দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতির কারণে পুষ্টি ঘাটতি আরো বাড়ার আশঙ্কা দেয়া দিয়েছে। গত দুই বছরে সয়াবিন মিলের দাম ৮৮ শতাংশ এবং অন্যান্য কাঁচামালের দর বেড়েছে ১২৩ শতাংশ পর্যন্ত। এর প্রভাবে এরই মধ্যে কিছু ফিড কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে অন্যান্য কারখানার টিকে থাকার চ্যালেঞ্জ আরো কঠিন করে তুলবে বলে আশঙ্কা ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের (এফআইএবি)। ফিড মালিকরা বলছেনÍ উচ্চমূল্যের কাঁচামাল কিনে ফিড উৎপাদন করে তা যথাযথ দাম পাচ্ছেন না তারা। অনেক ফিড মিলই এখন বন্ধ হয়ে পড়ছে কাঁচামাল সংকটে। অপরদিকে, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাছ ও প্রাণিজ খাদ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে না এলে ডিম, দুধ, মাছ ও মাংসের ঘাটতি দেখা দেবে। ফলে হুমকির মুখে পড়বে স্বাস্থ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা। দেখা দিতে পারে পুষ্টি ঘাটতি। দেড় মাস পরই কোরবানি ঈদ। সেসময় গরুর চাহিদা বেড়ে যায় বেশ কয়েকগুণ, আর এই কোরবানি ঈদকে কেন্দ্র করে অনেকেই গরু পালন করেন। তবে এবার খাদ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় নতুন করে কেউ তো গরু পালন করছেন না, বরং অনেকে পোষাতে না পেরে বিক্রি করে দিচ্ছেন গরু। এতে এবার কোরবানিতে গরুর সংকটসহ দাম বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।
দেশে নিত্যপণ্যের বাজার অস্থিতিশীল বহুদিন ধরে। সেইসঙ্গে সংকট দেখা দিয়েছে মৎস্য ও প্রাণিজ খাদ্য নিয়ে। গত দুই বছরে মৎস্য ও প্রাণিজ খাদ্য তৈরির উপাদানের দাম ৮০ থেকে ১০০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। এদিকে, লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে পোলট্রি, মাছ ও গবাদি পশুর খাদ্য তৈরিতে ব্যবহূত কাঁচামালের দাম। এর প্রভাব পড়ছে ফিডের দামের ওপর। হুহু করে বাড়ছে ফিডের দাম। বেশি দাম দিয়ে ফিড কিনে পোষাতে পারছেন না খামারিরা, ছোট ও মধ্যম সারির খামারিরা পড়েছেন মহাবিপাকে। এতে প্রতিনিয়ত লাভের মুখ তো দেখছেন না বরং গুনতে হচ্ছে লোকসান। সেই লোকসানের বোঝা মাথায় নিয়ে অনেক উদ্যোক্তাই খামার বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ফিডের দাম বৃদ্ধির কারণে মাছ, দুধ, গোশতের দাম বেড়ে যাওয়ায় ভুগছেন ভোক্তারা।
বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব শাহ এমরান বলেন, কোরবানির গরু পর্যাপ্ত আছে। সমস্যা হলো খাদ্যের দাম বেশি। গত এক বছরে পশুখাদ্যের দাম ৫০ শতাংশের ওপরে বেড়ে গেছে। খাদ্যের উচ্চমূল্যের প্রভাব তো কোরবানির পশুর বাজারে অবশ্যই আসবে। দাম তো কিছুটা বাড়তি হবেই। কোরবানির পশুর চাহিদা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যেহেতু পশুখাদ্যের উচ্চমূল্য, যে হারে পণ্যের দাম বেড়েছে মানুষের আয় সেভাবে বাড়েনি। তাই আমার মনে হয়, এ বছর গত বছরের চাইতে অন্তত ১৫-২০ শতাংশ কম কোরবানি হবে। বাজারে ঘুরে জানা গেছে, গমের ছাল প্রতি বস্তা (৩৫ কেজি) ১৯০০ টাকা। সরিষার খৈল প্রতি কেজি ৫৫, ছোলার ভুষি ৫৫, খেসারি ৫৬- ৫৭ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। গত ১৫ দিনের ব্যবধানে সব গোখাদ্যের দাম প্রতি মণে অন্তত দুশ’ টাকা বেড়েছে।
