মহানবী সা: তাঁর যুগের শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমার যুগ হলো সেরা যুগ, তারপর সাহাবি, তাবেঈন ও তাবে তাবেঈনের যুগ।’ (তিরমিজি হাদিস নং-৩৩০৮)। সাহাবায়ে কিরাম মহানবী সা:-এর সংস্পর্শে এসে নিজেদেরকে সোনার মানুষে পরিণত করেছেন। তাবেঈন সোনার মানুষদের সংস্পর্শে এসে নিজেরাও সোনার মানুষে পরিণত হয়েছেন। তাবে তাবেঈনও তাবেঈনের সংস্পর্শে এসে উত্তম মানবে পরিণত হয়েছেন। এরপর ইসলামের আকাশে নেমে আসে অমানিশার কালো মেঘ। সে আকাশ ধীরে ধীরে কালোই হচ্ছে।
পবিত্র রমজান মাসে শয়তানকে বন্দী করার ব্যাপারে হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে দু’টি হাদিস বর্ণিত আছে। একটি হাদিসে রয়েছে- মহানবী সা: বলেছেন, ‘রমজান মাসের প্রথম রাত এলেই শয়তান ও দুষ্টু জিনদের রশি দিয়ে বেঁধে ফেলা হয়। জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয় তারপর এর একটি দরজাও খোলা হয় না।’ (নাসায়ি, তিরমিজি, ইবনে মাজাহ) অপর হাদিসে রয়েছে- ‘রমজান মাসে বড় বড় শয়তানকে আটক করা হয়’। (নাসায়ি, মুসনাদে আহমদ)। প্রশ্ন হলো, শয়তান বন্দী কিন্তু পাপাচার কেন বন্ধ নয়। প্রতিনিয়ত পত্রিকা, টেলিভিশন ইত্যাদির মাধ্যমে শুনা যায় জেনা-ব্যভিচার, চুরি, ছিনতাই, হত্যা ইত্যাদি হাজারো পাপাচারের কথা। এগুলো কেন হয়? তার কারণ কী?
১. রাসূল সা:-এর অনুসৃত পথে না চলা : তৃতীয় খলিফা হজরত উসমান রা:-এর শাহাদাতের পর থেকে শুরু হয় মুসলমানদের মধ্যে বিভাজন। পরবর্তীতে শিয়া, খারেজি, জাররিয়া, কাদরিয়া, রাফেজি, মুতাজিলা ইত্যাদি ৭৩টি দল সৃষ্টি হয়। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘বনি ইসরাইল বিভক্ত হয়েছে ৭২ দলে। আর আমার উম্মত বিভক্ত হবে ৭৩ দলে। তন্মধ্যে একটি দল ছাড়া অবশিষ্ট সব দল হবে জাহান্নামি।’ সাহাবায়ে কিরাম আরজ করলেন, সেটি কোন দল? হে আল্লাহর রাসূল! রাসূল সা: প্রত্যুত্তরে বলেন, ‘আমি ও আমার সাহাবিগণ যে মত ও পথের উপর আছি তথা যারা আমার ও আমার সাহাবিদের অনুসৃত পথের অনুযায়ী তারাই জান্নাতি।’ বর্তমানে এ পথে না চলাই পাপাচারের মূল কারণ।
২. হকপন্থীদের অনুসরণ না করা : হজরত ইরবাদ ইবনে সারিয়াহ রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূল সা: বলেছেন, ‘আমি তোমাদের আল্লাহকে ভয় করার এবং নেতার কথা শ্রবণ ও মান্য করার উপদেশ দিচ্ছি যদিও সে হাবশি ক্রীতদাস হয়। কেননা, তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি আমার ইন্তিকালের পরে জীবিত থাকবে, সে বহু মতানৈক্য দেখতে পাবে। সুতরাং তোমাদের কর্তব্য হবে, আমার সুন্নাত এবং হিদায়েতপ্রাপ্ত ও সৎপথপ্রাপ্ত খলিফাদের সুন্নাত মজবুতভাবে ধারণ করা।’ মহানবী সা: অন্যত্র বলেছেন, ‘আমার উম্মতের মধ্যে একটি দল সদা সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত ও বিজয়ী থাকবে। যারা তাদের বিরোধিতা করবে তারা বিন্দুমাত্র তাদের ক্ষতি করতে পারবে না।’ (সহিহ বুখারি ও মুসলিম) আরো ইরশাদ করেন, ‘সত্যাশ্রয়ী দলটির ওপর রয়েছে আল্লাহর রহমত। যে ব্যক্তি এ দল থেকে বিচ্ছিন্ন থাকবে সে বিচ্ছিন্নভাবে জাহান্নামে যাবে।’ মহানবী সা: আরো ইরশাদ করেন, ‘তোমরা বৃহত্তম দলের অনুসরণ করবে। হকপন্থীদের অনুসরণই বাঁচাতে পারে পাপাচার থেকে’। সূরা ফাতিহায় আমরা পড়ি- ‘হে আল্লাহ! আমাদেরকে সরল সঠিক পথ প্রদর্শন করুন। তাঁদের পথ যাদের ওপর আপনি নিয়ামত দান করেছেন।’ (সূরা আল-ফাতিহা: ৫-৬) অন্য আয়াতে এই নিয়ামতপ্রাপ্তদের বর্ণনায় বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা যাদের প্রতি নিয়ামত বর্ষণ করেছেন, তারা হলেন- নবীগণ, সিদ্দিকগণ, শহীদগণ ও সৎকর্মশীলগণ।’ (সূরা নিসা-৬৯)
