পৃথিবীর ঊষালগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত কালের পরিক্রমায় হাজারো মহামানবের আগমন ঘটেছে এ ধরাপৃষ্ঠে। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন হজরত ইবরাহিম আ:। যিনি স্বীয় প্রাণ কলিজার টুকরা হজরত ইসমাঈল আ:-কে কোরবানি করতে উদ্যত হয়েছিলেন। সন্তানও বাবার ছুরির নিচে শিরকে নত করে দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে আজো চির অমর হয়ে আছেন বিশ্ববাসীর কাছে। সে ঘটনাকে কেন্দ্র করে মহান আল্লাহ কোরবানির প্রতীক হিসেবে পশু কোরবানি করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। তাই বিশ্বের কোটি মুসলমান এ বিধানটি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে প্রতি বছর পালন করে থাকে। কোরবানি অর্থ ত্যাগ। শরিয়তের পরিভাষায় কোরবানি বলা হয়, জিলহজ মাসের ১০, ১১ ও ১২ তারিখে আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য নির্দিষ্ট গৃহপালিত পশু আল্লাহর উদ্দেশ্যে জবাই করা। ইসলামে অনেক ধরনের কোরবানি বা ত্যাগের বিধান রয়েছে। আমাদের জীবনে বিভিন্ন ধরনের কোরবানি রয়েছে। এক ধরনের কোরবানি হলো জানের কোরবানি যেমন- নামাজ, রোজা ইত্যাদি বিধান। এগুলো পালন করতে গিয়ে নিজের দেহকে কষ্ট দিতে হয়। আরেক ধরনের কোরবানি হলো মালের কোরবানি যেমন- দান-সাদাকাহ, জাকাত ইত্যাদি।
আরেক ধরনের কোরবানি হলো মনের কোরবানি, অর্থাৎ মনের খায়েশ নিজের প্রবৃত্তি দমন করার কোরবানি। অন্যান্য কোরবানির মতো এটিও একটি বড় কোরবানি। কারণ মানুষের জন্য জান-মাল ব্যয় করা সহজ, অর্থাৎ জান-মালের কোরবানি দেয়া সহজ কিন্তু মনের কোরবানি দেয়া কঠিন। মানুষ অকাতরে নিজের সম্পদ ব্যয় করতে সহজে প্রস্তুত হয়ে যায়, কিন্তু নিজের মনের ধ্যান-ধারণা নিজের মনের বুঝ, নিজের মনের যুক্তি সহজে ছাড়তে প্রস্তুত হয় না। কেননা, ঈদুল আজহার পশু কোরবানির মাধ্যমে মালেরও কোরবানি হয়, একই সাথে মনেরও কোরবানি হয়।
কোরবানির পশু জবাই করতে মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয় হয়, এই অর্থের প্রতি মনের যে ভালোবাসা সেই ভালোবাসাকে কোরবানি করতে হবে। কোরবানি করতে গেলে মনের মধ্যে গোশত খাওয়ার চেতনাটাই মূল হয়ে দাঁড়াতে চাইবে। মনের এই চেতনাকেও কোরবানি করতে হবে। কেননা, মনের কোরবানি না করে শুধু রক্ত-মাংসের পশু কোরবানি দিলে তাতে কোরবানির প্রকৃত উদ্দেশ্য অর্জিত হবে না।
এ বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন, ‘কোরবানির গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, কিন্তু পৌঁছে তাঁর কাছে তোমাদের মনের তাকওয়া তথা নিয়ত। এমনিভাবে তিনি এগুলোকে তোমাদের বশ (আয়ত্ত) করে দিয়েছেন, যাতে তোমরা আল্লাহর মহত্ত্ব ঘোষণা করো এ কারণে যে, তিনি তোমাদের পথ প্রদর্শন করেছেন। সুতরাং সৎকর্মশীলদের সুসংবাদ শুনিয়ে দিন।’ (সূরা হজ-৩৭)
