কিছু কিছু সিনেমায় ধুন্ধুমার মারপিট নেই, নেই কোনো আইটেম গান। চাকচিক্যময় লোকেশন বা চোখধাঁধানো তারকা নেই। হয়তো এসব কারণেই মুক্তির পর প্রত্যাশামতো প্রেক্ষাগৃহ পায় না এই ছবিগুলো। গুটিকয় প্রেক্ষাগৃহে ছবি মুক্তি দিয়ে সন্তুষ্টি খোঁজেন প্রযোজক-পরিচালকেরা। এত প্রতিকূলতার পর বছর শেষে দেখা যায়, এই ছবিগুলোই পাচ্ছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা পুরস্কার। কেন? গত এক দশক তেমনটাই দেখা গেছে। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের একাধিক শাখায় পুরস্কার জিতে নিচ্ছে বিকল্পধারার ছবি ও স্বাধীন চলচ্চিত্রকারেরা। সম্প্রতি প্রকাশিত তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন থেকে দেখা গেছে, মূলধারার বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের চেয়ে স্বাধীন ও বিকল্পধারার নির্মাতারা পুরস্কারে এগিয়ে আছেন। এর ২৬টি বিভাগে পুরস্কারের জন্য মোট ৩৩ জনের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। এ বছর সবচেয়ে বেশি পুরস্কার ঘরে তুলতে যাচ্ছে মায়া: দ্য লস্ট মাদার ছবিটি। মাসুদ পথিক পরিচালিত এ ছবি আট বিভাগে ১০টি পুরস্কার পেয়েছে। এটি এই পরিচালকের দ্বিতীয় সিনেমা। তাঁর প্রথম ছবি নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ ২০১৪ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার বিভাগে ছয়টি পুরস্কার পেয়েছিল। বাণিজ্যিক সিনেমার বেশির ভাগই একটা ফরম্যাটের মধ্যে ঘোরাফেরা করে। স্বাধীন নির্মাতারা নতুন কিছু করতে এবং নতুন ভাবনা, নতুন প্রয়োগ, নতুন বিষয়ের উপস্থাপন করতে চায়। দিন শেষে চলচ্চিত্র তো শিল্প। তাই বিচার-বিবেচনা শিল্পমান বিবেচনাতেই করা হয়। যে কারণে দেশ-বিদেশের উৎসব ও পুরস্কারে শিল্পমানসম্মত ছবিগুলো গুরুত্ব পায়। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে গত ১০ বছরে দেখা গেছে বিকল্পধারার ছবি ও স্বাধীন পরিচালকদের জয়জয়কার। সেরা ছবিসহ একাধিক শাখায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে গহীনে শব্দ (২০১০), গেরিলা (২০১১), উত্তরের সুর (২০১২), মৃত্তিকা মায়া (২০১৩), নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ (২০১৪), অনিল বাগচীর একদিন ও বাপজানের বায়োস্কোপ (২০১৫), অজ্ঞাতনামা (২০১৬), হালদা (২০১৭), পুত্র(২০১৮) এবং ফাগুন হাওয়ায় (২০১৯) ছবিগুলো।
মূলধারার একাধিক প্রযোজক-পরিচালক মনে করেন, গত এক দশক তারকানির্ভর ছবিতে তেমন গল্প খুঁজে পাওয়া যায় না। তারকাকে ঘিরেই আবর্তিত হয় ছবি। তাঁদের সামনে রেখে দর্শককে আকৃষ্ট করার চেষ্টা থাকে। ক্ষেত্রবিশেষে চেষ্টা সফল হয়, বাণিজ্যও হয় কিছুটা, তবে সমালোচকদের তুষ্ট করতে পারে না সেগুলো। কারণ, তারকার চরিত্রে প্রাধান্য দিতে গিয়ে ছবির শিল্পমান গৌণ হয়ে পড়ে। বাণিজ্যিক ছবি কেন কম পুরস্কার পাচ্ছে?
