ইউরোপে ধর্মের সাথে বিজ্ঞানী ও দার্শনিকদের অব্যাহত দ্বন্দ্বের মধ্যে আইজ্যাক নিউটন ছিলেন এক সমন্বয়ী দৃষ্টান্ত। তিনি ছিলেন পদার্থবিজ্ঞানী, গণিতবিদ, জ্যোতিবিজ্ঞানী, প্রাকৃতিক দার্শনিক এবং আলকেমিস্ট। সমান মাত্রায় ছিলেন ধর্মবেত্তা, স্রষ্টাতত্ত্ববিদ, বাইবেলবিশেষজ্ঞ।
ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের একটি অধ্যাপকের পদ হলো লুকাসিয়ান প্রফেসর। সম্মানজনক এ পদ প্রবর্তিত হয় ১৬৬৩ সালে, হেনরি লুকাস এর প্রবর্তক। লুকাসিয়ান অধ্যাপকদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল গির্জার সাথে সম্পর্ক। কারণ এ সম্পর্ক বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য অসুবিধাজনক হতে পারে। আবার ক্যামব্রিজের ফেলো হতে চাইলে অবশ্যই এংলিকান চার্চের সাথে সংযুক্ত থাকতে হতো। খ্রিষ্টধর্মের এংলিকান ধারার প্রচারক হতে হতো। অক্সফোর্ডেও ছিল একই নিয়ম। ক্যামব্রিজের প্রথম লুকাসিয় অধ্যাপক আইজ্যাক ব্যারোর (১৬৩০-১৬৭৭) পরে তারই পরামর্শে আইজ্যাক নিউটনকে সে পদের জন্য প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু নিউটন বিজ্ঞান চর্চার জন্য চার্চের সাথে সম্পর্ক ত্যাগে রাজি ছিলেন না। তিনি পদটি গ্রহণে সম্মত হন শর্তসাপেক্ষে। তার শর্ত ছিল, ধর্মচর্চায় বাধা তুলে নিতে হবে। তখনকার রাজা দ্বিতীয় চার্লস নিউটনের শর্ত মেনে নেন। ১৬৬৯ সালে গণিত ও পদার্থের লুকাসিয় অধ্যাপক মনোনীত হন নিউটন। বিজ্ঞান চর্চা তার ধর্মীয় সাধনার সমান্তরালে এগিয়েছে, যেমনটি ঘটেছিল আল বিরুনি, ইবনে খালদুন, ইবনে তুফায়েল, ইবনে রুশদ কিংবা টমাস একুইনাসের জীবনে। তাদের উচ্চতর বিজ্ঞানচর্চা গভীর ও একাগ্র ধর্মচর্চায় ব্যাঘাত ঘটাতে পারেনি। নিউটন প্রতিদিন নিয়মিত বাইবেল অধ্যয়ন করতেন এবং চার্চের আদি পিতারা ছিলেন তার অন্যতম অনুপ্রেরণা। এমনকি বিজ্ঞানের চেয়ে তিনি ধর্মগ্রন্থ ও আলকেমি অধ্যয়নে অধিক সময় ব্যয় করতেন। তার মতে, ধর্ম ও বিজ্ঞান নিয়ে তার করা পরীক্ষণগুলো একই। কারণ উভয়েরই লক্ষ্য মহাবিশ্ব কিভাবে ক্রিয়া করছে তা পর্যবেক্ষণ ও বোঝার চেষ্টা।
ধর্মতত্ত্ব তার মনোযোগের কেন্দ্রে ছিল জীবনের প্রথম থেকেই। ধর্ম যেসব ভবিষ্যদ্বাণী শোনায়, তা নিয়ে নিউটন গভীর পড়াশোনা শুরু করেন যৌবনে। ট্রিনিটির প্রশ্নে তার গুরুভার ভাবনার নজির রয়েছে নানা লেখনীতে। তিনি বাইবেলের সমালোচনা লিখেন, করেন ভাষ্যরচনা ও টীকাটিপ্পনীর কাজও। খ্রিষ্টধর্মে তার পাণ্ডিত্য ও চিন্তার গভীরতা নির্দেশ করে Observations on the Prophecies of Daniel and the Apocalypse শীর্ষক পাণ্ডুলিপি। বস্তুত বিজ্ঞানের চেয়ে জীবদ্দশায় তিনি বেশি লিখেছেন ধর্ম নিয়ে। তার মনে হতো, যদি অমরত্ব তিনি পান, তাহলে পাবেন ধর্মতাত্ত্বিক লেখার কারণেই। কিন্তু ঘটল উল্টোটিই। তিনি বিশ্বব্যাপী বরিত হলেন গণিত ও বৈজ্ঞানিক রচনার কল্যাণে। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারে সর্বকালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনাগুলোর একটি নিউটনের প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকা, যাতে তিনি সর্বজনীন মহাকর্ষ এবং গতির তিনটি সূত্র বিধৃত করেছিলেন। এই সূত্র ও মৌল নীতিগুলোই চিরায়ত বলবিজ্ঞানের বুনিয়াদ রচনা করল, যা বিখ্যাত হলো নিউটনীয় বলবিজ্ঞান নামে, আর পরবর্তী তিন শতাব্দী ধরে বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার জগতে প্রতিষ্ঠিত থাকল তার একক আধিপত্য।
গ্রন্থটি ব্যাখ্যা করল গ্রহ-নক্ষত্রগুলোর মধ্যে মহাকর্ষ বলের সূত্র ও মহাবিশ্বের গতির গাণিতিক অবকাঠামো। আমরা দেখলাম পৃথিবী ও মহাবিশ্বের সব বস্তু একই প্রাকৃতিক নিয়মের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে। এর ফলে সৌরকেন্দ্রিক বিশ্বের ধারণার পেছনে ন্যূনতম সন্দেহের অবকাশটুকুও দূরীভূত হয়ে গেল এবং বৈজ্ঞানিক বিপ্লব ত্বরান্বিত হলো।
নিউটনের এ জার্নি মোটেও সহজ ছিল না। ১৬৪২ সালের ২৫ ডিসেম্বর ইংল্যান্ডের লিংকনশায়ার থেকে সাত মাইল দক্ষিণে কোলসটারওয়ার্থ গ্রামের ‘উলসথপর্ ’ নামের ফার্ম হাউজে যখন তার জন্ম হয়, তখনো ব্রিটেনে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার চালু হয়নি। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী তার জন্মতারিখ ৪ জানুয়ারি ১৬৪৩। তার বাবা-দাদা ছিলেন নিরক্ষর। কঠোর পরিশ্রম করে তারা জমিজমা, ফার্ম আর বিরাট বাড়ির মালিক হন। বাবার নামও ছিল আইজ্যাক নিউটন। ১৬৪২ সালের শুরুর দিকে অভিজাত পরিবারের হ্যানা আয়াসকফের সাথে তার বিয়ে হয়। বিয়ের ছয়-সাত মাস যেতেই মৃত্যু হয় নিউটনের। হ্যানা তখন সন্তানসম্ভবা। সন্তানটি পরে যখন জন্ম নিলো, বাবার নামে মা তার নাম রাখলেন আইজ্যাক নিউটন। শিশুটির জন্ম হয় সময় হওয়ার আগেই।
ভীষণ রোগা, ওজন খুবই কম, মরণাপন্ন এক সন্তান। মা তাকে লালন-পালনের আপ্রাণ প্রয়াসে জয়ী হলেন। সন্তান পালন, বিরাট ফার্মের দেখাশোনা সহজ নয়, দরকার অভিভাবক; অতএব ১৬৪৫ সালে হ্যানা ৬৩ বছর বয়সী প্রভাবশালী রেভারেন্ড বারনাবাস স্মিথকে বিয়ে করে নর্থ উইথামে চলে যান। প্রতিকূলতা মাড়িয়ে বড় হতে হয় নিউটনকে। পড়ালেখা শুরু হয় ১২ বছর বয়সে। কোনো বন্ধু পাননি, থাকতে হতো একা। সৎবাবার প্রতি আক্রোশ তার মেজাজ করে তোলে খিটখিটে। ১৬৫৬ সালে মারা গেলেন সেই সৎবাবা। দুই কন্যা ও এক পুত্রসন্তান রেখে যান তিনি। তার ছিল প্রচুর সম্পত্তি। নিউটনের মা সেগুলোরও মালিক হলেন। কিন্তু কে করবে এসবের দেখভাল? ১৬৫৮ সালে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নিউটনকে ফার্মে নিয়ে আসেন তিনি। এখানে এসে নিউটন হলেন আরো বদরাগী। কোনো কাজই করতেন না। অবশেষে আবারো স্কুলে ফেরানো হলো। ১৬৬১ সালে ১৯ বছর বয়সে ক্যামব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে ভর্তি হলেও মেধার পরিচয় দিতে পারেননি নিউটন। সিনিয়র ছাত্রদের ফুট-ফরমাশে কাজ করতেন, বিনিময়ে পেতেন কিছু টাকা। ভালো রেজাল্ট করে স্কলারশিপ লাভের চেষ্টার বদলে যন্ত্রপাতি নিয়ে মগ্নতা আর ইচ্ছেমতো পড়াশোনায় সময় পার করছিলেন। পরীক্ষায় জ্যামিতিতে ফেল করলেন।