এই কোরবানির বিধান প্রবর্তিত হওয়ার যে মূল ইতিহাস অর্থ্যাৎ হজরত ইবরাহিম আ:-এর পুত্রকে কোরবানি করার ঘটনা। সেখানেও প্রধান লক্ষ্য ছিল হজরত ইবরাহিম আ:-এর মনের কোরবানি। আল্লাহ পাক হজরত ইবরাহিম আ:-কে স্বপ্নের মাধ্যমে আদেশ দিলেন তোমার সবচেয়ে প্রিয় বস্তুকে কোরবানি করে দাও। তখন ইসমাঈল আ:-এর বয়স সাত বছর মতান্তরে ১৩ বছর ছিল। নবীদের স্বপ্ন ওহি, তাই নবীরা যা স্বপ্ন দেখেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই স্বপ্ন অনুযায়ী তিনি পুত্রকে কোরবানি করার জন্য মিনার ময়দানে নিয়ে গেলেন।
পবিত্র কুরআনে এসেছে, ‘অতঃপর সে যখন পিতার সাথে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হলো, তখন ইবরাহিম আ: ইসমাঈলকে বললেন, হে প্রিয় বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি, তোমাকে জবাই করছি; এখন তোমার অভিমত কি বলো, ইসমাঈল আ: বললেন, আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, তাই করুন। আল্লাহ চাহে তো আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন।’ (সূরা সাফফাত-১০২)
তাফসিরে এসেছে, ইসমাঈল স্বীয় পিতাকে বললেন, আমাকে শক্ত করে বাঁধবেন, যাতে আমি নড়াচড়া করতে না পারি। নড়াচড়া করলে আপনার জবাই করতে কষ্ট হবে, আপনার গায়ে রক্ত ছিঁটে গিয়ে লাগবে। আর ছুরিটাকেও ভালোভাবে ধারালো করে নিন, যাতে তাড়াতাড়ি জবাই সেরে ফেলতে পারেন। এভাবে হজরত ইবরাহিম আ: পুত্রকে জবাই করার উদ্যোগ নিলেন। (তাফসিরে মা’আরেফুল কুরআন)
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তারা পিতা পুত্র উভয়ে যখন আল্লাহর হুকুমের আনুগত্য করার জন্য নিজেদের সোপর্দ করল, আর ইবরাহিম স্বীয় পুত্রকে জবাই করার জন্য উপুড় করে শোয়ালো, তখন আমি তাকে ডাক দিয়ে বললাম, হে ইবরাহিম! তোমার স্বপ্নকে তুমি বাস্তবে পরিণত করেছ। এটা ছিল এক মহাপরীক্ষা। এই পরীক্ষায় তুমি উত্তীর্ণ হয়েছ। আল্লাহ বলেন ‘আমি তার পুত্রের বদলে একটি মর্যাদাবান দুম্বা জান্নাত থেকে পাঠিয়ে দিলাম।’ (সূরা সাফফাত : ১০৩-১০৭)
হজরত ইবরাহিম আ: পুত্রের গলায় ছুরি চালিয়ে ছিলেন, কিন্তু পুত্র জবাই হলো না। তার স্থলে একটি দুম্বা জবাই হয়ে গেল। আল্লাহ পাকের উদ্দেশ্য ছিল ইবরাহিম আ:-এর মনের কোরবানি। পুত্রের কোরবানি উদ্দেশ্য ছিল না। কেননা, আল্লাহপাক পুত্র জবাই না হওয়া সত্ত্বেও ইবরাহিম আ:-কে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ঘোষণা করেছেন। যদি পুত্রের কোরবানি হয়ে যাওয়াই আল্লাহর কাছে কাম্য হতো, তাহলে পুত্রই কোরবানি হয়ে যেত। আল্লাহর কাছে কাম্য ছিল ইবরাহিম আ:-এর মনের কোরবানি।
হজরত ইবরাহিম আ:-এর শিক্ষাকে অব্যাহত রাখার জন্য আমাদের ওপরও কোরবানির বিধান রাখা হয়েছে। জায়েদ ইবনে আরকাম রা: বলেন, সাহাবায়ে কেরাম রাসূল সা:-কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ, এই কোরবানি কী? রাসূল সা: উত্তরে বললেন, ‘এটি হলো তোমাদের পিতা ইবরাহিম আ:-এর সুন্নত তথা আদর্শ।’ (ইবনে মাজাহ) এ হাদিসের টীকায় মোল্লা আলী কারী রাহ. বলেন, ‘কোরবানি পূর্ববর্তী শরিয়তের এমন এক ইবাদত, যা ইসলামী শরিয়তেও বহাল রয়েছে। বোঝা গেল, হজরত ইবরাহিম আ:-এর মতো কোরবানি দিতে পারাই হলো এই কোরবানির প্রকৃত শিক্ষা ও আদর্শ। লেখক : শিক্ষার্থী, আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, যাত্রাবাড়ী, ঢাকা