চাষিরা জানান, ছয় মাস আগে এক বস্তা ভালোমানের গমের ছাল বিক্রি হয়েছে ১২০০-১২৫০ টাকায়। যা এক বছর আগে ছিল ৯৫০-১০০০ টাকা। একইভাবে ছয় মাস আগে মাষকলাইয়ের ভুষির বস্তা বিক্রি হয়েছে ১৪০০-১৪৫০ টাকায়। এক বছর আগে ছিল ১১০০-১২০০ টাকা। এক বছর আগে এক বস্তা খৈল বিক্রি হয়েছে ২৫০০-২৬০০ টাকায়। এখন দাম বেড়ে হয়েছে ৩৩শ’-৩৪শ’ টাকা। ছয় মাস আগে ডালের ভুষির বস্তা (৩৫ কেজি) ছিল ১২শ’ টাকা, অ্যাংকর ডালের ভুষি ৮শ’ টাকা মণ দরে বিক্রি হয়েছে। এরপরও ধীরে ধীরে গোখাদ্যের দাম বাড়ছিল। কিন্তু গত ১৫ দিনে দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। গোখাদ্যের সংকটের কারণে স্থানীয় খড় ব্যবসায়ীরা বোরো ধানের খড় রাজশাহী, যশোর, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহসহ দেশের উঁচু এলাকার জেলাগুলো থেকে কিনে সড়ক ও নৌপথে এনে খড়ের আড়তদার, কৃষক ও খামারিদের কাছে বেশি দামে বিক্রি করছেন। বর্তমানে এ অঞ্চলে প্রতি মণ বোরো ধানের খড় প্রায় ৬শ’ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
উদ্যোক্তারা জানান, কাঁচামালের দাম বাড়াতে কারসাজি করছেন কিছু ব্যবসায়ী ও আমদানিকারক। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে মৎস্য ও প্রাণিজ খাতের সঙ্গে জড়িত দুই কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকা হুমকিতে পড়বে। দেশে বর্তমানে ফিডের উৎপাদন বছরে ৭৫ থেকে ৮০ লাখ টন। দেশীয় ফিড ইন্ডাস্ট্রি শতভাগ দেশীয় চাহিদা পূরণ করছে। দেশে নিবন্ধিত ফিড মিলের সংখ্যা ২৮১টি এবং অনিবন্ধিত মিলে মোট সংখ্যা ৪০০টি। এসব ইন্ডাস্ট্রিতে বিনিয়োগের পরিমাণ ২৫ থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা।
এফআইএবির সাধারণ সম্পাদক মো. আহসানুজ্জামান বলেন, ফিড তৈরিতে ৮০ শতাংশ খরচ হয় কাঁচামাল কেনায়। ২০২০ সালের মার্চে ভুট্টার দাম ছিল প্রতি কেজি ২৪ টাকা, চলতি মাসে তা বেড়ে হয়েছে ৩৭ টাকা। ৩৭ টাকার সয়াবিন মিলের দাম এখন ৭০ টাকা। ৩৮ টাকার ফুল ফ্যাট সয়াবিনের দাম এখন প্রায় ৬৭ টাকা। ২১ টাকার রাইস পলিস কিনতে হচ্ছে ৩৬ টাকায়। ১৩৩ টাকার এল-লাইসিন ২০০ টাকা, ২০০ টাকার ডিএলএম ৩০০ টাকায়, ৫৪ টাকার পোলট্রি মিল ৮০ টাকায় এবং ১০০ টাকার ফিস মিল ১৪৬ টাকায় কিনতে হচ্ছে। ফিড তৈরিতে ৫০ থেকে ৫৫ শতাংশ ভুট্টা এবং ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ সয়াবিন মিলের দরকার হয়। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে সয়াবিন মিলের দর ৩০ শতাংশ এবং ভুট্টার দাম ১৮ শতাংশ বেড়েছে।
আহসানুজ্জামান বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে সয়াবিন তেলের দাম নিয়ন্ত্রণে ভোজ্যতেল কোম্পানি ও সিড ক্র্যাশারদের যখন চাপ দেয়া হচ্ছে, তখন তারা তেলের দাম কিছুটা কমিয়ে সয়াবিন খৈল বা সয়াবিন মিলের দাম অস্বাভাবিক বাড়িয়ে দিয়েছে। গত বছরের আগস্টে সয়াবিন মিলের দাম ছিল প্রতি কেজি ৫৪ টাকা চলতি বছরে তা করা হয় ৬০ টাকা। গত ১৬ মার্চে ডিও মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৭০ টাকায় অথচ ভোজ্যতেল আমদানিতে সরকার ১০ শতাংশ ভ্যাট ছাড় দিয়েছে। দেশের বাজারে সয়াবিন মিলের দাম যে পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে, তা আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়েও অনেক বেশি। কয়েকটি সিড ক্র্যাশিং কোম্পানির কাছে পোলট্রি, মাছ ও ডেইরি খাত জিম্মি হয়ে পড়েছে অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে সরকারের বিশেষ নজরদারির দাবি জানান তিনি।
প্রাণিসম্পদ একাধিক কর্মকর্তা জানান, পাবনায় কাঁচা ঘাসের প্রাচুর্য রয়েছে। এজন্য সংকট প্রকট আকার ধারণ করবে না। চাষিদের দানাদার খাদ্যের চেয়ে এখন কাঁচা ঘাস খাওয়ানোর পরামর্শ দেন তিনি। কচুরিপানা গবাদি পশুর আদর্শ খাবার নয়। গবাদি পশুর খাদ্য সংকটের কারণে অনেকে কচুরিপানা খাওয়ান। তবে গবাদি পশুকে মাত্রাতিরিক্ত কচুরিপানা খাওয়ালে পাতলা পায়খানা বা বদ হজম হতে পারে। দুধের ফ্যাট কমে যাবে। গরু বা মহিষ নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।