বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম আবারো ঊর্ধ্বমুখী। এক মাসের ব্যবধানে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি গড়ে প্রায় ১৬ ডলার বেড়েছে। এ অবস্থায় দেশের বাজারে ডিজেল-অকটেন বিক্রিতে লোকসান গুনতে হিমশিম খাচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। বর্তমানে এ দুটি পণ্য বিক্রিতে দৈনিক লোকসান ১০৭ কোটি টাকায় ঠেকেছে। এ অবস্থায় আবারো জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে বলে জ্বালানি বিভাগ-সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গিয়েছে।
বিপিসি সূত্র জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত ও পরিশোধিত তেলের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম বর্তমানে ১২১-১২৫ ডলারে ওঠানামা করছে। এ পরিস্থিতিতে কেবল ডিজেল-অকটেন বিক্রিতেই লিটারপ্রতি দৈনিক ৯৭ টাকা লোকসান করছে বিপিসি। সব মিলিয়ে দেশের জ্বালানি তেল বিক্রিতে সংস্থাটির দৈনিক লোকসানের পরিমাণ ১০৭ কোটি টাকার বেশি। দেশের বাজারে জ্বালানি তেলের দামে সমন্বয় করা না হলে অব্যাহত এ লোকসান পরিস্থিতি সামাল দেয়া কঠিন হবে মনে করছেন বিপিসি সংশ্লিষ্টরা। সংস্থাটির চেয়ারম্যান এবিএম আজাদ বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে যে হারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ছে তাতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক পর্যায়ে নেই। আমরা প্রতি মুহূর্তের পরিস্থিতি জ্বালানি বিভাগকে জানাচ্ছি। পরিস্থিতির পরিবর্তন না হলে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়ের কোনো বিকল্প আমাদের হাতে থাকবে না। এ লোকসান দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকলে বিপিসির উন্নয়ন প্রকল্পেও তার প্রভাব পড়বে।
জ্বালানির বাজার বিশ্লেষণকারী সংবাদমাধ্যম অয়েল প্রাইস ডটকমের তথ্যানুযায়ী, আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের মার্কিন বাজার আদর্শ ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েটের (ডব্লিউটিআই) দাম ব্যারেলপ্রতি ১২১-১২২ ডলারে ওঠানামা করছে। অথচ গত ১৮ মে ব্যারেলপ্রতি পণ্যটির দাম ছিল ১০৭ ডলারের কিছু বেশি। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজার আদর্শ ব্রেন্টের দাম গতকাল পর্যন্ত ১২৪-১২৫ ডলারে ওঠানামা করেছে। এক মাস আগের একই সময়ে পণ্যটি ব্যারেলপ্রতি ১০৯ ডলারের কিছু বেশিতে বিক্রি হয়েছে। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে ব্যারেলপ্রতি পণ্য দুটিতে ১৫-১৭ ডলার পর্যন্ত বেড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে তেলের বাজারে এ অস্থিরতা চলছে। যুদ্ধ চলতে থাকলে জ্বালানির বাজার আরো খারাপের দিকে যেতে পারে। এতে আমদানিকারক দেশগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। একই সঙ্গে বৈশ্বিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে দেশের বাজারে দাম সমন্বয় করা হলে তা হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। কারণ এরই মধ্যে এক দফা ডিজেল-কেরোসিনের দাম বাড়ানোয় নিত্যপণ্যের বাজারে তার মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। জনজীবনে এখনো সেই অস্থিরতার রেশ কাটেনি।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি এখন বৈশ্বিক বাস্তবতা। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে জ্বালানির দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গিয়েছে। মূলত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধই এর পেছনে দায়ী। তবে এ কারণে দেশের বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা অযৌক্তিক। কারণ কিছুদিন আগেই লিটারপ্রতি ১৫ টাকা করে বাড়ানো হয়েছে। এখন আরেক দফা বাড়ালে তা জনজীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। এর চেয়ে বরং সরকার নিত্যপণ্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ছাড় দিতে পারে। তাতে বাজার স্বাভাবিক রাখা যাবে।
