দেশের বাজারে গমের দাম এখন বেশ ঊর্ধ্বমুখী। খাতুনগঞ্জে খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছে, এক বছর আগেও এখানে পাইকারিতে কানাডা থেকে সরবরাহকৃত গমের দাম ছিল মণপ্রতি (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা। বর্তমানে একই মানের গম বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ১৫০ থেকে ২ হাজার ১৮০ টাকায়। অন্যদিকে ভারতীয় গমের মণপ্রতি দাম ১ হাজার ১০০ থেকে বেড়ে ১ হাজার ৬০০ টাকায় উঠে গিয়েছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিদ্যমান পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশ অতিরিক্ত দাম দিয়ে হলেও গম আমদানি করতে চাইছে। রাশিয়া-ইউক্রেন থেকে সরবরাহ বন্ধ থাকার পাশাপাশি বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের দামের ঊর্ধ্বগতির কারণে সরকার গত তিন মাস কোনো গম আমদানি করতে পারেনি। এ অবস্থায় দেশে গমের বড় ধরনের সরবরাহ সংকটের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ সংকট মোকাবেলার তাগিদেই বাংলাদেশ এখন ভারতের বিকল্প হিসেবে যেকোনো দেশ থেকে অতিরিক্ত দাম দিয়ে হলেও গম আমদানির দিকে ঝুঁকছে।
জানতে চাইলে দ্য চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়া সংকটকালে আমাদের ভাবনা ছিল বাংলাদেশ সিংহভাগ গম আমদানি করে ভারত থেকে। ফলে গমের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কোনো সংকট হবে না। তবে যুদ্ধ পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া ছাড়াও নানামুখী সংকটে খাদ্যশস্য নিয়ে সরকারের পাশাপাশি ব্যবসায়ীরাও শঙ্কিত। রাশিয়া-ইউক্রেন চুক্তির পর আমরা খাদ্যশস্য বিশেষত গম, ভুট্টাজাতীয় পণ্যের বিষয়ে আশাবাদী হয়েছিলাম। কিন্তু এখন পর্যন্ত ইউক্রেনের বন্দর ব্যবহার বা ওই অঞ্চল থেকে খাদ্যশস্য রফতানি শুরুর বিষয়ে কোনো সবুজ সংকেত পাচ্ছি না।
তিনি আরো বলেন, বৈশ্বিক সংকটের পাশাপাশি এখন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা ডলার সংকটের কারণে সবচেয়ে বেশি অসুবিধার মুখোমুখি হচ্ছে। এ সংকট দূর করা না গেলে বিশ্ববাজার থেকে কম দামে পণ্য আমদানি করলেও বাড়তি দাম ভোক্তার উপর গিয়ে পড়বে। তাছাড়া এভাবে ডলারের বিনিময় হার বাড়তে থাকলে কোনো ব্যবসায়ীই চাইবে না পণ্য আমদানির মাধ্যমে নিজেদের বড় ধরনের ব্যবসায়িক ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিতে।
আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় ভারতে গমের দাম এখনো তুলনামূলক বেশ সস্তা। শিকাগো বোর্ড অব ট্রেডে (সিবিওটি) বর্তমানে গম বেচাকেনা হচ্ছে প্রতি বুশেল (৬০ পাউন্ড) ৮ ডলার ৫ সেন্টে। সেক্ষেত্রে টনপ্রতি মূল্য দাঁড়ায় ২৯৫ ডলার ৭৮ সেন্টে। বাংলাদেশী মুদ্রায় এর পরিমাণ ২৮ হাজার টাকার কিছু বেশিতে। অন্যদিকে ভারতের স্থানীয় বাজারে প্রতি কুইন্টাল গমের এখনকার গড় দাম ২ হাজার ১৭৫ রুপি। সে হিসেবে প্রতি টনের মূল্য দাঁড়ায় ২১ হাজার ৭৫০ রুপিতে। সর্বশেষ বিনিময় হার অনুযায়ী বাংলাদেশী মুদ্রায় এর পরিমাণ দাঁড়ায় ২৫ হাজার ৮৭০ টাকায়। গত এক মাসে দেশটিতে গমের দাম বেড়েছে প্রায় ৫ শতাংশ। আবার সিঙ্গাপুরের প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে গম আমদানিতে বাংলাদেশের খরচও পড়ছে আন্তর্জাতিক বাজার আদর্শগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। ইন্টারন্যাশনাল গ্রেইন কাউন্সিলের (আইজিসি) তথ্য অনুযায়ী, মার্কিন সফট রেড উইন্টার গম এখন প্রতি টন ৩৩৬ ডলারে কেনাবেচা হচ্ছে। হার্ড রেড উইন্টারের মূল্য টনপ্রতি ৩৮৫ ডলার। ইউরোপ থেকে ফ্রেঞ্চ গ্রেড ১ সরবরাহ করা হচ্ছে প্রতি টন ৩৫৮ ডলারে। আর্জেন্টিনা গম রফতানি করছে প্রতি টন ৪১০ ডলারে।