জ্যেষ্ঠ পরিচালক মতিন রহমান বলেন, ‘গত এক দশক মূলধারার বাণিজ্যিক সিনেমা নির্মাণের যথাযথ পরিবেশ হারিয়েছে। জ্যেষ্ঠ ও চিন্তাশীল পরিচালকদের হাতে কোনো কাজ নেই। যে প্রযোজকেরা একসময় ব্যবসাসফল ও নান্দনিক সব ছবির জন্য বিনিয়োগ করতেন, তাঁরা এখন ছবি বানাচ্ছেন না।’ তবে যে ছবিগুলো বেশি বেশি পুরস্কার পাচ্ছে, সেগুলো নিয়ে মতিন রহমান বলেন, ‘এ ছবিগুলো যে দারুণ কিছু, তা কিন্তু নয়। একটা সময় দেখতে পাই, কোনো কম্পিটিশনই নেই। ছবিই জমা পড়েছে ১০, ১২ বা ১৬টি। তখন সাধারণ মানের একটি ছবি অনেক বিভাগে পুরস্কার পেয়ে যায়।’ মূলধারার ছবিরও পুরস্কৃত হওয়া উচিত। হৃদয়গ্রাহী গান সংযোজনে আমাদের মূলধারার সিনেমা অনেক এগিয়ে। সুতরাং মূলধারাকে সক্রিয় রাখতে হবে। দরকার হয় বিদেশ থেকে ভালো মানের পরিচালক এনে এই ধারার ছবি বানাতে হবে। নির্মাতা তৌকীর আহমেদ বলেন, ‘বাণিজ্যিক সিনেমার বেশির ভাগই একটা ফরম্যাটের মধ্যে ঘোরাফেরা করে। স্বাধীন নির্মাতারা নতুন কিছু করতে এবং নতুন ভাবনা, নতুন প্রয়োগ, নতুন বিষয়ের উপস্থাপন করতে চায়। দিন শেষে চলচ্চিত্র তো শিল্প। তাই বিচার-বিবেচনা শিল্পমান বিবেচনাতেই করা হয়। যে কারণে দেশ-বিদেশের উৎসব ও পুরস্কারে শিল্পমানসম্মত ছবিগুলো গুরুত্ব পায়।’
তবে শুধুই বিকল্পধারার ছবি দিয়ে দেশের সিনেমার বাজার ধরে রাখা সম্ভব নয় বলে মনে করেন নাট্যজন ও নির্মাতা নাসির উদ্দীন ইউসুফ। গেরিলা ছবির এই পরিচালক বলেন, ‘গত এক দশকে নানা অস্থিরতায় দেশে সিনেমা হলও কমেছে। এতে মূলধারার বাণিজ্যিক সিনেমার প্রভাব-প্রতিপত্তি কিছুটা কমে গেছে। কিন্তু মূলধারার ছবিরও পুরস্কৃত হওয়া উচিত। হৃদয়গ্রাহী গান সংযোজনে আমাদের মূলধারার সিনেমা অনেক এগিয়ে। সুতরাং মূলধারাকে সক্রিয় রাখতে হবে। দরকার হয় বিদেশ থেকে ভালো মানের পরিচালক এনে এই ধারার ছবি বানাতে হবে। বিকল্পধারার দর্শক কম, এটা মেনে নিয়েই কাজ করতে হবে। অন্যদিকে মূলধারার সিনেমা না থাকলে সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি ধ্বংস হয়ে যাবে।’ তবে বিকল্পধারার ছবির নির্মাতাদের অনেকে মনে করেন, মূলধারার চলচ্চিত্র পুরস্কার কম পেলেও একে উপেক্ষা করার উপায় নেই। বাণিজ্যিক ছবি সিনেমার বাজার তৈরিতে ভূমিকা রাখে। এ কারণেই বিকল্পধারার নির্মাতারা ব্যতিক্রম ছবি নির্মাণ করতে পারেন সহজে।