মহান আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে মানুষ ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ বা সৃষ্টির সেরা জীব। এই মানুষকে আল্লাহ এমন একটি নিয়ামত দিয়েছেন যা অন্য কোনো প্রাণীকে দেননি; আর তা হচ্ছে মানুষের মুখের ভাষা। ভাষা আল্লাহর দান, আল্লাহ তায়ালার সেরা নিয়ামত; ভাষা মনুষ্য পরিচয়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য। ইসলাম সব ভাষাকে সম্মান করতে শেখায়; কারণ, সব ভাষাই আল্লাহর দান ও তাঁর কুদরতের নিদর্শন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘আর তাঁর নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে আকাশম-লী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। এতে জ্ঞানীদের জন্য অবশ্যই বহু নিদর্শন রয়েছে।’ (সূরা রুম : ২১-২২)
মানুষের মধ্যে দিয়েছেন রঙের ভিন্নতা, ভাষার ভিন্নতা, দিয়েছেন রুচির বৈচিত্র্য। এর মাধ্যমেই আল্লাহর মহা কুদরত ও অপরূপ মহিমা ফুটে উঠেছে।
সব মানুষ একই পিতা-মাতার সন্তান। সবারই পিতা আদম আ:, সবারই মা হাওয়া আ:। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘হে মানুষ! আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী থেকে, পরে তোমাদের বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অন্যের সাথে পরিচিত হতে পারো। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই ব্যক্তিই বেশি মর্যাদাসম্পন্ন, যে তোমাদের মধ্যে অধিক মুত্তাকি। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব কিছু জানেন, সব খবর রাখেন।’ (সূরা হুজুরাত : ১৩) এখানে মূলত ভাষা, অঞ্চল, গায়ের রঙ ইত্যাদির ভিন্নতার কারণে মর্যাদার তারতম্য না হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে।
বিদায় হজের ভাষণে মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা: বলেছেন, ‘কালোর ওপর সাদার প্রাধান্য নেই, অনারবের ওপর আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই।’ (বুখারি শরিফ) সুতরাং কোনো ভাষাকে হেয়জ্ঞান করা যাবে না, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা যাবে না এবং অবহেলা করা যাবে না; কেননা, ভাষার স্রষ্টাও মহান আল্লাহ। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি প্রত্যেক রাসূলকেই তার স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি তাদের কাছে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য।’ (সূরা ইবরাহিম : ৪)
আল্লাহর নবী হজরত মুসা আ:-এর স¤প্রদায়ের ভাষা ছিল ইবরানি। তাই এ ভাষায় তাওরাত নাজিল হয়। হজরত দাউদ আ:-এর গোত্রের ভাষা ছিল ইউনানি। তাই যাবুর ইউনানি বা আরামাইক ভাষায় অবতীর্ণ হয়। অন্য দিকে, মহান আল্লাহ হজরত দাউদ আ:-কে দান করেছিলেন সুমধুর কণ্ঠস্বর। ফলে তাঁর ওপর নাজিলকৃত কিতাব পাঠ করার সময় তাঁর কণ্ঠের মোহনীয় সুরের মূর্ছনায় আল্লাহর বাণী শোনার জন্য সাগরের মৎস্যপ্রজাতি কিনারে এসে ভিড় জমাত। আবার সুলায়মান আ:-কে মহান আল্লাহ পশুপাখির ভাষাসহ সব জীবের ভাষা বোঝার জ্ঞানদান করেছিলেন। যার মাধ্যমে আল্লাহর নবী সুলায়মান আ: তাদের শাসনও করেছেন এবং তাদের কথাবার্তা শুনে বিবদমান বিভিন্ন সমস্যার সমাধান দিতেন অত্যন্ত সুচারুভাবে।
ধর্ম প্রচারে শুদ্ধ ভাষা ও সুন্দর বর্ণনার প্রভাব অনস্বীকার্য। আমাদের প্রিয় রাসূল হজরত মুহাম্মদ সা: ছিলেন ‘আফছাহুল আরব’ তথা আরবের শ্রেষ্ঠ বিশুদ্ধভাষী। তাই বিশুদ্ধ মাতৃভাষায় কথা বলা নবীজী সা:-এর সুন্নত। নবী করিম সা: বলেন, ‘ইন্না মিনাল বায়ানি লা ছিহরুন মুবিন’-অর্থাৎ কিছু বর্ণনায় রয়েছে স্পষ্ট জাদুর ছোঁয়া। আল্লাহ তায়ালা বনি ইসরাইলের হিদায়াতের জন্য হজরত মুসা আ:-এর প্রতি ওহি নাজিল করলেন; তাঁকে নবী ও রাসূল হিসেবে ঘোষণা করলেন; তাঁর ওপর তাওরাত কিতাব অবতীর্ণ করলেন। তখন তিনি তাঁর ভাই হজরত হারুন আ:-কে নবী ও রাসূল হিসেবে ঘোষণা করার জন্য আল্লাহর সমীপে আবেদন আরজ করলেন। কারণ তিনি ছিলেন বাগ্মী, শুদ্ধ ও স্পষ্টভাষী এবং সুবক্তা, আর মুসা আ:-এর মুখে ছিল জড়তা। মুসা আ: কারণ হিসেবেও বলেছেন, ‘হুয়া আফছাহু মিন্নি।’ অর্থাৎ সে আমার অপেক্ষা শুদ্ধভাষি। পবিত্র কুরআনে সূরা ত্বহার ২৫ নং আয়াত থেকে এই ঘটনা বর্ণনা শুরু হয়েছে।
প্রতিটি মুসলমানের ধর্মীয় অনুভূতি ও বিশ্বাসের সাথে স্বাধীনতা, স্বদেশপ্রেম ও মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা বিদ্যমান। এ ক্ষেত্রে ধর্মবিশ্বাসের পার্থক্য কোনো বিভেদ বা বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি করে না। তাই মুসলিম নাগরিকরা সবসময় মা, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসার চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছেন। ইসলাম সব ভাষাকে সম্মান করতে শেখায়। তাই আল্লাহর কাছে প্রার্থনা, আল্লাহ তায়ালা ভাষাশহীদসহ সব শহীদানের শাহাদাত কবুল করুন এবং জান্নাতুল ফিরদাউসে তাঁদের উচ্চমর্যাদায় আসীন করুন। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের মাতৃভাষা বাংলা ভাষাকে কিয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী রাখুন এবং কিয়ামত পর্যন্ত উত্তরোত্তর এর শ্রীবৃদ্ধি করুন। আমাদের বিশুদ্ধ মাতৃভাষার ব্যবহার ও এর মাধ্যমে সত্য ও ন্যায়ের প্রতি দাওয়াতের তৌফিক দান করুন। -লেখক: শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।