গম আমদানিতে এখন ভারতের ওপরেই সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল বাংলাদেশ। প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে দেশটিতে সম্প্রতি গমের উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে খাদ্যশস্যটির স্থানীয় বাজার। নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে রফতানি সীমিত করে এনেও পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না ভারত সরকার। এরই মধ্যে দেশটিতে গমের আপৎকালীন মজুদ নেমে এসেছে ২০০৮ সালের পর সর্বনি¤েœ। সব মিলিয়ে দেশটিতে গমের স্থানীয় বাজারেই এখন বড় ধরনের সংকট দেখা দিয়েছে। একই সঙ্গে কমে এসেছে দেশটি থেকে খাদ্যশস্যটি আমদানির সুযোগও।
কয়েক বছর আগেও দেশে আমদানীকৃত গমের প্রধান উৎস ছিল রাশিয়া, ইউক্রেন ও কানাডা। ভারত থেকে আমদানি হতো খুব কম। কিন্তু কভিডের প্রাদুর্ভাব-পরবর্তী সময়ে পরিবহন খরচ বৃদ্ধিসহ নানা কারণে দেশে গম আমদানির প্রধান উৎস হয়ে ওঠে ভারত। চলতি বছর খাদ্যশস্যটির বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনে আবারো বড় ধরনের তোলপাড় ফেলে দেয় ইউক্রেন যুদ্ধ। প্রতিকূল আবহাওয়ায় উৎপাদনকারী দেশগুলোর উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটলে পরিস্থিতি আরো সঙ্গিন হয়ে ওঠে। ভারতের প্রতি নির্ভরতা বেড়ে যায় আমদানিকারক দেশগুলোর। আবার দেশটির স্থানীয় বাজারেও গমের দাম বাড়তে থাকলে পরিস্থিতি মোকাবেলায় পণ্যটি রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। তবে বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশগুলোর পাশাপাশি খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর জন্য এ নিষেধাজ্ঞায় ছাড়েরও ঘোষণা দেয়া হয়। এ ছাড় পেলেও তাতে খুব একটা উপকার হয়নি বাংলাদেশের। বাংলাদেশে গম রফতানিতে আগ্রহই দেখাচ্ছেন না ভারতীয় রফতানিকারকরা।
সম্প্রতি ৫০ হাজার টন গম আমদানির জন্য একটি দরপত্র আহ্বান করেছিল সরকার। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দু বিজনেস লাইনের তথ্য অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক ওই বিডে গম সরবরাহের জন্য দরপত্র পড়েছিল মোটে একটি। প্রতি টন গম ৪৭৬ ডলার ৩৮ সেন্টে সরবরাহের প্রস্তাব দিয়ে ওই দরপত্র জমা দিয়েছিল সিঙ্গাপুরভিত্তিক ইন্ট্রা বিজনেস পিটিই লিমিটেড। মাত্র একটি দরপত্র জমা পড়ায় চলতি মাসের মাঝামাঝি টেন্ডারটি বাতিল করে খাদ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু বিশ্ববাজারের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় আর কোনো উপায় না থাকায় চলতি সপ্তাহেই সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে ইন্ট্রা বিজনেসের প্রস্তাবটি গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এর আগের টেন্ডারেও দরপত্র জমা পড়েছিল মাত্র একটি। সেটিতে গম সরবরাহের কাজ পেয়েছিল সিঙ্গাপুরভিত্তিক আরেক প্রতিষ্ঠান অ্যাগ্রোকর্প ইন্টারন্যাশনাল। ওই টেন্ডারের আওতায় টনপ্রতি ২৪৮ ডলারে গম সরবরাহে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
ভারতে কেন্দ্রীয়ভাবে গমের মজুদ তত্ত্বাবধান হয় ফুড করপোরেশন অব ইন্ডিয়ার (এফসিআই) মাধ্যমে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, এফসিআইয়ের হাতে গমের মজুদ এখন প্রায় ২ কোটি ৮৫ লাখ টনে নেমে এসেছে, যা ২০০৮ সালের পর সর্বনি¤œ। যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই দেশটির বেকারিগুলো রুটির দাম অনেকখানি বাড়িয়ে দিয়েছে। সামনের দিনগুলোয় তা আরো বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সর্বশেষ গত মৌসুমের শুরুতে রেকর্ড পরিমাণ গম উৎপাদনের প্রত্যাশা করা হয়েছিল। কিন্তু খরা দীর্ঘায়িত হওয়ার কারণে দেশটিতে উৎপাদন হয়েছে সংশ্লিষ্টদের ধারণার চেয়েও অনেক কম। এ কারণে বাংলাদেশ গম সরবরাহের জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করলেও তাতে অংশ নিচ্ছেন না ভারতীয় রফতানিকারকরা।
