রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:০৮ অপরাহ্ন

সঞ্চয়পত্র বিক্রি নেমেছে অর্ধেকে

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় বুধবার, ৯ মার্চ, ২০২২

দেশের বাজারে এমন কোনো পণ্য নেই, যার দাম বাড়েনি। দাম বৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় ভোক্তাদের নাভিশ্বাস। দাম বাড়ানোর সিন্ডিকেট ধরতে অভিযান চালানোসহ কোনো কিছুতেই কাটছে না ভোজ্যতেল সরবরাহের সঙ্কট। তাই দিনকে দিন ভোক্তার নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে ভোজ্যতেলের বাজার। তবে খুচরা ব্যবসায়ীরা বলেছেনÑ শুধু তেলের দামই নয়; চাল, আটা, চিনি, ডাল, পিঁয়াজসহ সব নিত্য পণ্যেরই দাম বেশি। পাশাপাশি সবজিসহ অধিকাংশ খাদ্যপণ্যের দামই দিনে দিনে হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। বাজারে আসা অবসরপ্রাপ্ত কমকর্তা আবদুর রহিম নিজের ভোগান্তিতে পড়ার কথা জানিয়ে বলেনÑ তেল, চাল, চিনিসহ সবকিছুর দামই বেড়ে গেছে। যে পেঁয়াজ ৩০ টাকা কেজি ছিল এক সপ্তাহ আগে, সেটি এখন ৭০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। আমাদের তো নাভিশ্বাস। আমরা অবসরপ্রাপ্ত মানুষ, বিপদে রয়েছি। বাজারে ভয়ে আসি না, আসলেও দেখতে আসি যে দাম কমেছে কি না।
বাজারে চাল, ডাল তেলের দামে পাশাপাশি প্রতিযোগিতা করে বাড়ছে সাবান, টুথপেষ্ট, গুঁড়াদুধসহ অন্যান্য নিত্য পণ্যের দামও। ফলে নিত্যপণ্য কিনে সংসার চালাতে গিয়ে মানুষের হাত পড়েছে সঞ্চয়ের ওপর। সংসার চালাতে মানুষ তার সঞ্চয়ের টাকা ভেঙ্গে ভেঙ্গে খাচ্ছে। ব্যাংক আমানতের সুদহার কম। আবার সময়মতো গ্রাহকের অর্থ ফেরত না দেয়া, অনিয়মের কারনে দেউলিয়া হয়ে যাওয়াসহ নানা কারণে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর মানুষ আস্থা তলানিতে। শেয়ার বাজার বা বন্ড মার্কেট দীর্ঘদিন পর কিছুটা আস্থা ফিরলেও অতীত অভিজ্ঞতাও বেশ নেতিবাচক। দেশে প্রবীণ, কর্মহীন বা দরিদ্র মানুষের জন্য ব্যাপক অর্থে কোন সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী নেই। তাই সরকার অল্প আয়ের মানুষদের জন্য নিরাপদ সঞ্চয়ের সুযোগ হিসেবে সঞ্চয়পত্রে বাড়তি সুদে বিনিয়োগের সুযোগ রেখেছিল। যাতে প্রবীণ, অবসরপ্রাপ্ত কর্মহীন বা দরিদ্র মানুষ উপকৃত হন। কিন্তু নিত্যপণ্যের দাম আকাশচুম্বি হওয়ায় এবং দৈনন্দিন ব্যয় বাড়ায় মূল্যস্ফীতির চাপ সেখানেও পড়েছে। সঞ্চয়পত্র বিক্রি অর্ধেকে নেমে এসেছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে ১২ হাজার ১৭৬ কোটি টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে অর্ধেকেরও কম। ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে এই বিক্রির পরিমাণ ছিল ২৫ হাজার ৭০২ কোটি টাকা। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাজারে সব জিনিসের দামই চড়া। পরিবহন, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ অন্য সব খাতেও খরচ বেড়েছে। এতে মানুষের সঞ্চয় করার ক্ষমতা কমে গেছে। এর প্রভাব পড়ছে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে। সর্বশেষ জানুয়ারি মাসে ২ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। অথচ গত বছরের জানুয়ারিতে এই বিক্রির পরমাণ ছিল দ্বিগুণেরও বেশি ৫ হাজার ২১৫ কোটি টাকা।
এমনকি বিক্রির চাপ কমাতে ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে মুনাফার ওপর উৎসে করের হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়। একই সঙ্গে এক লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে টিআইএন (কর শনাক্তকরণ নম্বর) বাধ্যতামূলক করা হয়। একই সঙ্গে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট না থাকলে সঞ্চয়পত্র বিক্রি না করার শর্ত আরোপসহ আরও কিছু কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়। তারপরও সঞ্চয়পত্রে মানুষের আগ্রহ কমাতে পারেনি সরকার। অথচ গত ১ বছর ধরে গরীব, পেনশনারসহ নির্ভরশীলদের অন্যতম নিরাপদ বিনিয়োগের নাম সঞ্চয়পত্র থেকেও মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। কারণ মানুষের সঞ্চয় কমে গেছে।
অথচ অল্প আয়ের মানুষের নিরাপদ বিনিয়োগ সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কমাতে গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ২ শতাংশের মতো কমিয়ে দেয় সরকার। এরপরও বিক্রি বাড়ছিল।
তবে গত কয়েক মাস ধরে বিক্রি বেশ কমেছে। গত ডিসেম্বরে যে টাকার সঞ্চয়পত্র সরকার বিক্রি করেছে, তার চেয়ে ৪৩৬ কোটি টাকা বেশি খরচ হয়েছে সুদ-আসল পরিশোধে। অর্থাৎ ডিসেম্বর মাসে সরকার তার কোষাগার থেকে আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের সুদ-আসল বাবদ ৪৩৬ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। অথচ ২০২০ সালের ডিসেম্বরেও সুদ-আসল পরিশোধের পর সরকারের কোষাগারে ১ হাজার ৪৪২ কোটি ২০ লাখ টাকা জমা ছিল, যাকে বলা হয় নিট বিক্রি।
সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমার কারণ ব্যাখ্যা করে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক ও অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বলেন, এমনিতেই দুই বছরের করোনা মহামারির কারণে মানুষের আয়-উপার্জন কমে গেছে। অনেকে চাকরি হারিয়ে গ্রামে চলে গেছেন। কারও বেতন কমেছে। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় অর্থাৎ বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় মানুষের সঞ্চয় করার ক্ষমতা কমে গেছে। এ কারণে মানুষ আর আগের মতো সঞ্চয়পত্র কিনতে পারছে না। তবে এখনও সবচেয়ে নিরাপদ বিনিয়োগ হচ্ছে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ; এখানে কোনো ধরনের ঝুঁকি নেই, মাস শেষে বা নির্দিষ্ট সময় শেষে সুদ-আসল পাওয়া যায়। তাই সঞ্চয়পত্রের প্রতি মানুষের আগ্রহ কমেনি, তবে এখন সঞ্চয়পত্র কেনার মতো সঞ্চয় নেই মানুষের কাছে। সে কারণে কমে গেছে এ খাতে বিনিয়োগ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসভিত্তিক) গত জানুয়ারি মাসে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ। গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৬২ শতাংশ। তবে সরকার বা বিবিএসের দেয়া হিসাবের চেয়ে মূল্যস্ফীতির হার বাস্তবে অনেক বেশি বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) সাধারণ সম্পাদক এস এম রাশিদুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, নিত্যপণ্যের দাম আকাশচুম্বি হওয়ায় এবং দৈনন্দিন ব্যয় বাড়ায় মানুষের ত্রাহি অবস্থা। জীবন নির্বাহ করতে গিয়ে মানুষের হাত পড়েছে সঞ্চয়ের ওপর। তাই সঞ্চয়পত্র কেনার মতো অতিরিক্ত সঞ্চয় নেই মানুষের কাছে। সে কারণে কমে গেছে এ খাতে বিনিয়োগ।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) বলছে, দেশে মূল্যস্ফীতির প্রকৃত হার বিবিএসের চেয়ে দ্বিগুণের চেয়ে বেশি। গত ৩ মার্চ ‘মূল্যস্ফীতি: সরকারি পরিসংখ্যান বনাম প্রান্তিক মানুষের বাস্তবতা’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে সানেম। এতে বলা হয়েছে, শহর এলাকায় সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার এখন ১২ দশমিক ৪৭ শতাংশ। আর গ্রামে এই হার ১২ দশমিক ১০ শতাংশ। প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, পণ্যমূল্য নিয়ে সরকারি সংস্থা বিবিএস যে তথ্য দিচ্ছে তা বাস্তবের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। এ ক্ষেত্রে যদি সঠিক তথ্য তুলে আনা না হয়, তবে পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া টেকসই হবে না। নানা তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, বিবিএস পুরোনো ভিত্তি বছর ধরে মূল্যস্ফীতির হিসাব করছে, যা বর্তমান সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য না। সেলিম রায়হান বলেন, নি¤œ ও মধ্যবিত্ত মানুষ খুবই চাপে আছে। ভাত না খেয়ে অন্যকিছু খেয়েক্ষুধা নিবারণ করছে অনেক মানুষ। একই কথা বলেছেন অর্থনীতির গবেষক বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, বিবিএসের মূল্যস্ফীতির তথ্য বিস্ময়কর। এটা দেশের কোনো মানুষই বিশ্বাস করবে না। আন্তর্জাতিক বাজারে সব জিনিসের দাম চড়া। দেশের বাজারেও চাল, ডাল, ভোজ্যতেলসহ সবকিছুর বাড়তি দামে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। তখন আমাদের পরিসংখ্যান ব্যুরো বলছে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের কম। এটা কী করে সম্ভব? কোথা থেকে ডেটা নিয়ে কী তথ্য প্রকাশ করে তারা কে জানে? বিবিএসের এই তথ্য বাজারের বাস্তব অবস্থার সঙ্গে কোনোভাবেই মেলে না। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ বলছে, বিশ্ব অর্থনীতির প্রধান সমস্যা এখন মূল্যস্ফীতি; তখন আমাদের বিবিএস জানুয়ারি মাসের হিসাব দিয়ে বলেছে, মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ থেকে কমে ৫ দশমিক ৮৬ শতাংশে নেমে এসেছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশে মূল্যস্ফীতি কমছে-এটা সত্যিই বিস্ময়কর মনে হচ্ছে আমার কাছে।- সূত্র: দৈনিক ইনকিলাব অন লাইন




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com