১৬৬৫ সালে ইংল্যান্ডে বুবোনিক প্লেগের প্রাদুর্ভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে দুই বছর। একান্ত নির্জন জীবনে নিউটন কাজ করেন গ্যালিলিউ ও ক্যাপলারের ওপর, আবিষ্কার করেন নিজের বিস্ময়কর কিছু সূত্র- ক্যালকুলাস, আলোর প্রকৃতি, মহাকর্ষ সূত্র। ২২ বছর ধরে এসব আবিষ্কার লোকের অগোচরে থেকে যায়। ১৬৮৭ সালে প্রিন্সিপিয়া প্রকাশিত হলো, পৃথিবী জানল নিউটন চিরতরে বদলে দিয়েছেন পদার্থবিজ্ঞান চর্চার চিত্র, আয়তন।
ক্যামব্রিজ তাকে যখন আপন অবয়বে আবিষ্কার করল, বরণ করল লুকাসিয়ান অধ্যাপক হিসেবে। সেখানে তিনি প্রথম লেকচারটি দেন ১৬৭০ সালের জানুয়ারিতে। প্রথম লেকচারে মাত্র কয়েকজন ছাত্র থাকলেও দ্বিতীয় লেকচারে কেউই থাকেনি, এরপর থেকে ১৭ বছর ধরে নিউটন লুকাসিয়ান লেকচার দিয়েছেন খালি থিয়েটারে। তিনি প্রধানত আলোচনা করতেন আলোকবিদ্যার ওপর। যা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় অনেক পরে, ১৭০৪ সালে।
স্বীকৃতি ও জনপ্রিয়তা এসেছে তার জীবনে। রিফ্লেক্টিং টেলিস্কোপ তৈরি, ক্যালকুলাস আবিষ্কার, পরীক্ষণ পদার্থ বিজ্ঞানে কৃতিত্ব, রয়্যাল সোসাইটির ফেলোশিপ, আলোর কণাতত্ত্ব আবিষ্কার, ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি হিসেবে ব্রিটেনে পার্লামেন্টের সদস্যপদ, ইংল্যান্ডের জাতীয় টাকশাল রয়্যাল মিন্টের মাস্টার অব দ্য মিন্ট পদ, রয়্যাল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট পদ ও প্রথম বিজ্ঞানী হিসেবে নাইটহুড খেতাব লাভ নিউটনের অর্জনের ডানার কিছু পালক। অন্যদিকে, জীবনে কেউ তাকে হাসতে দেখেনি, বিয়ে করেননি, ছিল না সংসার, নারীদের প্রতি ছিল নেতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি, ক্রিশ্চিয়ান হাইগেনস, রবার্ট হুক, লিবনিজ, জন ফ্ল্যামস্টিডসহ অনেকের সাথে তিক্ত ঝগড়ায় জড়ানো, সমালোচনা সহ্য করতে না পারা, প্রতিপক্ষের নাম-নিশানা মুছে ফেলার জেদ ও প্রয়াস, অন্যায্য প্রভাব খাটানো, নিজে নিজের প্রশংসায় অন্যের নামে প্রপাগা-া চালানো, লিবনিজের মৃত্যুতে আনন্দ প্রকাশ ইত্যাদি জড়িয়ে আছে নিউটনের ব্যক্তিত্বের সাথে। শেষ জীবনে মানসিক ভারসাম্য হারান নিউটন। ১৭২৭ সালের ২০ মার্চ মৃত্যু হয় তার। বয়স তখন ৮৪ বছর। রাজকীয় সম্মান নিয়ে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে হন সমাহিত। মৃত্যুর পর তার উজ্জ্বলতা ও আবেদন বেড়েছে ক্রমাগত। কিন্তু তার আবেদনের অন্যতম দিকটি আলোচনার আলোয় এসেছে খুব কম। সেটি হলো- ধর্মীয় প্রশ্নে তার গবেষণা ও অন্তর্দৃষ্টি।
নিউটন বলেছিলেন, বিজ্ঞান ও ধর্মের প্রিস্কা স্যাপিয়েন্টিয়া বা আদি জ্ঞান উদ্ধার করতে হবে। যাকে গ্রহণ করেছিল রেনেসাঁ। কিন্তু ধর্মের প্রশ্নে তা বিকৃতিকে অবলম্বন করেই অগ্রসর হয়। নিউটন বলেছিলেন ধর্মের সেই আদিসত্যকে পুনরুদ্ধার করতে, সময়ের বিবর্তনে যা বিকৃত ও অস্পষ্ট হয়ে পড়েছে। তিনি যুক্তিসম্মতভাবে একটি চিরন্তন বিশ্বের ধারণা পোষণ করতেন। মধ্যস্থতাকারী ঈশ্বরের ধারণা পরিত্যাগ করে নিউটন একত্ববাদের সমর্থক হয়ে ওঠেন। এমন একটি মহাবিশ্বের ধারণার তিনি পুনর্জীবন দান করেছিলেন, যা একজন ঈশ্বরের সুনিপুণ হাতে নির্মিত এবং যুক্তিসঙ্গত ও সর্বজনীন মৌল নীতির মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছে যার মহাজাগতিক নকশা।
নিউটন ঈশ্বরকে এমন এক মহান স্রষ্টা হিসেবে দেখেছেন, পুরো সৃষ্টিজগতের এই বিশালতার মুখেও যার অস্তিত্ব অস্বীকার করা যায় না। ধর্মের যে আদিজ্ঞান নিউটন পুনরুজ্জীবিত করতে চান, সেখানে ঈশ্বর এক, একক, শরিকবিহীন। ঈশ্বরের অস্তিত্ব পুরো সৃষ্টিজগতের বিশালতার চেয়েও মহান। তিনি দেখান, পৃথিবী ও মহাবিশ্বের সব বস্তু একই প্রাকৃতিক নিয়মের অধীনে পরিচালিত। মানে সব কিছু নিয়মে বন্দী, এমনকি স্বয়ং ঈশ্বরও নিজের নিয়মে চালিত। তার ঈশ্বর চিরন্তন। সর্বত্র বিরাজমান, সর্বজ্ঞানী, সর্বশক্তিমান এবং আসমান ও জমিনের স্রষ্টা। তিনি অদৃশ্য, কোনো দৃষ্টি তাকে দেখে না, অথবা দেখতে পারে না। তিনি ছাড়া অন্য যা কিছু আছে তা দৃশ্যমান হয়। তিনি নিজেই নিজের মধ্যে জীবন্ত এবং নিজ থেকেই তিনি দান করেন সবার জীবন। তিনি সর্বজ্ঞানী। তাঁর সত্তায় রয়েছে সব জ্ঞান। তিনি অবিচল। কোনো স্থানই তাঁর অনুপস্থিতিতে শূন্য বা উপস্থিতিতে পূর্ণ হয়ে উঠতে সক্ষম নয়। তাঁর উপস্থিতিই হলো প্রকৃতির অনন্ত অপরিহার্যতা। উপাসনা কেবলই তার প্রতি নিবেদিত হবে। এটিই চিরন্তন সত্য। আমাদের জীবনে যা কিছু প্রাপ্তি, যা নিয়ে আমরা ‘আমরা’, যা আমাদের বাঁচতে সাহায্য করে, সব কিছুর জন্য কেবলই কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত তারই প্রতি। তার গুণাবলি অন্য কারো ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। না যিশুখ্রিষ্টের প্রতি, না তাঁর মায়ের প্রতি। ট্রিনিটি বা ত্রিত্ববাদে বিশ্বাসী ছিলেন না তিনি। জীবদ্দশায় তিনি রাষ্ট্র ও শক্তিমান চার্চের সাথে দ্বন্দ্ব এড়িয়েছেন। নিজের ধর্মীয় বিশ্বাস প্রকাশ্যে ব্যক্ত করা বুদ্ধিমানের কাজ মনে করেননি। তার সময়ে খ্রিষ্টধর্মকে বিব্রত করে, এমন প্রতিটি উচ্চারণের বিরুদ্ধে প্রচ- প্রতিক্রিয়া আসতো চারদিক থেকে। রাষ্ট্র ও গির্জা পরিচালনা করত জুডিকাম ডেই বা ঈশ্বরের বিচার, যেখানে ধর্মের বক্তব্যের বিরোধিতাকারীদের দেয়া হতো মরণদ-। অভিযুক্তদের হত্যা করা হতো হয় আগুনে পুড়িয়ে, নয় পানিতে ডুবিয়ে। এরকম বাস্তবতায় বাইবেলের নানা অসঙ্গতি তার জাগ্রত দৃষ্টিতে ধরা পড়ে। বাইবেল প্রশ্নে তার রচনাপ্রাচুর্য রয়েছে, সেগুলোতে রয়েছে সমালোচনার বিদ্যুৎপ্রহার!