পরিবহন খরচ ও দাম কম হওয়ায় দেশের ব্যবসায়ীদের কাছে এখন গম আমদানির সবচেয়ে আকর্ষণীয় উৎস ভারত। কিন্তু ভারতীয় ব্যবসায়ীরা এখন বাংলাদেশের আমদানি দরপত্রে অংশ না নেয়ায় বাংলাদেশকে অনেকটা বাধ্য হয়েই সিঙ্গাপুরের কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে বেশি দামে গম কিনতে হচ্ছে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। দেশে ভোগ্যপণ্যের বৃহত্তম পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মেসার্স এ জামান অ্যান্ড ব্রাদার্সের স্বত্বাধিকারী ও চিটাগাং মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক মো. নুরুল আলম বলেন, বাংলাদেশে গম রফতানির অন্যতম উৎস দেশ হয়ে উঠেছিল ভারত। গমের গুণগত মান ও দামের কারণে বিশেষত আটা তৈরির জন্য ভারতীয় গম আমদানি সুবিধাজনক ছিল। কিন্তু গত কয়েক মাস ভারত সরকারের সিদ্ধান্তে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো গম রফতানির ক্ষেত্রে নানা সংকটের মধ্যে পড়েছে, যার কারণে সংকটময় বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের গমের বাজার নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটছে না। শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা বিশ্বেই এখন গমের সরবরাহ নিয়ে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। যুদ্ধ শুরুর আগেও বৈশ্বিক গম সরবরাহের ৩০ শতাংশই এসেছে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে। গমের বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনে যুদ্ধের কারণে দুটি দেশই প্রায় অনুপস্থিত রয়েছে কয়েক মাস ধরে। খরায় গমের উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে আরেক বৃহৎ সরবরাহকারী দেশ কানাডায়। বর্তমানে খাদ্যশস্যটির বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনে বড় ধরনের তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় গম আমদানির উৎস হিসেবে ভারতের প্রতি নির্ভরশীলতা বাড়িয়েছে বিশ্বের অনেক দেশ। শুধু এপ্রিলেই ভারত থেকে গম রফতানি হয়েছে ১৪ লাখ টন। ঠিক ওই সময়েই দেশটির ওপর দিয়ে বয়ে গিয়েছে তাপপ্রবাহ ও খরা, যা খাদ্যশস্যটির উৎপাদনেও বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে। স্থানীয় সরবরাহ ঠিক রাখতে গত ১৩ মে পণ্যটি রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ভারত। বিষয়টি বিপাকে ফেলে দেয় বাংলাদেশকে। ভারত সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশটি ২০২১-২২ অর্থবছরে (এপ্রিল-মার্চ) মোট গম রফতানি করেছে ৭২ লাখ ৩০ হাজার টন। এর মধ্যে বাংলাদেশ একাই আমদানি করেছে ৫৬ শতাংশ। অন্যদিকে চলতি বছরের এপ্রিল ও মে মাসে ভারত থেকে গম রফতানি হয়েছে ২৬ লাখ টন। এর মধ্যে বাংলাদেশ আমদানি করেছে ৬ লাখ ৪০ হাজার টন।
গত মাসে ভারতীয় গমের প্রতি নির্ভরশীলতা বৃদ্ধির বিষয়টি উল্লেখ করে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ২০২২-২৩ অর্থবছরের চাহিদা পূরণের জন্য ভারত থেকে গম আমদানির প্রয়োজন পড়বে অন্তত ৬২ লাখ টন। ভারত রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার আগ পর্যন্ত দেশটি থেকে তুলনামূলক অনেক কম দামে গম আমদানি করছিল বাংলাদেশ। নিষেধাজ্ঞার পর প্রতিবেশী হিসেবে ভারত বাংলাদেশকে বিশেষ সুবিধা দেয়ার ঘোষণা দিলেও তাতে খুব একটা কাজ হয়নি। বরং ভারতের পরিবর্তে এখন অন্য উৎসের গম আরো অনেক বেশি দামে আমদানি করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে।