রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০২:২৩ অপরাহ্ন

বেসরকারি ব্যাংকেও ঋণ পুনঃতফসিল রোগ

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ২৯ মার্চ, ২০২২

ব্যাংকের টাকা ফেরত দেন না কারা? দেশের ব্যাংক খাতে এখন জেঁকে বসেছে ঋণ পুনঃতফসিলের সংস্কৃতি। দীর্ঘদিন ধরে গ্রাহক ও ব্যাংক কর্মকর্তাদের সমঝোতার মাধ্যমে পুনঃতফসিলের ঘটনা ঘটছে।
২০১২ সালের দিকে এই রোগ ছিল কেবল সরকারি ব্যাংকে। সংক্রমিত হয়ে এই রোগ ছড়িয়ে পড়েছে বেসরকারিতেও। বর্তমানে সরকারি ব্যাংকের চেয়ে বেসরকারি ব্যাংকে বেশি পুনঃতফসিলের ঘটনা ঘটেছে। অবশ্য এই রোগ ছড়ানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকেরও সায় আছে। এছাড়া করোনাকালে ব্যবসায়ীদের বিশেষ সুবিধা দিয়ে ঋণের কিস্তি পরিশোধে তিন বছর সময় দেওয়া হয়েছে। ফলে নিয়মের মধ্যেও ব্যাংকের টাকা ফেরত আসছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত দুই বছরে (২০২০ ও ২০২১) প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে। অর্থাৎ এই পরিমাণ ঋণ পরিশোধে সময় বাড়ানোর কারণে ব্যাংকে টাকা ফেরত আসছে না। আবার এই দুই বছরে সুদ মওকুফ করা হয়েছে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা। এই মওকুফের টাকাও ব্যাংকে আসছে না। এছাড়া বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। ঋণ অবলোপন করা হলে ব্যাংকের ব্যালেন্স শিট (হিসাব) থেকে মুছে ফেলা হয়, ফলে ভবিষ্যতেও এসব ঋণ আর পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা থাকে না।
সাধারণত ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণ করতে ব্যর্থ হওয়ার পরে ঋণ অবলোপন করে। মহামারির কারণে ব্যাংকগুলো প্রভিশন সংরক্ষণ করতে না পেরেই ঢালাওভাবে ঋণ অবলোপন করেছে।
ফেরত আসার সম্ভাবনা একেবারেই নেই: বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ৬ ব্যাংকের ঋণ অবলোপন ১৭ হাজার ২১৯ কোটি টাকা। এই সময়ে ৪১টি বেসরকারি ব্যাংকের ২৪ হাজার ৯৫৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা, ৯টি বিদেশি ব্যাংকের ১ হাজার ৭১ কোটি টাকা, ৩টি বিশেষায়িত ব্যাংকের ৩৬৫ কোটি টাকা। অর্থনীতিবিদরা বলছেন এই টাকাগুলো হয়ত ফেরত আসবে না।
কিছু ফেরত আসবে হয়তো: বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, করোনার গত দুই বছরে মোট ২৫ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের মাধ্যমে নিয়মিত করেছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এর মধ্যে কিছু টাকা ফেরত আসবে হয়তো। তবে অধিকাংশই ফেরত আসবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের মধ্যে ২০২১ সালে পুনঃতফসিল হয়েছে ১২ হাজার ৩৭৯ কোটি টাকা ও ২০২০ সালে ১৩ হাজার ৪৬৯ কোটি টাকা পুনঃতফসিল করা হয়েছে। গত দুই বছরে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো পুনঃতফসিল করেছে ১৭ হাজার ৭৫৩ কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংগুলো দুই বছরে করেছে ৬ হাজার ৮৯৮ কোটি টাকা। এ ছাড়া বিশেষায়িত খাতের ব্যাংকগুলো করেছে ১ হাজার ১৫৭ কোটি ও বিদেশি খাতের ব্যাংকগুলো করেছে ৪১ কোটি টাকা।
এর আগে, ২০১৯ সালে ব্যাংক খাতের প্রায় ৫৩ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়। এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, কৃষক ও ছোট ব্যবসায়ীরা ব্যাংকের টাকা ফেরত দেন, কিন্তু বড় ব্যবসায়ীরা সব সময় টাকা ফেরত না দেওয়ার নানা টালবাহানা করে থাকে। তিনি বলেন, খেলাপিদের এভাবে বারবার সুবিধা দেওয়া ঠিক হচ্ছে না। এর মাধ্যমে অন্য গ্রাহকদের কাছে এই বার্তা যাচ্ছে যে, ঋণ ফেরত না দিলেও সমস্যা নেই, উল্টো সুবিধা পাওয়া যায়। এটা ব্যাংকিং খাতের জন্য খারাপ সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তিনি উল্লেখ করেন, এভাবে পুনঃতফসিল করে কাগজে-কলমে খেলাপি ঋণ কমলেও বাস্তবে খেলাপিদের কাছে পাওনার পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে।
প্রসঙ্গত, বিশেষ নীতিমালার আওতায় মাত্র ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্টে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ দেয় সরকার। এছাড়া ২০২০ সালের শুরু থেকেই ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করেও কেউ খেলাপি হননি। ২০২১ সালে বকেয়া কিস্তির ১৫ শতাংশ অর্থ পরিশোধ খেলাপিমুক্ত থাকার সুবিধা দেওয়া হয়। এর বাইরেও খেলাপিদের ঋণ পুনঃতফসিল সুবিধা দিয়েছে ব্যাংকগুলো। যদিও করোনার কারণে ব্যবসায়ীদের ক্ষতি বিবেচনায় কয়েক দফায় সুযোগ দেওয়া হয়, যা গত ডিসেম্বরে শেষ হয়েছে। দেখা গেছে, নির্দিষ্ট হারের চেয়ে কম ডাউনপেমেন্টেও বড় বড় গ্রাহকের খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের অনাপত্তি চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে শত শত আবেদন পাঠানো হলে, বাংলাদেশ ব্যাংকও সেসব আবেদনের অধিকাংশই অনুমোদন করে দিয়েছে। এরপরও ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে গেছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ বলেন, ঋণ আদায়ে কঠোর হওয়া দরকার ছিল, কিন্তু খেলাপিদের একের পর এক সুবিধা দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, গত বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা, যা ব্যাংক খাতে মোট বিতরণ করা ঋণের ৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com