বাইবেলের নানা অসঙ্গতি, পরস্পরবিরোধী তথ্য ও তত্ত্ব নিয়ে তিনি বিষদ অবতারণা করেন An Historical Accounts of Two Notable Corruptions of Scripture গ্রন্থে। গ্রন্থটি রচিত হয় ১৬৯০ সালে। ইংল্যান্ডে যেহেতু এর প্রকাশ বিপজ্জনক, ফলে অনূদিত হয়ে তা ফ্রান্স থেকে প্রকাশিত হোক, সে ভাবনা তার ছিল। অতএব পাণ্ডুলিপিটি ফ্রান্সে পাঠিয়ে দেন নিউটন, জন লকের কাছে। গ্রন্থটির ল্যাটিন অনুবাদ প্রকাশে উদ্যোগী হন জন লক, ১৬৯২ সালে। নিউটনের নামে নয়, অজ্ঞাতনামা লেখকের নামে। কিন্তু এটি যে নিউটনের রচনা, তা প্রকাশিত হবেই, এ আশঙ্কা তাড়া করছিল বিজ্ঞানীকে। জন লককে তাই অনুরোধ করেন নিউটন; বইটি যেন আপাতত না ছাপানো হয়। পরবর্তী পৃথিবী গ্রন্থটিকে পাঠ করেছে নিউটনের নিজস্ব রচনা হিসেবেই। এ গ্রন্থে নিউটন স্পষ্ট উচ্চারণ করেন, ‘যারা বলে ঈশ্বর রক্ত-মাংসের মানুষের মধ্যে প্রকাশিত, তারা কথাটি বলে নিজেদের উদ্দেশ্যের চূড়ান্ত লক্ষ্য হাসিলের জন্যই ।’ ‘দেবতা (Deity) কথাটি অধীনস্থ প্রাণীকুলের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করে। ঈশ্বর (God) কথাটি প্রকাশ করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রভুত্বকে। প্রভুমাত্রই ঈশ্বর নন। ঈশ্বরের প্রকাশ ঘটে এক আধ্যাত্মিক সত্তার মধ্যে প্রাধান্য বিস্তারের মধ্য দিয়ে। যদি এ প্রাধান্য সত্য হয় তাহলে সে সত্তাই প্রকৃত ঈশ্বর। এটি যদি সন্দেহপূর্ণ হয় তবে তা হবে মিথ্যা ঈশ্বর, আর যদি তা সন্দেহাতীত হয়, তবে তিনি হবেন সর্বশক্তিমান ঈশ্বর।’ নিউটন ওল্ড টেস্টামেন্টের প্রতীকী বা দ্বৈত ব্যাখ্যারও বিরোধী ছিলেন। গতির সূত্র এবং সর্বজনীন মহাকর্ষ সূত্র নিউটনের সেরা দুই আবিষ্কার। এর আশ্রয়ে মহাবিশ্বকে নিছক এক যন্ত্র হিসেবে দেখা ও দেখানোর আশঙ্কা রুদ্ধ করেন তিনি নিজেই। বিজ্ঞানে আলোচিত গ্রহের গতির ব্যাখ্যা তো স্পষ্ট। কিন্তু গতির নিয়ন্ত্রক ও ব্যবস্থাপকের অব্যাখ্যাত সত্তার প্রতিও নিউটন দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তার মতে- ‘অভিকর্ষ সূত্র ব্যাখ্যা করে গ্রহসমূহের গতির বিষয়টি, কিন্তু সে ব্যাখ্যা করতে পারে না যে প্রশ্নের, তা হলো- কে গ্রহগুলোকে গতিশীল হিসেবে নির্দিষ্ট স্থানে স্থাপন করে দিলো? ঈশ্বর সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করেন এবং যা কিছু ঘটছে বা যা কিছু ঘটা সম্ভব, সবই আছে তার জ্ঞানে, সবই তিনি জানেন।’ নিউটনের ঈশ্বর তার বিজ্ঞান থেকে বিচ্ছিন্ন নন। তিনি আদিসত্যের ঈশ্বর। যার ডিজাইন এই মহাবিশ্ব, যাকে ব্যাখ্যা করতে নিউটন প্রবুদ্ধ হন ঈশ্বরবিশ্বাসকে সাথে নিয়ে। সেখানে তার কৃতিত্ব বিম্বিত হয়েছে ব্রিটিশ কবি আলেকজান্ডার পোপের কবিতায়। তিনি লিখেন- ‘প্রকৃতি ও প্রকৃতির নিয়ম রাত্রির তলায় ছিল ঢাকা; ঈশ্বর বললেন, নিউটন সৃষ্টি হও! আর এরপরই আলোকিত হলো সব কিছু।’ লেখক : কবি, গবেষক 71.alhafij@gmail.com