৩. সৎ নেতৃত্বের অভাব : বর্তমানে পৃথিবীতে হজরত উমর রা:-এর মতো নেতার প্রয়োজন। যার শাসনকালে অন্যায়, অনাচার ও কদাচার পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিল। নেতা যদি সৎ হয় তার অনুসারীরা সৎ হতে বাধ্য। নেতা যদি অসৎ হয় তার অনুসারীরা কোনোদিন সৎ হবে না। সমাজ, দেশ ও জাতিকে পাপাচারমুক্ত রাখতে হলে সোনার মানুষ প্রয়োজন। এ সোনার মানুষই গড়তে পারবে সোনার বাংলা।
৪. মা-বাবার শাসন না থাকা : একটি শিশু প্রথমেই খারাপ হয়ে যায় না। মা-বাবা যেভাবে গড়ে সেভাবেই গড়ে ওঠে। সন্তানের প্রতি মা-বাবার রয়েছে অনেক দায়িত্ব। মহানবী সা: বলেছেন, ‘প্রত্যেক সন্তান ইসলামের ওপর জন্মগ্রহণ করে। তারপর তার মা-বাবা তাকে হয়তো ইহুদি কিংবা খ্রিষ্টান বা অগ্নিপূজকে পরিণত করে।’ (সহিহ বুখারি ও মুসলিম) মহানবী সা: বলেছেন, ‘নিজ সন্তানদের তিনটি জিনিস শেখাবে- ১. তোমাদের নবীর প্রতি ভালোবাসা পোষণ; ২. আহলে বাইয়াতের প্রতি ভালোবাসা পোষণ এবং ৩. পবিত্র কুরআনের তিলাওয়াত।’ (তারাবানি, পৃষ্ঠা-১৬৪) অন্যত্র বলেছেন, ‘তোমরা নিজ সন্তানদের শরিয়তের আদিষ্ট বিষয়াদি পালনের এবং নিষিদ্ধ বিষয়াদি থেকে বিরত থাকার হুকুম দেবে। কারণ এটিই হলো তাদের জন্য জাহান্নাম থেকে বেঁচে থাকার উপায়।’ (তাবারি, পৃষ্ঠা-১৫১) আরো ইরশাদ করেন, ‘পিতা নিজ সন্তানকে যে উপঢৌকন দান করে, তার মধ্যে সর্বোত্তম উপঢৌকন হলো সুন্দর শিষ্টাচার শিক্ষা দান।’ (তিরমিজি, বায়হাকি, মিশকাত, পৃষ্ঠ-৪২৩)
৫. দুষ্টের দমন না করা : সবাই পাপ করে না। কিন্তু যারা পাপ করে না তাদের দায়িত্ব হলো যারা পাপ করে তাদের পাপাচার থেকে বিরত রাখা। যদি বিরত না রাখা হয়, তাহলে প্রতীয়মান হলো তারা সমর্থন করে। ফলে পাপী ও গাইরে পাপী সমান হয়ে যায়। মহানবী সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো অন্যায় কাজ হতে দেখে সে যেন শক্তি প্রয়োগ করে তা বন্ধ করে, যদি শক্তিতে না পারে, তবে যেন মুখে প্রতিবাদ করে বন্ধ করে, মুখেও যদি না পারে, তবে যেন অন্তর দিয়ে খারাপ কাজ বন্ধ করার পরিকল্পনা করে। আর এটি দুর্বল ঈমানদারের পরিচয়।’ (মিশকাত) পাপাচারে বাধা না দেয়ার কারণে পাপীরা পাপের সীমা ছাড়িয়ে গেছে।
৬. দূর থেকে কুমন্ত্রণা দেয়া : মহানবী সা: বলেছেন, ‘প্রত্যেক অন্তরে দু’টি গৃহ আছে। একটিতে ফেরেশতা, অপরটিতে শয়তান বাস করে। ফেরেশতা সৎকাজে এবং শয়তান অসৎকাজে ব্যক্তিকে উদ্বুদ্ধ করে। ব্যক্তি যখন আল্লাহর জিকির করে, তখন শয়তান পেছনে সরে যায় এবং যখন জিকিরে থাকে না, তখন তার চক্ষু মানুষের অন্তরে স্থাপন করে কুমন্ত্রণা দিতে থাকে।’ (মাজহারি) রমজান মাসে শয়তান বন্দী থাকলেও দূর থেকে সে তার কর্যক্রম চালিয়ে যায়।
৭. মানুষ শয়তান বন্দী নয় : আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘বলুন, আমি আশ্রয় গ্রহণ করছি মানুষের পালনকর্তার। মানুষের অধিপতির। মানুষের মাবুদের। তার অনিষ্ট থেকে, যে কুমন্ত্রণা দেয় ও আত্মগোপন করে। যে কুমন্ত্রণা দেয় মানুষের অন্তরে। জিনের মধ্য থেকে এবং মানুষের মধ্য থেকে।’ (সূরা নাস : ১-৬) মানুষ শয়তান প্রকাশ্যে এবং জিন আড়ালে থেকে কুমন্ত্রণা দেয় এবং পাপকার্যে উদ্বুদ্ধ করে।
৮. অভ্যাস তাড়াতাড়ি পরিবর্তন হয় না : কোনো ব্যক্তি যদি কোনো কাজের ১১ মাস প্রশিক্ষণ নেয়, সে প্রশিক্ষণ ছাড়াও এক মাস চলতে পারে। শয়তান যখন ১১ মাস কাউকে মন্দ কাজে ব্যস্ত রাখে, তখন এক মাস দূরে থাকলেও ব্যক্তির মন্দ কাজ করতে সমস্যা হয় না। কারণ অভ্যাস তাড়াতাড়ি পরিবর্তন হয় না।
প্রধান ফকিহ আল-জামিয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসা, ফেনী