের হার ১৯ শতাংশ। চট্টগ্রামের ৫২৬টি বহুতল ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ উল্লেখ করে নিরাপত্তা মানের উন্নতি করতে সময় বেঁধে দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।
ঢাকার চেয়ে চট্টগ্রামে অতিঝুঁকিপূর্ণ বহুতল ভবন বেশি হওয়ার কারণও শনাক্ত করেছে ফায়ার সার্ভিসের পরিদর্শনকারী দল। তাদের মতে, ২০১৬ সাল থেকে প্রতি বছরই নিয়ম করে ঢাকার বহুতল ভবনগুলো পরিদর্শন করে আসছে ফায়ার সার্ভিস। যেসব বহুতল ভবনে নিরাপত্তা ত্রুটি ছিল, সেগুলো শনাক্ত করে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছিল। ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো ছয় মাস অন্তর পরিদর্শন করা হয়েছে। এতে ভবন মালিকরাও বাধ্য হয়েছেন নিরাপত্তা নির্দেশিকা বাস্তবায়নে। কিন্তু গত বছরই প্রথমবারের মতো সারা দেশের বহুতল ভবন পরিদর্শনের উদ্যোগ নেয়া হয়। এর আগে চট্টগ্রামের বহুতল ভবনগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা পরিদর্শন করা হয়নি।
ঝুঁকিপূর্ণ ও অতিঝুঁকিপূর্ণ বহুতল ভবন শনাক্তের ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি বিষয়ে নজর দেয়া হয় বলে জানান ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সাজ্জাদ হোসাইন। তিনি বলেন, বেশ কয়েকটি নিরাপত্তা নির্দেশিকার ভিত্তিতে বহুতল ভবনগুলোকে ঝুঁকিপূর্ণ ও অতিঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে জরুরি নির্গমন সিঁড়ি, ফায়ার লিফট, আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়াটার রিজার্ভ ব্যবস্থা, রাইজার ও হাইড্র্যান্টের মতো জরুরি সরঞ্জামাদির ব্যবস্থা বিবেচনায় নেয়া হয়। পাশাপাশি বহুতল ভবনের সুরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে প্রত্যেক ফ্লোরে সেফটি লবি থাকার কথা থাকলেও এসব বহুতল ভবনে তা নেই। এমনকি ছাদে বজ্র নিরোধ ব্যবস্থাও নেই। এজন্য ভবনগুলোকে ঝুঁকিপূর্ণ ও অতিঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে শনাক্ত করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ত্রুটিগুলো সমাধান করতে বলা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের জরিপের তথ্য বলছে, রাজশাহীর ১ হাজার ২৫৩টি বহুতল ভবন পরিদর্শন করে সাতটি ভবনকে অতিঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে ৭৯টি ভবন। আর সন্তোষজনক নিরাপত্তা ব্যবস্থা মিলেছে ১ হাজার ১৬৭টি বহুতল ভবনে। খুলনার ২২৫টি বহুতল ভবন পরিদর্শন করে অতিঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে দুটি এবং ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ৪৭টি ভবন শনাক্ত করা হয়েছে। সন্তোষজনক নিরাপত্তা ব্যবস্থা মিলেছে ১৭৬টি বহুতল ভবনে। বরিশালের ৪৩টি বহুতল ভবন পরিদর্শন করে একটি অতিঝুঁকিপূর্ণ এবং ২৩টি বহুতল ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। সিলেটে ২১৪টি বহুতল ভবন পরিদর্শন করে ১৫টি ঝুঁকিপূর্ণ এবং ১৯৯টি ভবনকে সন্তোষজনক মান দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। এ বিভাগে অতিঝুঁকিপূর্ণ কোনো ভবন নেই বলেও জানিয়েছে সেবা প্রদানকারী সংস্থাটি।
সিলেটের মতো ময়মনসিংহেও অতিঝুঁকিপূর্ণ বহুতল ভবন নেই বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। সেখানকার ১৬৮টি বহুতল ভবন পরিদর্শন করে ১৬টি ঝুঁকিপূর্ণ এবং ১৬১টি বহুতল ভবনকে সন্তোষজনক মান দিয়েছে সংস্থাটি। রংপুরের ৬৬৩টি বহুতল ভবন পরিদর্শন করে ১৯টি অতিঝুঁকিপূর্ণ এবং ১৬৬টি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। নগর বিশেষজ্ঞদের মতে, তিনটি স্তরে এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ ভবন তৈরি হয়। এর প্রথমটি হচ্ছে, অনুমোদন না নিয়েই বহুতল ভবন নির্মাণ। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, যে শর্তে অনুমোদন নেয়া হয়েছে বহুতল ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে তা পালন করা হয়নি। আর ভবন নির্মাণ শেষে সব শর্ত পালন হয়েছে কিনা, তা নিশ্চিত করার কোনো কর্তৃপক্ষ না থাকা। তৃতীয়টি হচ্ছে, অনুমোদন নেয়া হয়েছে। শর্তও পালন করা হয়েছে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেখা যায়, সেটি আবাসিক থেকে বাণিজ্যিক ভবনে রূপান্তর ঘটেছে। যখন আবাসিক থেকে বাণিজ্যিক হয়ে যায়, তখন সেখানে এয়ারকন্ডিশনারের ব্যবহার বেড়ে যায়। ফলে এসব এয়ারকন্ডিশনারের যে তাপ, সেটা আবাসিক ভবনের মতো নয়। আবার বাণিজ্যিক ভবনের জন্য যেমন রাস্তা থাকা দরকার, সেটাও আবাসিক ভবনে থাকে না। এ তিনটি স্তরে দুর্বলতা শনাক্তের জন্য এখন পর্যন্ত কোনো কর্তৃপক্ষ নেই বলেও দাবি বিশেষজ্ঞদের। স্থপতি ও নগর বিশেষজ্ঞ ইকবাল হাবিব বণিক বার্তাকে বলেন, যদি নবায়নযোগ্য কমপ্লায়েন্স সার্টিফিকেট দেয়ার ব্যবস্থা থাকত, প্রতি বছর পরিদর্শন করে যদি সার্টিফিকেট দেয়া হতো, তাহলে হয়তো এমন সংকট হতো না। আপনি যদি প্রতিবেশী দেশ ভারতে যান, সেখানেও দেখবেন প্রতিটি লিফটে লেখা থাকে, শেষ কবে পরিদর্শন করা হয়েছে এবং পরবর্তী সময়ে কবে আবার পরিদর্শন করা হবে। সেটা কিন্তু আমাদের এখানে নেই।
সমাধান হিসেবে তিনি বলেন, আমাদের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার নেতৃত্বে প্রত্যেকটি বাসায় নজরদারি করতে হবে। প্রতি বছরে ভবনগুলো পরিদর্শন করতে হবে। বিশেষ করে ফায়ার, ইলেক্ট্রিক্যাল ও মেকানিক্যাল যন্ত্রপাতি যেমন, লিফট প্রতি বছর পরিদর্শন করতে হবে। না হলে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির লাইন বন্ধ করে দিতে হবে।- সূত্র: বণিকবার্তা




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com