কভিড মহামারীর মধ্যে গত বছরের জুনে জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে শুরু করে। ব্যারেলপ্রতি ৬০ ডলারের নিচে থাকা অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ওই সময় ৭০ ডলারে ওঠে। এরপর ওই বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বরে জ্বালানি তেলের দাম কিছুটা নি¤œমুখী হয়। যদিও ডিজেল-অকটেন বিক্রিতে লোকসান হচ্ছে উল্লেখ করে নভেম্বরের শুরুতে পণ্য দুটির দাম লিটারপ্রতি ১৫ টাকা বাড়িয়ে ৮০ টাকা করে জ্বালানি বিভাগ। পরবর্তী সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দামামা বাজলে জ্বালানি তেলের বাজারও অস্থির হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে চলতি বছরের মার্চে ব্যারেলপ্রতি অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ১০০ ডলার ছাড়িয়ে যায়। গত এপ্রিলে তা ১২৪ ডলারে পৌঁছে।
চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যেই চলতি বছরের এপ্রিলের শেষে এবং মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত জ্বালানি তেলের বাজার নি¤œমুখী হতে থাকে। একপর্যায়ে তা ১০৭ ডলারেও নামে। তবে মে মাসের শেষ সপ্তাহের দিক থেকে বাজার আবারো অস্থির হয়ে ওঠে। সে অস্থিরতা এখনো অব্যাহত। এ অবস্থার মধ্যেই গত নভেম্বর থেকে দেশের বাজারে ৮০ টাকা লিটার দামে ডিজেল বিক্রি করে আসছে বিপিসি। বিশ্ববাজারে দাম বাড়লে এরপর আর দাম বাড়ানো হয়নি। কিন্তু এখন মূল্যবৃদ্ধির এ চাপ বিপিসি আর সামাল দিতে পারছে না বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির কর্মকর্তারা।
বিপিসির বিপণন বিভাগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, বিশ্ববাজারে যদি জ্বালানি তেলের দাম ৯৩-৯৫ ডলারের মধ্যে থাকে তখন ৮০ টাকা লিটারে ডিজেল-কেরোসিন বিক্রি করলে বিপিসি ব্রেক ইভেনে থাকে। অর্থাৎ লাভ বা লোকসান কোনোটিই হয় না। কিন্তু এরপর যদি বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যায় তাহলে ৮০ টাকায় বিক্রি করলে বিপিসিকে লোকসান গুনতে হয়। বর্তমানে বিশ্ববাজারে তেলের দাম ১২১-১২৫ ডলারের মধ্যে রয়েছে। সে হিসেবে বিপিসিও লোকসান গুনছে।
জ্বালানি তেল বিক্রিতে বিপিসির লোকসানের বোঝা ভারী হওয়ার কথা জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদও। গতকাল এক ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিপিসির দৈনিক লোকসান শতকোটি টাকা ছাড়িয়েছে। বৈশ্বিকভাবে জ্বালানি তেলের যে মূল্যবৃদ্ধি, তা অস্বাভাবিক। এটি আসলে কতদিন চলবে সেটার কোনো নিশ্চয়তা নেই। বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণে দেশের বাজারে জ্বালানি তেলের দাম পরিবর্তন হবে কিনা তা এখনো ঠিক হয়নি। কোথায় সমন্বয় করা হবে বা আদৌ করা হবে কিনা তা নিয়ে আমরা কাজ করছি। জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়ের ফলে পরিবহন খাতের ওপর যেন চাপ না পড়ে সে বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করছে সরকার। প্রসঙ্গত, দেশে বর্তমানে ডিজেল লিটারপ্রতি ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া অকটেন বিক্রি হচ্ছে ৮৯ টাকায়। এ দুটি পণ্যই আমদানিনির্ভর। দেশে প্রতিদিন বিভিন্ন ধরনের অন্তত ১৭ হাজার টন জ্বালানি তেলের চাহিদা রয়েছে, যার মধ্যে ৭৩ শতাংশ ডিজেল। বাকি পেট্রল, অকটেন, জেট ফুয়েল ও বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি।